প্রিয় কবিতার কথা
আমাকে সবচেয়ে বেশি টানে কবিতা। ফলে লেখার সূচনা থেকেই কবিতার প্রতি আমার প্রগাঢ় টান। প্রথম প্রেমে যেমন টান অনুভব করে প্রেমিক বা প্রেমিকা, কবিতার প্রতি আমার টানও ঠিক তেমনই। ভাবনাগুলো একত্রে করে সাঁকো বানানোর চেষ্টা করি। মানে অর্থবহ করার চেষ্টা, সেই চেষ্টা কখনো মনঃপুত হয়, কখনো হয় না। ভালো না লাগলে ছিঁড়ে ফেলি, আবার ছেড়া বাক্যগুলো খুঁজে ফিরি হারিয়ে যাওয়া শিশুর মতো।
আমার সব কবিতাই প্রিয়। তারপরও কিছু কবিতা আছে যেগুলো প্রাণের অনুভূতির সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। যে শব্দগুলো লেখার পর স্বস্তি লাগে, বাক্যগুলো প্রতিবার পাঠে আমাকে শৈশবের কথা মনে করিয়ে দেয়। আবেগ-অনুভূতির এক হেচকা টানে অতীত বা ভবিষ্যতের কথা ভাবিয়ে তুলে, অনুরণিত করে। ফেলে আসা সময়ের সুক্ষ্ম অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলে, সেইসব কবিতা আলাদা ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি করে।
বলা ভালো, নিজের সত্তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, ভালো লাগার কবিতাগুলো। এরা আমার কাছে সবসময় নতুন অনুভূতি নিয়ে আসে, যেমন সন্তানের হাসি। এইসব কবিতারা নিঃশব্দে বেঁচে থাকার প্রেরণা।
সময়
ধারণ করবার আগেই ফুারিয়ে যায় দৃশ্য
কবিতার খাতা, সাদাপৃষ্ঠা তার অকারণ।
শব্দসব অকারণ জেগে উঠে
আঙুলে শব্দ, কলমে শব্দ
পেছন ফিরে দেখি তুমি নেই–ঝরাপাতার ধ্বনি।
অক্ষরে অক্ষর জেগে উঠে–কী আপরূপ দৃশ্য।
দৃশ্যসব জেগে উঠবার আগেই
ওত পেতে থাকি
বাতাসে শব্দ, বৃষ্টিতে শব্দ
বর্ণে-বর্ণে গঠিত হয় শব্দ
কবিতার মতো ময়াবী কী আছে জগতে?
মুগ্ধ করো প্রিয়; গেয়ে ওঠো শিশিরের গান
আজ জোৎস্না-প্রভাত, ওষ্ঠে তোমার গ্রাণ।
দৃশ্যসব ধারণ করবার আগেই শব্দসব উড়াউড়ি করে।
পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা মুখরিত হয়ে উঠে
তোমার নিঃশব্দ সময়।
সীমানা
আকাশে গুচ্ছ মেঘের দল আনমনে পেরিয়ে যায় সীমারেখা
নিজের অজান্তেই শালিক পাখিটি ওপার ঘুরে আসে।
তোমাদের সীমানা প্রাচীর হয়ে বৃষ্টির জল
নেমে আসে এ তল্লাটে—অনায়াসে
ঝড়ো হাওয়ার সাথে শুকনো পাতার দল।
সাগরের স্বচ্ছ জলে মুখ লুকাতে হাপিয়ে উঠি
আলিঙ্গনের দূরত্ব রাইফেলের নল
এপারে আসতে মানা, ওপারে যেতে
এই পথ আমার নয়; ওই পথ তোমার
হৃদয়ে রক্ত ঝরে, শীতল হয়—
এপারে জল ছুঁয়ে দিলে তোমার উঞ্চতা অনুভব করি
বাতাসে সুগন্ধী
এপারে আসতে মানা, ওপারে যেতে
অন্ধকার ডুবে থাকে কাটাতার জুড়ে।
দুটো ফুল দুটো দেশ
আমার বেদনারা কেবলই বিচলিত করে
পাহাড়ি ফুলে মেঘ রোদ্দুরে…
জীবনের চেয়ে স্মৃতির বোঝা আজ ঢের ভারী
পাহারের বাতাস জানে, হাওরামুখী লঞ্চও জানে
আঙুলে আমার পিন বিঁধলে, কতটা বিচলিত হও তুমি
আমাদের অনুরাগ; মান-অভিমান সব ভুলে।
শত ফুল সৌরভ ছড়ায় পাহারে-পাথারে
তোমার নিঃশ্বাসে আমার সকাল
তোমার নিঃশ্বাসে আমার সন্ধ্যা
তোমার নিঃশ্বাসে নামে রাত; উজাগর সময়
ঘরে ফেরার তারা নেই আজ আর
গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি একলা পার্কে
মাছের মতো লেজ নেরে পথ খুঁজি-
ঘরমুখো মানুষের মতো
অন্তর্জালে দুঃখ বুনি
তোমার মলিন মুখে অচেনা রেখা
পাহড়ে স্মৃতি টুকে টুকে আয়ুরেখা কমে আসে
সন্ধ্যাশ্লোকে বিপন্ন সময়
এখন রাত্রি এলে ভয় চেপে ধরে, পাজরে কাঁপন জাগে
অঙুলে রক্ত চোখে পড়ে না কারও- অন্ধদৃষ্টি
দুটি হৃদয় এক হতে হতে ভাগ হয়ে যায়
দুটো ফুল; দুটো ভীন্ন স্বদেশ।
শহরে নতুন চাঁদ
তোমার শহরে আজ উঠছে নতুন চাঁদ তারাদের গালে
পালাতে গিয়ে আটকে যাই মাছের মতোন জালে।
তুমি আছ, তুমি নেই
মায়বী শহরে তুমিই একখণ্ড আশ্রয়ভূমি।
হাতে শীতল পরশ, ওষ্ঠে বরফজল
হুট করে বেরিয়ে যাও, ছায়ার মতো মায়া
এ শহর মায়াবী অতি, বার্তা নেই কোনো প্রেমহীন।
তোমার শহরে অলি-গলি চিনতেই বারো বছর…
শ্যাওলাজমা ঘাট, দুপুরের রোদ, কাশফুল
আর মঠ ও মন্দির ঘুরে ভিজেছে শরীর
নরম রোদের মায়া কাটেনি আজও
মৃদু বাতাসের এমন সহজ আলিঙ্গন।
মায়বী শহরে তুমি একখণ্ড ছায়াসুনিবিড় আশ্রয় আমার!
বেহুলার প্রতি
জেনেছে মানুষজন্ম-ইতিহাস কখনো করে না ক্ষমা
ধোবিনের ঘাটে সব অভিমান থাকুক জমা।
সবকিছু যাবে, সবকিছু মিথ্যে হয়ে যাবে
ভাসান নদে চর জেগে উঠবে-একথা জেনো
নিপীড়িতের চিৎকারে ভারী হয়ে উঠবে মর্ত্যরে বাতাস
উজানের ঢেউয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বালুকণা জড়ো হবে
লাল কাকড়া লুকাবে বালুচরে ছুঁয়ে দেওয়ার আগেই
শামুক শাবক হারাবে শৈশব
গর্জনে-ঢেউয়ে সোনালি রোদে
এমন সময় মানুষের প্রয়োজন বড় বেশি
অথচ মানুষ কই!
শোষকের থলে থেকে গলে পড়ে রক্ত-মাংস
আত্মারা জেগে উঠবে বলে
ছায়াদের অড়ালে ব্যস্ত সময় হারালে তোমাকে পড়ে মনে।
পুনর্জন্ম পেলে তুমিই হবে স্বর্গসঙ্গী
চম্পকনগরে রাত নেমে এলে চলে এসো মায়াবি শহরে
মানুষের ভির আর ঘামের গন্ধ ঠেলে
পাহাড়ি সুড়ঙ্গ বেয়ে নেমে এসো জলের রানি
এসো সর্ষেফুল আলপথ রাঙিয়ে
নেমে এসো ঈশ্বরের রূপে ধোবিনের ঘাটে।