শঙ্খময় পৃথিবীর ছায়া ॥ ফকির ইলিয়াস
করোনা বলে আসলে বিশেষ কোনো বীজাণু নেই!
যা আছে, তা দীর্ঘঘুমের একটি বাহু মাত্র!
যে বাহু না থাকলে প্রেমিক তার প্রেমিকাকে
জড়িয়ে ধরতে পারে না। ফেরাতে পারে না বৈশাখি তাণ্ডব!
অগণিত মৃত্যুর ভার নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে যে পৃথিবী
আমার এখন আর তার দিকে তাকাবারও ইচ্ছে
করে না। বরং এই ফুলগুলোকে বলি-
তোমরা কবির দেহভস্মের ভালোবাসায় সিক্ত হও।
আজ ২১ এপ্রিল ২০২১ বুধবারের নিউইয়র্কের সকাল
হঠাৎ করেই শঙ্খসূর্য ভেদ করে যে দমকা ঝড়
নামিয়েছিল, তাকেই বরণ করো।
আর বিশ্বের তাবৎ কবিকূলকে বলো, এই মাটি থেকে
আজই মুছে গেছে একটি পদরেখা।কিন্তু অমর হয়েছে
কিছু কর্ম- কিছু যজ্ঞের মশাল।
ধ্যানে বসে যে ঋষি, মানবের জন্য প্রার্থনা করেন-
তার চেয়ে বড় পঙক্তিপিতা জগতে আর কে!
আর কার হাতে এর চেয়ে বেশি,
অংকিত হতে পারে স্রষ্টার নির্জন মুখ !
চিতা, জ্বলে ওঠো ॥ বীরেন মুখার্জী
কায়ক্লেশে মুখ ধুয়ে, ‘চিতা, জ্বলে ওঠো’;
সারাদিন রকমারি ফসিল কাঁধে
ছুটে যেতে যেতে, বহুদূরে;
সাজানো অক্ষরের সৌন্দর্যে
একবার ফেরাও দৃষ্টি, দেখো—
ফুটে আছে জীবনের প্রগাঢ় মূর্খতা
সেখানেও—
‘চিতা, জ্বলে ওঠো’ তুমি, সামনে-পেছনে
অন্ত্যজ মানুষের ঢল উপেক্ষা করে
মগজের কোষের ভিতরে—
প্রার্থনার খুব কাছে, অপত্য আহ্লাদে।
মানুষের পৃথিবীতে মানুষই একা, ভীষণ পোড়ে
জ্বলে ওঠো চিতা, প্রিয় কবিতার জন্মঋণে।
তিনি কি জানতেন চলে যাবেন ॥ রওশন রুবী
কবি এক নিমগ্ন ব্যাধির নামে পরাজয় লিখে নিলেন।
কবি কি জানতেন তিনি চলে যাচ্ছেন?
জানতেন কি এই অবধারিত ঘুম?
চলে যায়, অদ্ভুত আড়ালে কবি চলে যায়।
চলে যাওয়া অনিবার্য হলে বেঁধে রাখা দায়।
কবি যায়। বিমর্ষ বেলার পাড় ঘেঁষে ঘেঁষে যায়।
কেবলি যাবার তাড়া, কেবলি যাচ্ছে সবে,
কী ব্যাকুল আহ্বানে সাড়া দিয়ে।
রচনার খাতা-বই, স্বপ্ন, টুকিটাকি সব বিমর্ষ, শোকাহত।
বাতিঘর আলোহীন, অন্ধপোস্টারে ঢাকা দেয়ালের মুখ,
কবির ব্যথিত অসুখ। চুপচাপ কোলাহল।
কবি মুখোমুখি দিনরাত্রি ঘোর বিরোধীর ।
বিহ্বল বেদনার খামে ভরা হলো ক্ষরণের গোলাপ,
কবির মতো সুগন্ধি গোলাপ, রক্তজবা,
একা একা ফোটে, একাই ঝরে,
কেউ কেউ গন্ধ আর বীজ রেখে যায়।
তিনি কি জানতেন চলে যাবেন?
জানাতে পেরেছেন কি নতুন শব্দকে কিছু?
কবিদের ইন্দ্রিয় উচ্চমার্গের।
ধারণ করেন ব্যতিক্রমি বলয়।
তিনি কি তাই পরিশেষ বুঝে ছিলেন-
এই যাওয়া ফিরে আসা নয়, এই শ্বাস অন্তিম?
শঙ্খ কবি ॥ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
ফুঁ দিলে শঙ্খ ঘোষে
বেজে ওঠে কানের পর্দায়
মর্ত্যের আরাধনা-বার্তা পৌঁছে দেয় অমর্ত্যে
শঙ্খ এক পবিত্র বাদ্যযন্ত্র।
যে শঙ্খ আজ তারা হয়ে গেছে জীবনের দীপ নিভে
যে শঙ্খ আজ নির্ঘোষ হয়েছে নিঃশ্বাস বুকে বেঁধে
সে শঙ্খ বাদ্যযন্ত্র নয়, সে শঙ্খ স্বনকও নয়
সে শঙ্খ আরাধনার মাধ্যম নয়, স্বয়ং আরাধ্য।
শঙ্খের মুখ ঢেকেছিল বিজ্ঞাপনে
শ্রুত সত্যকে সে ভুল হোক তা কামনা করেছিল সর্বান্তকরণে
শঙ্খ শঙ্কা হরণ করে কবিতায় বানিয়েছিল ইন্দ্রপ্রস্থ
নিবিড় নৈঃশব্দ্যেও শঙ্খ তৈরি করেছিল গর্জন।
শঙ্খের শব্দগুলো অনিমেষ মৌন যেন চাঁদপুরের জলজ্যোৎস্না
তবু তাদের শক্তি পঞ্চপাণ্ডবের চেয়েও অমিতবিক্রমী
জীবনোত্তর পঞ্চপাণ্ডবের সর্বশেষ ক্ষত্রিয় শঙ্খ
শঙ্খ শব্দুরে নয়, শঙ্খ সমুরে নয়, শঙ্খ কবি, কবিই।