লাটিম যেভাবে ঢলে পড়ে
পৃথিবীপৃষ্ঠে কোনো নিশ্চিন্ত দাগ না ফেলেই ফুরিয়ে যাচ্ছি। ঘোর ঘুম পাচ্ছে, অন্ধকার
চোখ পর্দা টেনেছে, ঘুমাতে দিচ্ছে না। দৃষ্টির অভ্যন্তরে দুইটা চাঁদ, সর্বক্ষণ চুমোর চাদরে ডুবে থাকে হৃদয় আমার।
গোপনীয়তা বলতে বুকের ভেতর ঘূর্ণয়মান লাটিম এবং সদা তৎপর চাঁদ দুইটা,
যারা আমায় বাবা ডাকে।
শঙ্কা
প্রত্যেকটি মেয়েশিশুর বুকে, মুখে, পেটে অসংখ্য মা লেগে থাকে…
তবুও তাদের ধর্ষিত হতে হয়।
সকল পুরুষ কবে পিতা হয়ে উঠবে?
ভাতের শরীরে
তোমাদের শরীরে এমন সব অন্ধকার ভর করছে, যাতে বিড়ালের চোখ ডুবে যায় অনায়াসে। অথচ নতুন শরীরের খোঁজে দৌড়াতে থাকো, পা সেতুর উলঙ্গ গতরকে ঝেড়ে-মুছে ভেতর বানিয়ে নাও, সেখানে তবুও পড়ে থাকে কিছু আঁশটে লোম! কিছু থুতু তখন অত্যন্ত ব্যক্তিগত হয়ে ওঠে, শোভাবর্ধন করে তোমাদের শো কেসে! পাঁজরের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ফোঁপাতে থাকে অপমান। যাকে একদিন বেড়ালচোখী বানিয়ে ছুড়ে ফেলেছিল পেটের আব্রু ঢাকতে, সেই আজ ভাত রাঁধছে তোমাদের শরীরে।
বাতাসের কোনো ঝিরিঝিরি নেই
বাতাসের কোনো ঝিরিঝিরি নেই, গাছেরও নেই, আছে একমাত্র পাতার, আর আছে তা হল ঝরে যাবার ইতিহাস। জাবরকাটা শীত, বসন্তের শেষে খেরো গ্রীষ্ম, আছে নতুন মেজাজ, কচি কচি, সবুজাভ। পাতা উড়ে যায়, ঠোঁটের মতো, মুখের মতো, বুকের মতো, শরীরের মতো, পাতার অভ্যাস, বাতাসে বুদবুদ নেই, স্নায়ু নেই, অনুভূতিহীন, তবু কত অনুভূতিময়, শ্বাস-প্রশ্বাসের পাতায় আঁকে বাঁচার অনুরোধ।
তোমার জন্য এই কবিতা
বসে থাকতে থাকতে ঘড়িটা তন্দ্রাহত, বিকেলের প্রজাপতি চোখে ক্লান্তির মেঘ, আর কিছু সময় বাদেই নামবে মুষল অন্ধকার! বৃষ্টিতে আমার খুব হিংসে, যেভাবে তোমায় জাপটে ধরে, আঙুল স্পর্শেই আমার যত দোষ। তুমি এখনো এলে না?
অবহেলা আমার পকেট হাতড়াচ্ছে, ওই পাশের অভিজাত ফটক দাঁত বের করে হাসছে, কিছুক্ষণ পূর্বেও একটা টইটুম্বুর প্যাকেজ ঢুকেছে সেখানে। সময়ের সাথে ঘণ্টাচুক্তি বাতিল, পার্কের বেঞ্চিতে বসে গুনছি প্রহর, দুটো কৌতূহলী ঘাসফড়িঙ আমাকে টুকে নিয়ে গেল, তুমি জানো ভরন্ত সন্ধেবেলার পার্ক কেমন কৌতূহলোদ্দীপক? আসছো না কেন? কথাবন্ধু অসময়ে মেরেছে চুপ, অথচ কাল সারারাত লাল-টিপ এঁকে নেচেছিল চার্জার, বৈদ্যুতিক অনুপরমাণু গতিপথে আনতে পারে না ঢেউ?
মশার কামড়ে তলিয়ে যাচ্ছে এ শহর, চেহারা পাল্টাচ্ছে নিয়নের বিচ্ছিরি চোখ, রুটির খামিরে খেলা করছে ঢেউ ঢেউ অস্থিরতা, লাল লাল দানা খেয়ে আভিজাত্য পরে নিচ্ছে অনিদ্রা।
ওই তো আসছ, জানতাম,আসবে,
শাদা শাদা প্রজাপতি-আঁচল মেলছে পাখনা। কে উড়াল লাল নিশান, কে ভরাল তোমার ওই কপালে সিঁদুরের আঁচ?
আঙুলের স্পর্শ আমাকে শতবর্ষী করে
ভাবছিলাম নিজস্ব একটা চাঁদ থাকলে তার একটা নাম দিতাম। কিন্তু রামধনু’র রঙ না মেখেই দিগন্তে ঝোলানো সিঁড়ির হাত ধরে আমাকে নেমে আসতে হয় বাস্তবের উদরে। প্রাপ্তি বলতে একটা হাইপোথেটিক্যাল প্রেম। যদিও আঙুল এখনো স্থির অবিরাম, সেটার আরম্ভটাও প্রায় বয়সের এক তৃতীয়াংশ। আকাশের মুখে জ্বলজ্বল করে একটা হারিকেন স্পট, তাকে ঘিরে আরও কিছু অঘোষিত প্রণয়াখ্যান। আয়নার পেছনে পড়ে থাক সে সব উপাদান, খুব বেশি সাহসী হয়ে ওঠা হয় না, পেছন থেকে চোখ রাঙায় মাকড়শা অতীত। প্রেমের কথা বলছিলাম, আঁকতে গেলে সেটাকে রেললাইন প্রেম বলাই শ্রেয়, ট্রেন নেই, যাত্রী নেই, স্টেশন নেই, কাটাকুটি নেই, উঁচু-নিচুর বালাই নেই। সিগন্যাল মাস্টার নিঃসন্তান, চেষ্টার ত্রুটি না রাখার অংশ হিসেবে তার নিজস্ব বাঁকানো চাঁদটির পেটে আণুবীক্ষণিক যত্ন আঁকছে। রেললাইন প্রেমের বাঁ পাশে মেলা বসে, কোল ঘেঁষে নাগরদোলা ভোঁ-ভোঁ, জুয়ার আসর, পুতুলনাচ, সার্কাস আর কিছু কাঁচা আসবাব ঠোঁটে রঙ মেখে বসে থাকে। আমার কিছু চাইতে নেই, তবুও পৃথিবীব্যাপী আমি খুঁজে ফিরি আংটি-বিহীন আঙ্গুল, শুধু সেই স্পর্শেই আমার প্রাণবায়ু মেপে দিয়ে যায় সক্ষম হয়ে ওঠা সিগন্যাল মাস্টার, সেই আঙুল স্পর্শেই আমার শতবর্ষী আয়ু ঝুলে থাকে বাবলা গাছের শারীরিক কষে।
নাকফুল
এইমাত্র শেষ হল হৃদয়-উৎকর্ণ বৃষ্টির টিপটিপ সেলাইমেশিন, তৎক্ষণাৎ দর্পবিদ্যুতে মোড়ানো নাকফুল নেমে এলো রাত্রিপুষ্প মুখে। কিছুই অচেনা নয়, অথচ চেনা বলবার সাহস ঝুলে গেছে সবুজাভ লাউয়ের ঠোঁটে। সেলাইমেশিন অবিরত ফুটো করে চলে অনুভূতির গুটানো শরীরকে। রাত্রিপুষ্প মুখের কারুকাজ দেখতে থাকি লবণাক্ত চোখের অস্পষ্ট ফোকাসে। বৃষ্টির গোপনীয়তা একদিন চুরি করে নিয়ে যাবে লাউয়ের শাঁস, হৃদয়ে বৈরাগ্য চাপিয়ে আমি গাইতে থাকবো গান, নাকফুল।
ফুলকন্যা
ব্যস্ত ছকে প্রতিদিন নেমে আসে স্থিরতা, সবুজ-হলুদ-লাল অনন্তকাল, প্রায়শ, এই স্থানটিতেই। এখানেই নেমে আসে বেদনার কারুকাজে মোড়ানো সত্যাগন্ধী কিশোরীর মুখশ্রী। হাতে অবিন্যস্ত গোলাপ গুচ্ছ, কখনো কখনো দুঃখ কুড়িয়ে গেঁথে নেওয়া শিউলি।
স্যার ফুল নিতেন? গুলাপ, মাত্র দশ ট্যাহায় এতোগুলান ফুল, পাইতেন না কিন্তু, কী সুন্দর দ্যাক-ছেন, নিয়া যান, ন্যান না, খুউব ক্ষুধা লাগছে!
টেম্পার্ড গ্লাসে চ্যাপ্টা হয়ে লেগে যায় বিবস্ত্র নিঃশ্বাস, সমৃদ্ধি মেখে খায় অন্ধ সময়! এখান থেকেই পেট সমান দূরত্বে স্বর্ণখচিত দাঁত মেলে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী’র কার্যালয়, বাঁয়ে খাড়া হয়ে আছে স্বাধীনতা-গণতন্ত্রের প্রতীক মহান সংসদ। হয়ত পাস হচ্ছে ফানুস মোড়ানো লক্ষ কোটির বাজেট।
ফুল-কন্যা-ক্ষুধা, সংসদ-স্বাধীনতা-গণতন্ত্র অনুভূতির একেক চেহারা।
কন্যা, একটু এগিয়ে যাও, ফুল ফেলে সুখ কুড়িয়ে নাও।
ট্রেন এক প্রেমিকা
দূরবর্তী শহরগামী একটা ট্রেন একদা আমার প্রেমিকা হয়ে উঠেছিল। আজও সংকেত-বাহী রুমাল হাতে দাঁড়িয়ে আছি, ট্রেন ফিরে আসেনি।
এতদিনে বুঝেছি ট্রেন মানে শুধু বিচ্ছিন্ন একটি বগি অথবা একটা সক্ষম ইঞ্জিন নয়, ট্রেন এমন এক প্রেমিকা- যাকে পেতে সুইচ্ছার তীব্র রেললাইন প্রয়োজন।
আকাশ চুরি করেই ফিরে আসবো
কেন কাঠিন্যের লেন্স পরো? তোমার দৃষ্টি তো মাইওপিয়া আক্রান্ত ছিলো না কোনোদিন। একটা সরল নদীর কাজল এঁকে এসেছিলাম, তুমি চোখ বুজলেই আমি
হয়ে উঠতাম অ-সহিষ্ণু ফিনিক্স। উড়াল? এ তো এক মহান শিল্প! তোমাকে নিশ্চিন্ত দেব বলে পাহাড় কেটে নিয়ে এসেছি নিবিষ্ট স্পর্শ, তোমার নরম আগলে রেখেছি,চোখ খোলো।
ব্যক্তিগত আয়নার দাগগুলো চূর্ণবিচূর্ণ হবার পূর্বেই যাচাই করো অবয়বের গভীরতা। আমি আকাশ চুরি করেই ফিরে আসবো।
বাঘশুমারী
কতটি বাঘ বেঁচে থাকলে ভয়ার্ত হবেন? বাঘশুমারীতে তাই বুঝি এতো লগ্নি? ফার্নেস অয়েল দিয়ে পাপের মুখে হরিণ-মাংসের স্বাদ চাপালেই কি কেউ সূক্ষ্ম শিকারি হয়ে উঠতে পারে? জানুয়ারি নাকি উত্তাপে ঝলসে যাবে, মৃত্যুর ধরন অনুযায়ী আমরা সৎকারের আয়োজন করব।
কাটাছেঁড়ায় রাস্তাঘাট হয়ে উঠেছে শিক্ষানবিশ সার্জেনের রোগী, মাথার খুলি দিয়ে চলছে আন্তর্জাতিক খেলাধুলা।
লেবুবিশ্বাসী মুখে ভরপুর তারুণ্য, কালোমেঘ যে ছায়া দেয় তার মুখে ঘৃণা, আমাদের দেহবণ্টন হবে, আমরা দলিলপত্রে সেইসব চিত্রকলাই আঁকছি…
তাতে বাঘের মুখ নেই অথবা সুন্দরবনের দেহ-ভস্ম নেই, রাস্তার সস্তা শরীরও নেই।
ভয় দেখাবেন না, সকলেই জানে কারণ অতীব সামান্য…..