লন্ডনভ্রমণ ২০১৮
(কবি আবু মকসুদ, বন্ধুবরেষু)
সূর্যোদয় সূর্যাস্ত ছিল না, তাহাদের।
রাণীর রামরাজত্বের আলো ক্রমাগত গ্রাস করছে কালো, সন্ধ্যা
টিমটিম অন্ধকার। কেরোসিন ফুরানো নিভু নিভু বাতিঘর।
ব্রিকলেনে বিলেতি টুপি নেই, বিরিয়ানির গন্ধ।
মুখে কমলালেবুর ঘ্রাণ। হিহি হাহা হাসে হিজরা সময়।
ভিটেমাটি ছেড়ে
বৃষ্টি বিক্রি করে,
শীতগুলো সাথে নিয়ে লন্ডন ছেড়ে পালিয়েছে স্কটল্যান্ডে-
শহরের বাইরে ঘুমায় গ্রামে, খামারে। কেউ কেউ শহরের উল্টো পিঠে।
স্টিপেন ওয়াটস আরও একটু বুড়ো হয়েছে, টাকে-পাকে…
এখনো কাটেনি বরিশালের নেশা।
শেকসপিয়ার তাঁর প্রিয় সেক্স পিয়ার!
হোয়াইট চ্যাপল থেকে বের হচ্ছে আফ্রিকান পচা ইঁদুরের গন্ধ,
মিউজিয়ামে মীর জাফর, এখানে বীর জাফর।
তবু জ্বর থরথর কাঁপছে হিথ্রো!
টেমসের জলে ঝং ধরছে, ক্ষয়ে যাচ্ছে বৃটেনের জুতো।
ঐক্যের বিপক্ষে বিনিদ্র পাউন্ড নিদ্রাহীন, কিছুটা ক্লান্ত
এখনো ইউরো থেকে আলাদা,
পতনের ফুল ফুটছে, ঝরছে, হিজরা সময় এবং কালো সন্ধ্যা।
বাকশক্তি হারিয়ে বিবিসি বোবা এবং দৃষ্টিহীন।
হ্যান্ড কম্পোজ এবং গুটেন বার্গের বেদনা
ঝলমলে উজ্জ্বল বনজ ক্যাম্পাসে ক্যাবল কার, লাল বাস, সবুজ ট্রেন থামছে, নামছে। কেউবা সাইকেলে চড়ে ক্লাশে যাচ্ছে। বনপরীদের গুটেন বার্গ ভার্সিটি। স্বপ্নের মধ্যেই সাধারণত এ ধরনের দৃশ্য থাকে। দৃশ্যের বাইরে আমরা ছবি তুলছিলাম।
আমাদের জন্য অনেক বছর ধরে অপেক্ষা করছেন ছাপাখানার জনক গুটেনবার্গ। তিনি হাঁটতে হাঁটতে আমাদের নিয়ে গেলেন মাইন আর রাইন মিলিত স্থানে। বিজবাডেন আর মাইনজে। কাঁশবনের ওপরে বাতাসে ভাসমান রেস্টুরেন্টে আমরা বসলাম। লাঞ্চের আগে রেড ওয়াইন খেতে খেতে আমরা আমাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় কথা বলছি। আমাদের মধ্যে কোনো দ্বোভাষী ছিল না। গুটেন বুঝতে পারছিলেন বাংলা আর আমিও অদ্ভূতভাবে বুঝতে পারছি ডয়েচ! আমাদের বৈঠকে বন্ধু বকুল শুধু বকুল ফুলের এক অদ্ভূত স্নিগ্ধ সৌরভ ছড়াচ্ছিলেন।
এক ফাঁকে গুটেন বললেন, তাঁর (হিটলার) নাম উচ্চারণ করা অলিখিত নিষেধ। তাই আমরা সেই নিষিদ্ধ নামটি বলব না। পরে বললেন, একবার খুব ঋণগ্রস্ত হয়ে অভাবের তাড়নায় গুটেনবার্গ প্রেসটা বিক্রি করে ছিলাম। কিনে নিয়েছিলেন বিশ্বজিত চৌধুরী। বিশুর কথা জানতে চাইলেন। বললেন, রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর একবার হয়েছিল এই রেস্টুরেন্টে, এই খানে, এই চেয়ারে।
গুটেনবার্গ কথা বলতে বলতে, লাঞ্চ করতে করতে আবেগে খুব আক্ষেপ করলেন, হারিয়ে গেলো শিশার বর্ণমালা, বিলুপ্ত হয়ে গেলো হ্যান্ড কম্পোজ, গ্যালি প্রুফ, জাদুঘরে চলে গেলো কাঠের চারটি খোপে বাংলার ৫৬৩টি টাইপ!
তারপর তিনি একটু এলোমেলো হয়ে গেলেন! ভিজে গেলো চোখ! নেপকিন দিয়ে চোখ মুছলেন গুটেনবার্গ!
প্যারিস-১
নাইট কোচ। চাঁদও যাচ্ছিল প্যারিস
পরিত্যক্ত ফ্রান্সের বর্ডার ফাঁকা শ্মশান
শূন্যে জেগে থাকা সীমান্তের চিহ্ন
শান্ত বাতাসে নিরিবিলি নিশিফুল।
তাসের তুরুপের মতো
লাল, সবুজ, কালো নানা বর্ণের পাসপোর্ট
বৃটেনের রানীর নেই, চাঁদেরও না।
নিজস্ব মূল্যবান মুদ্রা মূল্যহীন, নিদ্রামৃত্যু।
বাবাকে জড়িয়ে ধরে জুলিয়ানা কাঁদে
কফির ধোঁয়ায় প্যারিসের পথ হারিয়ে
কোচ নাইট ক্লাব ছেড়ে ভোরের দিকে, বাড়ির দিকে
বরিশালের দিকে…