লখিন্দরের গান
এক.
বোধিরা মরেছে আজ, কেউটে ছোবল খাচ্ছি বর
সাঁই তুমি কথা কও, জলে ভাসি এই লখিন্দর।
নীলকণ্ঠ হয়েছি দেখো, উদোম শরীর দেখো লাশ
আমাকে করেছ পর? কেন শুধু এই পরিহাস?
এদিকে সেদিকে খুঁজি, চারপাশে তোমার আকাল
সব ঘাটে হাস খেল, মূলত এ আমিই মাকাল।
সাঁই তুমি বেহুলা যে, প্রেমের করুণা সঞ্জীবনী।
একবার বীণ ধরো, সাপ এসে ফেলে যাক মণি।
প্রাণ দাও, বিষ ঝেড়ে ভুলি এ মৃত্যুর প্রহসন
বাঁচার তাগিদ জেনে বুড়ো হোক নহলী যৌবন।
তোমাকে সহগ পেলে কে কবে ঠকেছে এক রতি?
অবুঝের পোড়া মন, আবডালে থাকে দুষ্টমতি।
এসো সাঁই ঘর বাঁধি—ঘর নয়, পাতার বাহার
তোমাকে দেখার স্বাদে ভুখা পেটে আমার আহার।
দুই.
ওই যে বৃষ্টির দানা গমদানি ফুলের বাদল
নির্ঝরে ভরতে গিয়ে মুত্যুরঙ টাকা চেয়েছিল,
বিচার হয়নি তার। লখিন্দর আত্মা নিয়ে দিল
যমের কৌটায়। যম জর্দা ছাড়া পানের অচল
চাহিদা মিটিয়ে থাকে। দূরে সাপ চাঁদের ছোবল
থেকে নিয়তির ক্রোধ—আলো নয়, রোধ নিয়ে নিল।
ভাসন্ত লাশের গায়ে পানাফুল স্বপ্নব্যথী ছিল;
ময়ূরপঙ্খিনী শ্বাস জেনে গেছে মৃত্যুর কবল।
আত্মজ জলের মায়া ভাঙনে গিয়েছে ডুবোযান।
মরত্বে অমর থাকে প্রাণপণ পূজার দু’কূল
ছাপানো দেহের শশী। অল্প কালো নিন্দার বহুল
সিঁড়িতে পায়ের ছাপ সাঁতরে গিয়েছে দুঃখ, বান।
জেগেছে প্রান্তরে দেশ, রূপান্তরে অন্য লখিন্দর
বেহুলা আকালে বউ; বলে গেছে সময় অপর।
তিন.
মথুরায় কৃষ্ণ-তলোয়ার।
বিনোদিনী গ্রাম
রোদে জেগেছিল।
কংস মামার বধ হবে না; বৃষ্টির
যৌবন ঝড়ের পূর্ব আভা
ভেঙে দিয়ে তুফানবাহুতে নাচ করে,
কোমরে নদীর বিছা, বর্ষার ফুলন…
রে রে রে চিন্তার জলরাশি
অস্ত্র সমাপনে
অন্তিমে ডেকেছে প্রাণ;
গ্রাম নারায়ণখোলা চাঁদের ষোড়শী কুনোব্যাঙ;
লম্ফনে আলোর কথা ঠিক ভুলে যাবে,
ভুলছে স্বদেশ চর্যাচর্যবিনিশ্চয়।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীয় শুরু, মরদেহে মেহমান।
অতিথির শ্রাদ্ধ কর কাবাডি কেলির সঙ্গপ্রিয়
লক্ষ্মী, নারায়ণ।
বাদল নির্ঝর? না, না, ওসব কবির
প্রতিমা। সঙ্গতিহীন খোলা খোলা গ্রাম
আমাদের। লখিন্দর ভেসে গেল; সূর্য
কতদিন
দেখি না।
চার.
কাকুতির স্বাধীনতা ভেস্তে গেলে
বর্ষাও ভাসান তরী ভুলে যাবে।
ঝড়ের আসেন না কিছু; ভুলে গেলে যায়
অত্যুঙ্গে মানুষ।
সাঁতালি পর্বতে কানু ধন
মন নিয়ে গেল।
ক্ষয়ক্ষতি বিচার্য থাকুক
চিন্তামণিঘরে।
সে-ও গোপ, কোপন হৃদয়
তিলে তিলে মৃত্যুবৎ জটিল বিশ্বাস
মিনারের অঙ্কুরিত সুরে ফুল হয়, সূর্য হয় না সিথান।
ক্ষমা কর: বিধির দু’পায়ে ধান দেব
বর্গার মাণিক্য তুষ, অকাতরে নারায়ণী মন,
শীতলপাটিতে বসো চেউলের কুলাকারিগর,
নর্তকীর বানভাসা ঢেউ
আগুন ছিটাক।
সনকা মাতার কোল খালি, পাছে বেহুলা উধাও।
রমণী বেহায়া নয়, জনতা প্রাকৃত।
ঝড়ের দোলনা থেকে দোল কেড়ে নাও—
বলি, বৃষ্টির জোয়াল কাঁধে তানপুরা
জমির সপ্তক রাগে ওঠা-নামা করে।
জল গরু হয়ে গেল?
লাঙলে অন্নের চিঠি সচিব লিখেছে:
সওদাগিরির জাল জরিমানা। বৈদেশে অর্থের
বাতিল হুকুম। মান্য করি, ধন্য করি
বিনয় নিংড়ে বলি সব নাও, দাও সব যতি।
নিয়োগীর আন্দামানে
নির্ঝরে অন্ধের হা-হুতাশ;
সুহৃদ সমিতি জ্বেলে চাষবাস এই হলো প্রায়।
দেরাদুনে অলিগলি মিছা,
মিছা সব বিধৃত জগৎ
চোর গেল; বুদ্ধি এলে জমি ডাকে, বস্তিওয়ালা সে-ও।
দেশীয় পুণ্যের গায়ে পড়া ডাক
দু’হাতে পাচন ধরো, জাগো লখিন্দর।
পাঁচ.
একটি রোদের মাসি মায়ের পতাকা
থেকে বোন চিনে নেয়। গ্রাম
ঝলেসে ওঠার কথা ছিল।
বুনট বাতাস শর্ত ভাঙা পতাকায়
বোন বোন ওড়ে।
আকাশ আউল মেঘে পুলক দিয়েছে;
সতীরা চালের মতো ভাতে সুখ,
যেমন অসতী নয় তারাগুলো
ফুলমানুষের
চারা হয়ে গেলে।
সন্ধ্যায় গেরস্থ বাবু—মহাজন!
গৌতমের ধ্যানরত খড়ের গাদায়
শোক শোক ছায়ার সমান—
. ভোটের কপাল ফেটে
. বেরিয়ে এলেন।
চেয়ারে মানুষ আর সামনে গুদাম।
পুণ্যের অসাম্যে লুটোপুটি,
ভোজন একার।
যাযাবর পেট ভরে হাঁটে।
জনতা স্বাধীন মাথা নানির জননে
বুঁদ হতে দিলে মাকে চেনা যায়।
ভুলের বাঁশিতে বৃষ্টি মাসিরূপ।
তবু নামো। অজু হবে। জানাজায় মাটির খবর,
মেঘের অশনি। ঝড় এলো।
ব্যালট-সঞ্জাত রায়ে অসতী ঢেঁকুর।
লখিন্দর ভিজে গেছে, বেহুলা ঘুমায়।
আট.
বেহুলা হারানো গেলে উৎপাদনে মৃগয়া সম্ভব?
জীবন ঠেকানো চরে আমলার বেপরোয়া হাত,
ক্ষৌরকর্মে জল ছাড়া বিশ্বাসে না মিলে বস্তু জাত।
তর্কে তর্কাতীত লাভে যার হাতে জীবন বাস্তব,
সৌধের যৌনতাঘর, ছিটকিনি, তার কাছে সব।
বেহুলার জাত গেল। মান পনে চার ভিক্ষার জাকাত।
আমিত্বে সাঁড়াশি টানে। মরে গেলে জাত কি বেজাত।
সবুজ আস্তীর্ণ ক্ষুধা জন্ম দেবে পাথর সৌরভ?
সূর্যই নাটের গুরু; পলাতক আলোর বন্দুকে
জলশুষ্ক ওড়ার দুনিয়া ফালা ফালা রাখে বেশ।
মারণ অস্ত্রের পিতা মশা-মাছি তল গেলে কেশ
উঁচিয়ে রাখেন। থামো; কাঁকই বাসনা ভুলচুকে।
বোমায় রঞ্জিত সিঁথি সিঁদুরের মুক্তিকামী শ্লেষ
লখিন্দর বেহুলা জাগাও, কুলনাশা মরা দেশ।
নয়.
পিণ্ড মনে খয়রাতি মন আজ ষণ্ডা লখিন্দর
কলার ভেলাতে সোনা, পালঙ্কে সন্ন্যাসী, দেহে চট।
সেচের প্রকল্পে খরা, নাকি ঝড়? দোটানা চম্পট।
সকালে বৈকালি তারা মুখ টিপে বেহুলার শর
হাসি হাসি বাসি ভাতে কেরানির জোরালো থাপড়।
অঙ্কুশে জীবন টানে লোহা লোহা শনির হোঁচট।
রাজার নৈতিক বলে খুলবে না মরণের জট—
এমন ভরসা এলে বেদখল! স্বপ্নে যাবে চর।
মনের আয়না জুড়ে বেহুলা স্বদেশ থেকে লীন
লৌকিক চিরল পাতা অন্য দেশে তেঁতুলের বোন
অহেতুক আমেরিকা, রাশিয়ার গৌণ টেলিফোন
নদীর পিঁড়িতে বসে গলাকাটা; যায় যায় দিন…
স্বয়ম্ভু জনমভরা কর্তাগিরি, শিক্ষণের দ্রোণ
চাকুর কণ্টকে জমি, লখিন্দর জাগে; শোন্….
দশ.
কোথায় বেহুলা বধূ?
তোমাকে মীনাক্ষী বলি তীর্থমৃতযোগে
যূথিকা মালায়।
কত আর লগ্নি টানি জলে ভেসে ভেসে?
একি প্রেম? নাকি রোজ মাহেন্দ্র পতন?
শুল্কের বৈকুণ্ঠ জপি
যা লিখার চিন্ময় লিখুক কেরামন-কাতেবিন।
থিবিসের কালো রোদে মহান্ত নায়ক
এসেছি নন্দন স্বামী বঙ্গীয় তৃষ্ণায়
গৃহে ফিরে গৃহহীন। স্মরণ কলঙ্কে
ভোগ দেয়। মহারথী নেই।
ফিরিঙ্গি-রহিত এই ধুলোর আকরে শুধু ঠনঠনে দিন।
আকণ্ঠ সবুজ গিলে রেখেছে রাক্ষস আর পাথুরে বৃষ্টির
হেমলক। নদী কি পথিক ছিল? নদী?
শ্যাওলা…
. রঙ…
. নোঙর…
ধোঁয়ায় সঙ্কীর্ণ-আয়ু নিরালা আকাশ
টুপির কায়িক ছায়া বাবার মাথায়।
ওগো রাম, সীতায় রাবণ-ক্ষুধা; বাঁচার অসত্যে
নির্বাসনে লাভ নেই।
দাদার লাঠিতে ঘুণ; মায়ের কাঁকনে চাঁদ
ছাই হয়ে নামে।
কার কালিমা লিখেছ কেরামান-কাতেবিন
. স্কন্ধের শিলায়?
গুহার বাতাসে ইডিপাস বিদ্ধ-শাপে
কোন পথে চামর দোলায়?
কার পাপে আদিম যিশুর মতো শূলবিদ্ধ মাটি?
ও পাখি, ও বৃক্ষ,
ও আমার লাটিম ঘুরানো মাঠ,
আমি কি জেগে উঠবো ঘাসে
দিঘির পানিতে জিন? ভূধরে নিতম্ব রেখে
. দেখাবো সাহস?
ক্রন্দসী বেহুলা ঘুমে,
সোনার রেকাবে তার এসেছি নোলক।
মাছে-ভাতে স্বপ্নমোড়া গুপ্ত পুলসেরাত;
আমাকে দাঁড়াতে হবে।
কেরামান-কাতেবিন, দ্রাবিড় কিতাবে লিখ প্রত্ম-ইতিহাস।
অ-হল্য জীবনচরে এইখানে দাঁড়ালাম ধৃষ্ট লাঠিয়াল:
আমার দখল নেবে কে আছে এমন?
লবণ প্রার্থনার দিনলিপি
বাগান সংগুপ্ত রেখে
তুমি কেন পাথর ভালোবাসো?
দেয়ালে শ্যাওলা জমে
কাঠামো গুঁড়িয়ে দিলে ধুলো জমে
. প্রত্ম-প্রবেশিকায়
অতীত মোহিত করে তুমি কেন
. পিছনে হাঁটো?
তালগাছ নীরবে বাড়ে। ঝড়েও লুটিয়ে পড়ে না।
তোমাকে পাহাড় দিলাম। মৌনতায় উঠে আসো।
পুলক ছড়িয়ে দিলে
সঙ্গে কিছু বিষাদের দায় থেকে যায়
ঢেউ ঢেউয়ে জীবন মিলিয়ে দেখো
সমুদ্র কখনো লিখবে না লবণ প্রার্থনার দিনলিপি।
বিষাদ তাড়িত হলে তুমি কেন আকাক্সক্ষা মাড়াও?
অপূরণের দাবানলে
মানুষ কেবলি ছাই হতে চায়, সোনা নয় ।
হৃদয়ে আকাশ গুঁজে রাখো
মেঘে মেঘে স্বপ্ন খুঁজে পাবে।
মুত্যুকে প্রেমের জন্য উপাত্ত ভেবো না।
তোমাকে শোনাবো লুপ্ত পাথরের গান।
ট্রাক ফেরাবার গান
একশ’ ট্রাকের চাকা যতবার মৃত্যু ভালোবাসে
তারও বেশি গাড়ির বহরে প্রেম ঘুরছে কথায়।
সোফাসেট উদোম রয়েছে একা। ভালো। বসা যায়।
হাওয়ায় গ্রাম্যতা। চুলে শেভিঙের প্রান্তফেনা আসে।
দেখছে পথিক শুঁয়োপোকা। মন অপত্য সন্ধ্যায়
সভ্যতা খনন করে লোহার মানবতরী বায়।
চাকা চাকা সময়ের নীল ক্ষত প্রেম ভালোবাসে।
চলন্ত সংশয়ের বহুব্রীহি—এসো প্রেম গাড়ি
মেশিন অভদ্র হাঁটে। প্রান্তিক কোচের মনে ট্রাক,
পদ্মার অমর নামে রেলগাড়ি নদী হয়ে যাক।
পুরনো আকাশ থেকে ব্রক্ষপুত্র বলে: বাড়াবাড়ি।
লোহার যৌবনে দাও বন্ধ ছিপি, প্রেমের পোশাক
অঙ্গের বিনোদবাড়ি পায়ে এসো। মাটিতে মৌচাক।