আমি তিন বেলা বৃষ্টিতে ভিজি
আমি তিনবেলা বৃষ্টিতে ভিজি যেভাবে জ্যোৎস্নার
কামার্ত চুম্বন গায়ে মেখে শ্রাবণের ঘাসগুলো ঘুমায় এবং
যেভাবে এক বিন্দু জলের জন্য তৃষ্ণার্ত চাতক
অগ্রাহ্য করে ডানার ক্লান্তি,
ঠিক সেইভাবে আমার স্বপ্নগুলো, আমার ইচ্ছেগুলো
মেদহীন মেঘের কাছে গচ্ছিত রেখে বৃষ্টি চেয়েছিলাম।
তাই এখন আমার চুলে বৃষ্টি,
শরীরে বৃষ্টি
মনে এবং স্মৃতিতে বৃষ্টি
আমার গল্পে এবং কবিতায বৃষ্টি
ঈর্ষায়, ঘৃণায় এবং প্রেমে বৃষ্টি।
আমি তিন বেলা বৃষ্টিতে ভিজি।
অথচ তুমি ভীষণভাবে তুমিহীন এক মানুষ,
যখন তখন বেখাপ্পা নীরবতায় মুখ ফিরিয়ে নাও,
আর আমাকে ভেজাও একরোখা বিবর্ণ বৃষ্টির জলে।
সূর্যের বিপরীতে সূর্যমূখী
তোমার জলে রক্ত ভাসে;
আমার পূর্বপুরুষ—পরিমল দ্রং আর আরেং রিছিল।
তীর ধরে হেঁটে যেতে যেতে আগন্তুক গান গায়।
মায়েরা কিছুই খুঁজে পায় না, মরচে ধরা স্মৃতির ভেতর।
তাদের মন কতটুকু ছুঁতে পারে স্বাধীন আকাশ?
কিংবা পলতে-পাতার হাওয়া কতটা উড়িয়ে নিতে পারে চোখের বিষাদ রঙ!
তাদের ভেতর কেবল গুলির আওয়াজ,
পতনের নাগলা ব্রিজ অতপর নরক দৃশ্যের ভেতর সুবিশাল নরক—আগুন ও আর্তনাদ।
কমান্ডারের নির্দেশ—পিছু হট।
সেই সময় বাড়ির পোষা বিড়ালটার কথা কি খুব মনে পড়েছিল?
কিংবা দুধমাখা হাত!
কুয়াশায় জড়িয়ে গেলো পা।
মুহূর্তেই জলপাই রঙের ছুরিতে ক্ষত-বিক্ষত হলো তোমাদের আর্তনাদ।
আহ্ পরিমল দ্রং! আহ্ আরেং রিছিল!
দুইটি সূর্যমুখী ফুল কংস নদের জলে অস্ত গেলো।
সেই থেকে সূর্যের বিপরীতে তোমাদের আত্মারা ফুটে থাকে
যেন প্রস্ফুটিত সূর্যমুখী ক্ষেত।
ফুলরা রাতের শরীর
দেয়ালে ঝুলছে ফ্রেম, ছবির ফুলেরা যেন রাতের শরীর।
পাখিদের ছায়া ভেঙে ভেঙে যায় মৃতের অস্থি ও করোটির ভেতর।
পেরেকটা হাসে, এখন সে অনুগত দাস; নিজেই নিশ্চিহ্ন করে নিজের শরীর।
দেয়ালে বিদ্ধ পেরেক; ছবিতে মৃত প্রজাপতি, যার চোখের ভেতর অজানা অসুখ।
কোনোরকম শর্ত ছাড়া
যে দিকে হাত বাড়াই—নাগালের বাইরে আমার দেশ ও বসতি।
বিনীত নিবেদক
গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে লোকটা শুকিয়ে যায়।
তার শরীরজুড়ে আশা না করার স্পর্ধা।
ফুসফুস ছিদ্র হয়ে গেছে অপেক্ষায়, চোখ ফ্যাকাশে রক্তহীন।
তবু সে দাঁড়িয়ে আছে পথের পাশে নিশ্চুপ।
গাছেরা চিৎকার করে—জাগো, জেগে ওঠো।
চিৎকার গড়াতে থাকে—
কেউ জাগে না। পাথর চুঁইয়ে ঘাম, লোকটা শুকিয়ে যায়।
কেবল গোলাপ রয়ে যায় তাজা ও সম্পূর্ণ একা।
রেললাইন যায়
মৃত্যুর ভেতর একাই হামাগুড়ি দাও।
আমি তোমার বৃত্তে দাঁড়াই—গোপন উৎস থেকে খসে যাক বোধিবৃক্ষের ছায়া।
দেখো, আয়নায় ভাঙছে চাঁদ, রামধনু কাচের ভেতর থেমে গেছে ট্রেন।
শূন্য দেওয়ালে আদমের হাড়; আমাদের ঘর-গৃহাস্থালী—
সাজানো রক্তের দাগ, হাতের তালুতে অন্ধকার।
ভুবনবন্দি ঘুম নিয়ে রেললাইন হেঁটে যায় জোস্নার দিকে।
একাকী গোলপোস্ট
শ্রাবণ যায় তবু পদ্মপুরাণের পাঠ ফুরায় না, ফুরায় না
হাওর বিলাসী পাথরের ডাক।
বোয়ামের ভেতর স্বপ্নের কাপড় বোনে সুয়োরাণি।
কবর ফুলতে থাকে—কিছু নিঃসঙ্গ অন্ধকার।
প্রাচ্যগামী গির্জায় ঘণ্টা বাজে, নাগিনীর লেজে
কাটা অন্ধকার নিয়ে নাচতে থাক আগামী।
আমি মাঠেই আছি—
রেফারির লাল কার্ডপাওয়া একা ও একাকী গোলপোস্ট।
ঘুড়ির খোয়াবনামা
পাখির ডানায় আটকে যাওয়া ঘুড়ি; ক্রমশ তার দিকে এগিয়ে আসে নির্জন।
মৌন তোমাকে ভাঙে,
শব্দ ভাঙে এবং আমাদের নিয়ে আসেন গভীর জলের কাছে।
আমরা পান করি মৃত্যু, আমরা পান করি জীবন…
মূলত আমরা পরস্পরের চোখে আয়না দেখি,
আয়নায় বাসযোগ্য পৃথিবী আর জলের প্রার্থনা।
সন্নিহিত হোক সকাল
যে ফেরেস্তা সেজদা করেনি তার ছায়া আমাদের গোড়ালির কাছেই জীবন্ত।
হেশোঁতে শান দেওয়া প্রেতাত্মার নখ নির্দয় আঁচড় কাটে জানালায়।
ভেঙে যায় স্টেনড গ্লাস, মানবিক কাহিনিচিত্র।
কিছু বুঝে ওঠার আগে ঈশ্বরও ভেঙে যান এবং
আমার ভেতর মুখ থুবড়ে পড়ে যাই আমি।
আমার কোনো প্রার্থনা নেই—
জানি, ছায়া যতই দীর্ঘ হোক কেবল সন্ধ্যা নয় সন্নিহিত হতে পারে সকাল।
প্রার্থনা
ক্রমাগত ভাঙতে থাকে অন্ধকার, কুকুরের কান্না ও কষ্ট।
মেকি মানুষের হৃদয় জেগে উঠলেই পাথর।
বারো আদিত্য আর এগারো রুদ্রের হিসাব মেলে না,
দ্বীপ্রহরে কেঁদে ওঠে শ্মশানচারী মন।
আমি সুখ চাই না, হৃদয়ে বিছিয়েছি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল।
তবু—দ্রৌপদী আর বোটাখসা ফলের মাঝখানে অন্য অসুখ।
আমার ক্ষুধা মেটে না, না তৃষ্ণা।
তুমি স্পর্শ কর নাভিমুল, আমি সূর্যকে একটা বৃক্ষ হতে দেখি।
পেরেকে গাঁথা দীর্ঘশ্বাস ও পরিত্যক্ত হাতুড়ি
মরণ চিৎকার ভেদ করে যন্ত্রণাগুলো গড়াতে গড়াতে পাথর,
চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে হতে পাথরগুলো পাখি; যার দুই ডানায়
তোমার বিপুল আকাশ।
নৈঃশব্দ্য ছাপিয়ে আসবাবগুলোর নিঃশ্বাস আমি টের পাই;
অথচ—একটা পেরেক আমি পার হতে পারি না।
কবেই দেওয়ালে গেঁথে দিয়ে গেছো দীর্ঘশ্বাস,
সেই থেকে তোমার পরিত্যক্ত হাতুড়ি ঘুরছে ঘরময়।
আর হাতুড়ির ভেতর ঘুরছে পৃথিবী।