বধ্যভূমি
একটা গভীর ঘুমে কালরাত ঘুমের ভেতরে
প্রসন্ন আলোর দ্বীপে খুব একা আমি জেগি ওঠি;
এটা কোনো স্বপ্ন নয়—বাস্তবের নির্মম কথন:
পাল তোলা পৌরাণিক একটা জাহাজে চড়ে আমি
ভাসতে ভাসতে যেখানে নোঙ্গর ফেলে তীরে এসে নামি
সেখানে হঠাৎ দেখি কী রক্তাক্ত অস্ত্রের অক্ষরে
পশুশক্তি লিখে গেছে আমাদের বিজয়-এলিজি!
আমার বাবার মাংস শকুনে খেয়েছে; কিছু বুনো
শিয়াল কুকুর শুধু ঝগড়া করে হাড়-গোড় নিয়ে,
অদূরে ছড়িয়ে আছে রাশি রাশি খুলি ও কঙ্কাল;
একটা খুলির মধ্যে দেখি আমার মায়ের মুখ—
আহারে কিশোরী বউ! ডোরাকাটা তাঁতের শাড়িতে
কী নিপুণ হাতে লাল সবুজের মিলন ঘটিয়ে
স্বাধীনতা শব্দটিকে তার দেহে জড়িয়ে রেখেছে!
দুই.
নরজন্তু হায়েনারা যে-বোনের ইজ্জত লুটেছে,
তার মৃত দেহ বুকে একটা বিস্মৃত বধ্যভূমি
কতকাল ধরে আমার পায়ের নিচে পড়ে আছে!
বিত্তের সাগরে ভাসে সারাক্ষণ স্বার্থের জাহাজ;
যখন যেখানে হাঁটি পিছে হাঁটে খাস চাটুকার;
খেয়ালে আসে না আর কিংবা ভুলে কখনও ভাবি না
অই বধ্যভূমি ছাড়া বাংলাদেশ কী নিয়ে দাঁড়াবে?
নিজের পকেটে ভরে নিতে সুযোগের শেষ কড়ি
দেশের পকেট কাটতে যেখান সবাই থাকে মগ্ন,
সেখানে কী করে বলো, মানবিক সুন্দর দেশের
তালিকায় উঠে আসবে রক্তে পাওয়া আমার এ দেশ!
আমার নিজেকে খুব অপরাধী বলে মনে হয়;
ঘুমের ভেতরে অন্য এক ঘুম ভেঙে যায়: আমি
পায়ের নিচের বধ্যভূমিটাকে বুকে তুলে রাখি।
যে তুমি আমার নও
কিছুক্ষণ আগে বাংলামোটরে
একটা আকাশ কিনতে
আমি যাই বাতিঘরে;
আকাশের মানে
একজন প্রবীণ কবির
সারাজীবনের মূল জমি-জমা: কবিতা সংগ্রহ
কবি শম্ভুনাথ, চ্যাটার্জী মশাই!
আপনাকে নমস্কার।
বাতিঘর চেরাগীপাহাড়ে জন্ম নেয়
আমার শহর চট্টগ্রামে; ওখান থেকেই শুরু হয়ে
এখন সমগ্র দেশে
আলো বিক্রিয়ক;
বাতিঘর! তোমাকে সালাম।
বনের যে অন্ধকার তাকে তাড়াতেই নাকি
বন কেটে বিদ্যুতের খুঁটি গাড়া হয় সারি সারি
আর মনের যে অন্ধকার তার মূলোচ্ছেদ করতে
বাতিঘর আলো নিয়ে বসে আছে
বাণিজ্যেই নাকি বাস মা লক্ষ্মীর!
ক্ষতি নেই যে যেভাবে বাঁচতে চায় বাঁচুক
হাসতে চায় হাসুক
আমি কোনওদিকে তাকাবো না
সময়টা বড়ই পিচ্ছিল
বাতিঘর থেকে বের হয়ে
আকাশটা ঝুলিয়ে কাঁধে
আমি দাঁড়ালাম মেঘের উঠোনে
খরামগ্ন আকাশের পেটের ভিতর
এত জল বৃষ্টির খোঁপায়!
বিদ্যুৎ আপন রূপে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে
বাড়ি যাবো বাড়ি কই
পথ ভুলে আমি উড়ছি শূন্যতায়
চোখ খুলে দেখি:
আসলে আকাশ বলে কিছু নেই
সব টুকু
যে তুমি আমার নও তাকে নিয়ে
কবির কল্পনা।
চৈত্রে যখন বৃষ্টি ঝরে
আলো মুখে তার যাত্রা;
গোল চাকতির অর্ধাংশে ঘুরতে ঘুরতে
দিবসের শেষ হাসি
চোখের নিমিষে
মহাশূন্যতার গহন অতলে
কী নিঃশব্দে নেমে যায়!
এমন অপূর্ব সন্ধ্যা যেন
বুকে নিয়ে বহে যায়
আমাদের নদীগুলো।
আকাশের ছায়া থেকে
তারপর
নিবিড় রাত্রির
আঁচল জড়িয়ে গায়ে
হাওয়ার ডানায় চড়ে
বৃষ্টি নামে;
সীমাহীন দিগন্তের বাঁকে
অগুণিত শান্তির বেলুন ওড়ে
প্রতিটি বেলুন থেকে বের হলো
জোড়া জোড়া শাদা কবুতর
ওঁম শান্তি ওঁম শান্তি
খরাদগ্ধ
জরাক্লান্ত
হিংসায় আক্রান্ত
পৃথিবীতে
অবিরল প্রশান্তির
বৃষ্টি ঝরে, বৃষ্টি…