মেরুদণ্ডহীন সাইরেনগুলো
আগুনের প্রতি ভয় আমার কোনোকালেই ছিল না।
বসন্ত কাকাকে যেদিন ওরা ধরে নিয়ে গেলো,
যেদিন ধর্ষণের দাগ নিয়ে আগুনে
ঝাঁপ দিল শিলা ভট্টাচার্য
আমি সেদিন থেকেই আগুনকে ঘৃণা করতে শিখেছি।
শিলা, আমার সহোদরা,
আমরা ছিলাম একই মায়ের সন্তান!
এখনো আমার চারপাশে আগুন দেখলে
হেসে উঠি। এখনো আমার ডান দিক দিয়ে
নৃপেন্দ্র দা হেঁটে গেলে আমি তার কথা বোঝার
চেষ্টা করি। যদিও একাত্তর থেকেই লোকে
. তাকে বলে পাগল।
প্রায় প্রতিমাসে মেরুদণ্ডহীন সাইরেন বাজিয়ে
এই যে দমকল বাহিনী বিভিন্ন এলাকায় ছুটে যায়,
তা দেখে এখন আমি আর কাঁদি না।
সালটা একাত্তর নয়। তবু এখনো পোড়ে যায়
জেলেপল্লীর নিরীহ মানুষদের ঘরবাড়ি।
এখনো সেই হায়েনারা লুট করে নেয়
বিধবা চন্দনারাণী দাসের আঁচলে জমানো
. কয়েকটি খুচরো টাকা।
রায়ট ও রক্তজবা
মানুষ হারিয়ে যায় না, মানুষ ফিরে আসে,
বলতে বলতে দেবেন্দ্রকে যেদিন আমি
বাসে তুলে দিয়েছিলাম, সেদিন
বাংলায় কোনো রায়ট ছিল না!
তবু বৃদ্ধা মাকে সাথে নিয়ে দেশ ছেড়েছিল
দেবেন্দ্র নাথ, প্রিয় বন্ধু আমার!
তার পিতাকে হত্যা করার পর
দাহ করতে না দিয়ে যারা ভাসিয়ে দিয়েছিল
সুরমা গাঙে,
. তারাও দেখেছিল
সেই নদীর জল সেদিন নীল হয়ে গিয়েছিল
বেদনায়। আর মাসীমা দেবেন্দ্রকে বলেছিলেন
এই দেশ আমাদের নয়, বাবা!
আমি সেদিন কিছুই করতে পারিনি।
আজও পারি না!
কুমিল্লায়, সিলেটে কিংবা রংপুরের পীরগঞ্জে
যারা বসে থাকেন পোড়া ভিটের ওপর,
যারা হাঁক দিয়ে বলতে পারেন না
এই দেশ আমারও
আমি তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি না।
আমার হাত কাঁপে, পা কাঁপে, গলা কাঁপে
আমার হাত থেকে বারবার আছড়ে পড়ে যায়
একাত্তরের বধ্যভূমি থেকে তুলে আনা
কয়েকটি মুর্ছিত রক্তজবা।
ফুলের বদলে বারুদ
ফুলের বদলে বারুদ ফোটে থাকছে কাবুলে,
যারা কাবুলিওয়ালা সেজে সওদা ফেরি করতো
দেশে দেশে; তারা এখন আলখেল্লার আড়ালে
নিজেদের ছায়া লুকিয়ে বিক্রি করছে লাশ আর কবর!
নারীরা পালাতে চাইছে।
শিশুরা পালাতে চাইছে।
বৃদ্ধরা ব্রীজের খুঁটির সাথে আত্মাহুতির দড়ি বেধে
পালাতে চাইছে পৃথিবী থেকে। আর কালো বন্দুকের
নল তাক করে একদল শাসক বলছে;
. আমরাই ধর্মীয় বিধানের ত্রাতা!
যারা বিশ্বের অন্যপ্রান্ত থেকে বাহবা দিচ্ছে,
তারাও জানে এমন আদিমকাল পৃথিবী
অতিক্রম করেছে অনেক আগে! তারপরও
ধর্মীয় অনুশাসনের দোহাই দিয়ে গলা মেলাচ্ছে
. একগুচ্ছ কচ্ছপের দল!
এখানে মানুষ জাগবে না আর।
এখানে পাখিরা গাইবে না আর।
এখানে শিল্পী আঁকবে না আর।
বলতে বলতে যে পথিক পাথরে মাথা কুটছেন
তার সন্তানেরা জানে,
তাদের মাতামহীও একদিন প্রাণ দিয়েছিলেন
এমন শাসকদের ছোড়া পাথরের আঘাতে।