মৃত্যুসংবাদ
খবর পেলাম, লোকটা মারা গেছে।
লোকটাকে চিনতাম, খুব ঘনিষ্ঠ না হলেও মোটামুটি পরিচয় ছিল
মাঝে মাঝে দেখা-টেখা হতো
এমনকী গতকালও দেখেছি রাস্তায় দূর থেকে
সময় ছিল না, তাই কথা বলতে পারিনি
হতে পারে সেও দেখেছিল আমাকে
এবং আমার মতো তারও ব্যস্ততা ছিল
কথা বলেনি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে
কাল আমাদের কথা হলে ভাল হতো
তাহলে একজন মৃত্যুপথযাত্রী
(যদিও মরবে এমন লক্ষণ কিছু
তার মধ্যে ছিল না—দিব্যি সুস্থ সবল নিরোগ;
তবে আজকাল তো মৃত্যুর দীঘ-পাশ নেই, হুট করে
হৃৎক্রিয়া বন্ধ হলেই হলো—কিংবা বাস-ট্রাকের নিচে..)
মানুষের পরিচিত ভাব-ভঙ্গি
কথাবার্তার ঢঙ পাল্টে যায় কিনা, বোঝা যেতো।
মানুষের মৃত্যু নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই
বরং কিছুটা ভীতি আছে, কোনো মৃতের বাড়িতে
পারতপক্ষে যাই না আমি; শোকের গন্ধে
নিজেকেও কেমন মৃত মৃত মনে হয়, বাতাস ভারী লাগে
কান্না আর দীর্ঘশ্বাসের শব্দে…এবং মৃতের মুখ দেখে
সত্যি বলতে কী, জীবন-টীবন এসব
অর্থহীন মনে হয়, মনে হয়
আমার মুখও এমন শাদাটে হয়ে যাবে মারা গেলে
অথচ আয়নায় আমার মুখের প্রেমে আমি
মুগ্ধ হয়ে আছি আজীবন।
লোকটার চেহারা টেহারা
খুব একটা আহামরি ছিল না, অন্তত আমার চোখে
কোনোদিন তার দিকে ভাল করে তাকাইনি, যদিও
ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুখোমুখি বসে তার সাথে
নানা বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করেছি।
তার মৃত্যু সংবাদ শুনেও তার বাড়িতে যাইনি আমি
জানি না, কেন যে কেবল একটা দৃশ্য চোখের সামনে ভেসেছে
…লোকটা চিৎ হয়ে পড়ে আছে, তার মুখ খোলা আর
মুখের ভেতর একটা মাছি খুব ব্যস্তভাবে ঢুকছে আর বেরুচ্ছে
এবং কে যেন কেবল আমাকে তাড়া দিচ্ছে
আহ, মাছিটা তাড়িয়ে দাও না…হাঁ করে দেখছ কী?
কিন্তু আমি যে মৃতের মুখে তাকাতে পারি না!
লোকটার মৃত মুখ আমি দেখতে পারি না;
এ শহরে আসার পর থেকেই তাকে দেখে এসেছি…একই রকম
একটা ঢোলা প্যান্ট, পাঞ্জাবি পরা ছিপছিপে পাতলা লোক
পায়ে আধ পুরনো চামড়ার স্যান্ডেল, ধুলোপড়া; মাঝে মধ্যে
পালিশ খেয়ে ঝিকিয়ে উঠতো কিছুক্ষণের জন্যে (ঠিক তার মুখের মতো
কাব্যালোচনার সময় তার মুখও পালিশ খাওয়া জুতোর মতো ঝিকিয়ে উঠতো
অথবা নতুন কোনো কবিতা লেখার পর); এটা ঠিক, তার কবিতার হাত
মোটামুটি খারাপ ছিল না।
তবে অত্যন্ত সাধারণ, আকৃষ্ট করার মতো বৈশিষ্ট্যবিহীন একটা লোক।
মাঝে মাঝে মনে হতো, লোকটা যেন অনাহূত
কবিতার অভিজাত অঙ্গনে তার উপস্থিতি নিতান্তই বেমানান, এবং
এ ধরনের লোকেরা কবি হয়ে কবিতার অমর্যাদা বাড়াচ্ছে।
একদিন তাই এক সাহিতের আসরে তর্কযুদ্ধে ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলাম,
কবিতা যতই ভালো লিখুন, আপনাকে কবি বলে মনেই হয় না
বড় জোর কবিয়াল! বলে আমি হেসেছিলাম, অমায়িক হাসি।
আর কী আশ্চর্য! সেও হেসেছিল ওরকম।
তবে আমার হাসিতে বিদ্রূপ ছিল, তার ছিল কি না
সে মুহূর্তে বুঝতে পারিনি।
তবে যা-ই হোক, আমি সেদিন সত্যি কথাই বলেছিলাম।
লোকটা অতি সাধারণ, আকৃষ্ট করার মতো কিছুই ছিল না তার।
তার চেহারা কখনো ভালো লাগেনি, মৃতমুখ আরও খারাপ লাগতো।
মানুষ মরলে তার চেহারা পাল্টে যায়।
আমি আয়নায় আমার প্রেমে মুগ্ধ আজীবন।
একটি ছোট্ট শুভ্র ফুল
সারারাত জেগে একটা শুভ্র সুন্দর ফুলের কথা ভাবুন
তারপর ভোরের বাতাসে বেরিয়ে পড়ুন
দেখবেন পুবের আকাশ কী নিবিষ্ট, রঙিন
আর সূর্য ওঠার আগে কী মাহেন্দ্রক্ষণ!
শুভ্র স্বচ্ছ ফুলটাকে ভাবুন বিনম্র পবিত্রতায়
পৃথিবীর সব সৌন্দর্য আরোপ করুন তার প্রতিটি পাপড়িতে
একদম মাঝখানের ছোট্ট কোমল অংশটাকে দেখুন অসূর্যস্পৃশ্যতায়
ভাবুন অবিরাম ঘূর্ণমান পৃথিবী চাঁদ সূর্য গ্রহ নক্ষত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে
শক্তির পরম অপরিমেয়তা;
চোখ তুলুন মহাশূন্যে পরম পরিপূর্ণতার দৃশ্যকল্পে
দেখুন শুভ্র স্বচ্ছ কোমল ছোট্ট ফুলটা কতটা পরিব্যাপ্ত।
একটা ছোট্ট শুভ্র ফুল যদি আপনার রেটিনায় প্রতিফলিত হয়ে
মনের ভেতর বিশাল ছায়াপথ হয়ে যেতে পারে
তাহলে আলোকবর্ষও খুব সামান্য দূরত্ব;
কোটি কোটি আলোকবর্ষও নিমেষে পেরোতে পারে
আপনার আলোর চেয়েও দ্রুতগামী মন।
শুধু আপনাকে জাগতে হবে একটা রাত্রি
কল্পনায় একটি ছোট্ট শুভ্র ফুলের দৃশ্যমানতায়
জানবেন, অবশেষে চিন্তার শুভ্রতার চেয়ে বড় কোনো শক্তি
পৃথিবীতে নেই।
আবারও মৃত্যু হলো আমার
দেখ, এই ভালবাসা ভালোবাসা খেলা আর ভালো লাগে না
কেমন পানসে মেরে গেছে
তোমার স্বতন্ত্র কোনো সত্তা নেই, আমিও কেমন তুমি ছাড়া কিছু বুঝি না
চলো, একদিন দুজনে বলে উঠি, ধুৎ! ভালো লাগে না!
তারপর খুব ঝগড়া লাগাই, প্রচণ্ড ঘৃণায়
মুখিয়ে উঠি, শুরু করি ঘৃণার সঙ্গে বসবাস।
ভালোবেসে কী লাভ বলো? ভালবাসা মানে হলো রিরংসা
ভ্রাতৃঘাতী প্রণোদনা, কাবিলের পাথর-অস্ত্রে আকলিমার
ছিন্নভিন্ন লজ্জা আর হাবিলের রক্তে মৃত্তিকার
প্রথম তৃষ্ণামোচন, মানব শর্রীরে প্রথম ক্ষুণ্নিবৃত্তির উদ্বোধন।
ভালোবাসা ঘৃণার কোমল রূপ, একবার টোকা দিয়ে দেখ…
কঠিন ঘৃণার ধোঁয়ায় কত লক্ষ হলোকাস্ট
হিটলারের ডায়রিতে অজস্র অট্টহাসি। তার খবর রাখেনি।
এই সূর্যদহন আর চন্দ্রমোহন জীবন
মানুষের, হাত বাড়ালেই শস্যকণা, তারার ফুল
জীবন কাটছে এক হতচেতনার মাঝে
বাড়ানো না বাড়ানোর সংকোচে
বহুদিন কেটে গেরো, তারপর একদিন তারার ফুল
পেতে চেয়ে হাত বাড়ালাম
শস্যকণার গন্ধবিহীন হাত
তারার ফুল তার ঠাঁই খুঁজে পেলো না।
পাখিদের শোকসভায় হাতহীন মানুষের প্রসঙ্গ আসে না
তাদের সংগীতেও হাতহীন মানুষের সুর থাকে না
মারা গেলাম। আবারও মৃত্যু হলো আমার।
কখনো কি বেঁচেছিলাম? কোনোদিন?
বাতাস স্তব্ধ বনভূমি নির্বাক
ধরো, তুমি আর আমি এক নির্জন দ্বীপে
তুমি জান না তুমি কোত্থেকে এসেছ
আমিও জানি না, আমি কোত্থেকে…
একদিন তুমি সবুজ পাতার আড়াল থেকে মুখ বাড়ালে
আমিও বাড়ালাম আরেক সবুজ পাতা সরিয়ে
আমাদের দেখা হলো…
গাছে পাখি ডাকছিল, থেমে গেল
ভোমরা উড়ছিল ফুলের কাছ ঘেষে
থমকে গেলো
আকাশের রোদ জোছনার মতো কোমল
চারদিকের সমুদ্র গর্জন থামিয়ে মহাকালের মতো নীরব
আমি বললাম, কে তুমি
তুমি দ্বিধায় ভুগতে ভুগতে বললে, কে!
বাতাস স্তব্ধ
বনভূমি নির্বাক
ওরা জানে না এরপর কী হবে…
কারণ প্রকৃতির সবচেয়ে বড় বিস্ময়
দু’জন মানুষ
মানব মানবী
মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে তার চেয়ে বড় বিস্ময় নিয়ে।
আরও পড়ুন: প্রতিটি শব্দ প্রতিটি নিশ্বাস ॥ রকিবুল হাসান