ভূমিকা: সালমা আক্তার
এলিজি বা শোক কবিতা মন্ময় কবিতার এক প্রাচীন ও বিশিষ্ট রূপ। বন্ধু, আত্মীয় বা অতি নিকটজনের বিয়োগব্যথাকে উপলক্ষ করে কবির ব্যক্তিগত শোক ভাবনার প্রকাশকে এলিজি বলে। ‘এলিজি’ শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘Elegia’ থেকে। যার অর্থ ‘বেদনায় আকুলতা’। কিন্তু বর্তমান সময়ে প্রচলিত অর্থে ‘শোকপ্রকাশক কবিতা’।
১৬৩৭ সালে মিল্টনের ‘Lycidas’ থেকেই মূলত শোক কবিতার শুরু। বাংলা সাহিত্যেও বেশকিছু এলিজি বা শোকপ্রকাশক কবিতা রয়েছে। যেমন: হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ে ‘চিন্তা তরঙ্গিনী’, বিহারীলাল চক্রবর্তীর ‘বন্ধুবিয়োগ’, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘কবর-ই-নূরজাহান’, অক্ষয়কুমার বড়ালের ‘এষা’ বনফুলের ‘পরিমল গোস্বামী’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত’, নবীনচন্দ্র সেনের ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত’ ইত্যাদি।
বতর্মান সময়ের কবিদের মাঝে আসাদ মান্নানও এলিজি রচনার ক্ষেত্রে অনন্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি এর আগেও এলিজি লিখেছেন। তার ‘এলিজি মুজিব নামে’ শীর্ষক কবিতায় বঙ্গবন্ধুর চিরায়ত উপস্থিতির অনুভূতিকে সচেতনভাবে শব্দের ব্যঞ্জনায় প্রসারিত করে। বইটিতে ২১টি কবিতার সংকলন রয়েছে। এটি এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে।
সম্প্রতি কবির অগ্রজের প্রয়াণে ‘মরে গেলে মানুষের স্বজন থাকে না’ নামে একটি এলিজি লিখেছেন। এ কবিতায় ৯টি স্তবক ও প্রতিটি স্তবকে ১৪টি করে মোট ১২৬টি পঙ্ক্তি রয়েছে। সেখানেও শোকে মূহ্যমান কবিহৃদয়ের করুণ আর্তনাদের চিত্র ধ্বনিত হয়েছে। প্রিয়জনকে হারানোর শোকে কখনো বিলাপ করেছেন, কখনো বা স্মৃতির অতলে ডুব দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমার চোখের জলে নরকের অগ্নি নিভে যায়।’
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস ব্যক্তি, সমাজ ও অর্থনৈতিক জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিচ্ছে আমাদের অসংখ্য প্রিয়জন। চারিদিকে শোকের আবহ ও নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আতঙ্ককে চিরসঙ্গী করে মানুষও যেন প্রতিনিয়ত মৃত্যুর প্রতীক্ষায় দিন গুনছে।
কবিতার প্রথম স্তবকে দেখতে পাই, কবি রূপক অর্থে এই করোনাকেই ‘অদৃশ্য খুনি’ এবং ‘ক্ল্যাসিক জল্লাদ’ বলেছেন। আমাদের চারপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। চলছে তারই রাজত্ব, যেন মানুষের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করার সর্বৈব ক্ষমতা এবং আধিপত্য শুধু তার হাতেই নিয়োজিত। কবির মনে হচ্ছে, মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে এ ব্যাধি দুয়ারে দাঁড়িয়ে থেকে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। হোসে সারামাগোর মহামারি নিয়ে লেখা কালজয়ী উপন্যাস ‘ব্লাইন্ডনেস’-এর মতোই অন্ধ হয়ে যাওয়া মানুষের মতো করোনা এক দেহ থেকে আরেক দেহে ছড়িয়ে পড়ছে। শহর থেকে গ্রাম-গঞ্জে সব জায়গাতেই যুদ্ধের রব উঠেছে। এ যুদ্ধ এক অদৃশ্য ভয়ঙ্কর শক্তির বিরুদ্ধে। নিজেকে বাঁচিয়ে অন্যকে বাঁচানোর লড়াইয়ে আজ ব্যস্ত সবাই। কবি সবাইকে দূরে থেকে, ঘরে থেকে মাঝে মাঝে জানালার পর্দা তুলে আকাশের নক্ষত্রবীথির পাশে স্বপ্নের কফিনের দিকে তাকাতে বলেছেন। কবির উচ্চারণ:
ঘরে থাকো দূরে থাকো একা থেকে একা হয়ে যাও;
জানালার পর্দা তুলে মাঝেমধ্যে তাকাও আকাশে-
ওখানে নক্ষত্রবীথি তার পাশে স্বপ্নের কফিন।
করোনা নামক জল্লাদের ছোবলেই তিনি বড় ভাইকে হারিয়েছেন। সে বেদনা বর্ণনায় প্রথম স্তবকে উচ্চকিত হয়েছে এক আবেগঘন সংকটময় পরিস্থিতির। দ্বিতীয় স্তবকে তিনি প্রাণঘাতী এই ভয়ঙ্কর হিংস্র ভাইরাসের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার মূল শক্তির কথা বলেছেন।
চীনের উহান থেকে সৃষ্ট এ ভাইরাসের স্থায়িত্ব যেন আমাদের সময়হীনতার রাজ্যে ছুড়ে ফেলেছে। বাতাসেও অক্সিজেন-স্বল্পতা বিরাজ করছে। প্রতিনিয়ত করোনা আক্রান্ত ধনী বা নির্ধন ব্যক্তি সেই অক্সিজেনের স্বল্পতায় শ্বাসকষ্টের যন্ত্রণায় মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। আবার করোনায় আক্রান্ত রোগীকে নিয়ে তাদের স্বজনদের মাঝেও সৃষ্টি হয়েছে ঝগড়া। কবির ভাষায়, ‘হাসপাতালে রোগী নিয়ে ঝগড়া করে স্বজন-সেবিকা।’
তৃতীয় স্তবকে সময়ের শ্লথ গতিকে তিনি বলেন, ‘ঘড়ির ডায়ালে বসে স্থবিরতা বরফে ঘুমায়।’ মৃত্যুআতঙ্ক ও প্রিয়জন হারানোর ভয় কবিকে ঘুমাতে দেয় না। করোনাকে দুর্বিনীত করার লক্ষ্যে সরকারি নির্দেশে সবাই গৃহবন্দি থাকলেও কবি উদ্বেগে উৎকণ্ঠায় ভোরের ভেতরে খুঁজে চলেন করোনা থেকে মুক্তির উপায় বা অরোরার মতো আলোর ফোয়ারা।
দিন যত যায়, আশাহত হয়ে কবিও যেন মৃত্যুর প্রতীক্ষায় দিন গোনেন। করোনা বিস্তার রোধে সারা দেশ যখন প্রস্তুত, লকডাউন আরও কড়াকড়ি করা হলো, ঠিক তখনই কবি সহোদরের মৃত্যু সংবাদ পান। ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যুতে কবির জীবনে প্রচণ্ড শূন্যতা ও দুঃসহ বিষণ্নতা নেমে আসে। কবি ব্যক্তিজীবনে বড় ভাইকে হারানোর শোক কোনোমতেই মেনে নিতে পারছেন না। মা-বাবার মতো ভ্রাতৃবিয়োগেও তিনি পুরোপুরি ভেঙে পড়েন।
চতুর্থ স্তবকে কবিকে স্মৃতিচারণ করতে দেখা যায়। করুণ স্মৃতিতে কবি হৃদয় বেদনায় ভারাক্রান্ত। তিনি মায়ের কাছে শুনেছেন, বড় ভাই মছু কলেরা মহামারিতে মারা যান। কলেরায় মৃত্যু হওয়ায় অন্য কেউ এগিয়ে না এলেও তার ভাইয়ের মরদেহ সমাধিস্থ করেন প্রিয় জেঠামণি আতর আলী হাজি। এছাড়া দাদা কালামিয়া মালাদার তার জন্মের বহু পূর্বে সাপের কামড়ে মারা যান। মামা ওলা বিবির আক্রমণে সপরিবারে পরোলোক গমন করেন। তাই কবি নিজেকে দুর্ভাগা বলেছেন। তার জীবনে ঘটে যাওয়া পারিবারিক কোনো দুর্ঘটনা যেন আর কারও জীবনে না ঘটে, সে প্রার্থনাও করেন।
এমন দুর্ভাগ্য যেন আর কারো জীবনে না-ঘটে,
যেমন শিকার আমি দুর্বিষহ দৈব অভিশাপে।
পঞ্চম স্তবকে তিনি পুনরায় বড় ভাইয়ের প্রসঙ্গে চলে আসেন। করোনা দুর্যোগে তার ভাইকে কবর দেওয়া হয়েছে মায়ের পাশে। তিনি বিশ্বাস করেন তার ভাইকে ফেরেস্তারা পরম মর্যাদায় প্রকৃত গন্তব্য মানে তার মায়ের কোলে নিরাপদ শিশুর মতো ফিরিয়ে দেবে। তিনি ও তার বোন ভাইয়ের এই অন্তিমযাত্রায় অংশ নিতে পারেননি। শুধু দূর থেকেই অবিরত বিলাপ করেছেন। এই বিলাপ প্রকম্পিত হয়ে বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছে। বলেছেন,
দূর থেকে বিলাপ করেছি—
যে বুকে কোরান জ্বলে ওই বুক আগুনে কি পোড়ে?
আমার চোখের জলে নরকের অগ্নি নিভে যায়।
ষষ্ঠ স্তবকে তিনি নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। কৈশোর থেকেই তিনি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপন্ন দ্বীপবাসী মানুষের সেবা করেছেন, তাদের পাশে থেকেছেন। এমনকি ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের জলোচ্ছ্বাসে বঙ্গোপসাগর পাড়ে অগণিত লাশের মিছিলও দেখেছেন। দাফন কাফন ছাড়া অনেক প্রিয়জনকে নিখোঁজ থাকতেও দেখেছেন। শবাকীর্ণ সন্দ্বীপের উপদ্রুত দীর্ণ উপকূলে দাঁড়িয়ে তার বোধে ধরা দেয় দার্শনিক প্রত্যয়—
নদীর ওপারে আছে জীবনের শেষ চাওয়া-পাওয়া;
মরে গেলে মানুষের আর কোনো স্বজন থাকে না।
সপ্তম স্তবকে দেখতে পাই, জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে মানবিক কবি চেনা-অচেনা সবার পাশে থেকেছেন। সব ব্যথিতের ব্যথায়, সব অসহায়ের অশ্রুতে তিনি নিজেকে অনুভব করেছেন। ব্যথিতের অশ্রুর মুকুরে তিনি তার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছেন। তাই তাদের দুঃসময়েও অনেক লাশ দাফন করেছেন। অথচ আজ নিয়তির কাছে অসহায় কবি নিজের আপন ভাইয়ের জীবনের শেষ দৃশ্যে তার পাশে থাকতে পারেননি। এই বেদনাবোধ কবিকে মর্মাহত করে। সে বেদানাবোধ থেকেই কবি নিজের সমস্ত পুণ্য পর্যন্ত তাদের উৎসর্গ করে দিতে চেয়েছেন। বিশ্বাস আরও দৃঢ় করার জন্য কবি সৃষ্টিকর্তার কাছে আর্জি জানিয়েছেন:
আমার নগণ্য আর্জি পাঠালাম তোমার অফিসে;
কবুল না হলে দ্যাখো পুড়ে যাবে হিসাবের খাতা:
প্রজারা বিশ্বস্ত থাকলে রাজা নাকি নিরাপদ থাকে।
অষ্টম স্তবকে তিনি নিজেকে সামান্য বান্দা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। দ্বিধাহীন কণ্ঠে অকপটে স্বীকার করেছেন, তিনি সারাক্ষণ নিরাকার স্রষ্টার সেবা করেছেন তাও নয়, কিন্তু তিনি স্রষ্টাকে হৃদয়ে ধারণ করেছেন ঠিকই। একইসঙ্গে স্রষ্টার সমস্ত সৃষ্টিকর্মকেও (গোলাপের হাসি থেকে শুরু করে বাঘের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া হরিণীর প্রেমেও পড়েছেন) ভালোবেসেছেন। প্রিয়জন হারানোর দুঃখগাথাকে অনন্ত কাল ধরে বহমান নদীর ধারার সঙ্গে তুলনা করেছেন। সমস্ত চাওয়া-পাওয়াকে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে সঁপে দিয়ে শুধু তাকেই ভালোবেসেছেন। এ তীব্রতা প্রকাশ পেয়েছে তার কবিতায়:
আমি একা কিন্তু একা নই; আমার রক্তের মধ্যে
ধারণ করেছি আমি সমুদ্রের উত্তরাধিকার
নিখিলের ধ্যানচক্র, কুয়াশার সমূহ বিনাশ,
আমার মায়ের মতো ভালোবাসি গোলাপের হাসি
বাঘের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া হরিণীর প্রেম।
আমার ভেতর দিয়ে বহমান অনন্ত কালের
নদীর ধারাকে তুমি যদি অন্যদিকে, অন্যখানে
নিয়ে যেতে চাও, তবে নাও—আমার আপত্তি নেই
যা কিছু তোমার ইচ্ছে যখন তখন করতে পারো;
তোমার বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়াবার শক্তি আছে কার?
সুন্দরের আমি অন্ধ সেবাদাস—তোমার পূজারী।
নবম স্তবকে কবি শোককে অনন্তে সমর্পণ করেছেন। স্রষ্টার প্রতি কবির অগাধ আস্থা। স্রষ্টাকে পাওয়ার জন্য মুনি ঋষি গাউস কুতুব বুকে যে আগুন জ্বালে, প্রয়োজনে কবি তারই উত্তাপ কুড়াতে চান। কবি জানেন, একক ক্ষমতার মালিক একমাত্র তিনিই। স্রষ্টার কাছে কবির অভিযোগ যেন অবিরত কান্না হয়ে ঝরে পড়ছে। যন্ত্রণায় দগ্ধিভূত অসহায় কবি সংকটময় পৃথিবীতে মানুষের কল্যাণ কামনা করে শেষ অবধি স্রষ্টারই স্তুতি গেয়েছেন। তার মাঝেই নিজেকে সঁপে দিয়েছেন, ভরসা করেছেন। তিনি কোনো অলৌকিকতায় বিশ্বাসী নন। স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস থেকেই সমস্ত দুর্বীনিত জীবাণুর বিরুদ্ধে সমাপ্তির পর্দা টানতে বলেছেন। যেন তার ওপর থেকে মানুষের বিশ্বাস উঠে না যায়, সে কথাও ব্যক্ত করেছেন। সমস্ত পাপ মুছে পুণ্যের খাতা পূর্ণ করার আকুতি জানিয়েছেন। কবির অভিমানভরা কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে,
অনেক হয়েছে খেলা; ফাউলের শাস্তি লাল কার্ড
অনেক দেখালে প্রভু! আর কত—এবার থামাও,
আমাকে তোমার নামে যদি বলো শত কোটি বার
সেজদা দিতে তাও দেবো, শুধু বিশ্বব্যাপী চলমান
দুর্বীনিত জীবাণু যুদ্ধের সমাপ্তির পর্দা টানো;
না-টানলে বিনষ্ট হবে বিশ্বাসের বেহেস্তি আঙুর।
করোনার দুঃসময়ে যারা আজ প্রয়াত হয়েছে
তাদের হিসাবে যদি পাপ বলে কিছু লেখা থাকে
পাপটাকে মুছে দিয়ে নিজ গুণে পুণ্য লিখে দাও।
রূপক ও অলঙ্কার প্রয়োগের স্থলে কবির কাব্যদেহ প্রতীক ও চিত্রকল্পে সমৃদ্ধ। যেমন,
জানালার পর্দা তুলে মাঝেমধ্যে তাকাও আকাশে—
ওখানে নক্ষত্রবীথি তার পাশে স্বপ্নের কফিন।
..
ভোরের ভেতরে খুঁজি কত দূরে আলোর ফোয়ারা—
সমুদ্রে ঝড়ের আগে পাল তোলা নৌকা বেয়ে যাবো!
…
প্রশান্তির দীর্ঘ ঘুমে মৌনতায় ঘুমোচ্ছেন দাদা
যেমন মায়ের কোলে শুয়ে আছে নিরাপদ শিশু;
কফিন চলেছে উড়ে—পিছে কত শত লোক যায়!
স্বজন হারানোর আর্তনাদ পাঠক হৃদয়কে ছুঁয়ে গেছে। শব্দের দ্যোতনায় বাঙময় কবির উল্লেখযোগ্য পঙ্ক্তিগুলো
সে এক অদৃশ্য খুনি, বলা যায় ক্লাসিক জল্লাদ;
…
ঘড়ির ডায়ালে বসে স্থবিরতা বরফে ঘুমায়,
…
কফিন চলেছে উড়ে—পিছে কত শত লোক যায়!
…
আমার চোখের জলে নরকের অগ্নি নিভে যায়।
…
মরে গেলে মানুষের আর কোনো স্বজন থাকে না।
…
জীবনের শেষ দৃশ্যে আমি নেই– এমন নিয়তি,
…
বুকে যে আগুন জ্বালে আমি তার উত্তাপ কুড়াই।
আসাদ মান্নান ‘মরে গেলে মানুষের স্বজন থাকে না’ এলিজিতে ব্যক্তিগত দুঃখকে করোনা মহামারির মধ্য দিয়ে সবার বেদনায় পরিণত করে কবিতার ইতি টেনেছেন। পৃথিবীর মানুষের মঙ্গল কামনায় তার বড় ভাইয়ের প্রয়াণ স্মরণীয় হয়ে উঠেছে। কবিতাটি পাঠে আমাদের হৃদয়ে এক তীব্র বেদনার সৃষ্টি হয়। আমরাও যেন গভীরভাবে হারিয়ে যাই কবির বিষণ্ন রিক্ত হৃদয়ে। তিনি এ কবিতার ক্ষেত্রে সংহত গম্ভীর কাব্যসৃষ্টির প্রচেষ্টায় ব্যাপৃত হননি। এ কবিতায় একাধারে বিয়োগব্যথা এবং বর্তমান সময়ের বাস্তবতার চিত্রের সমন্বয় সাধন হয়েছে। কবিতায় বিষয়ানুগ চিত্রকল্প, শব্দ ও ভাষা প্রয়োগে বিশেষ ব্যতিক্রম। একথা অনায়াসেই বলা যায়, এলিজিটি সবদিক দিয়েই সমুজ্জ্বল, ভাইয়ের মৃত্যু শোকে চিন্তায়, কবিসত্তায়, চৈতন্য ও ভাষাভাবনায় প্রতিভাদীপ্তির বিকশিত রূপ সত্যিই অভিনন্দনযোগ্য।
মরে গেলে মানুষের স্বজন থাকে না
[অগ্রজের প্রয়াণে একটি এলিজি]
সে এক অদৃশ্য খুনি, বলা যায় ক্ল্যাসিক জল্লাদ;
সর্বক্ষণ ঘুরতে থাকে যত্রতত্র এখানে ওখানে,
তার হাতে দেয়া আছে অন্য জীব কিংবা জন্তু নয়
কেবল কর্তৃত্ববাদী মানুষের মৃত্যু পরোয়ানা!
জলে স্থলে অন্তরীক্ষ্যে এ কেমন আতঙ্ক সন্ত্রাস!
মানুষের দেহ থেকে দেহে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে
মরণ জীবাণু ; নিজেকে নিজের মতো প্রতিরক্ষা
দিতে হবে: আগে নিজে বাঁচো পরে অন্যকে বাঁচাও—
এমন উদ্ভট যুদ্ধের কৌশল নিয়ে গ্রামে গঞ্জে
ঘরে বাইরে অফিসে ব্যারাকে সর্বত্র যুদ্ধের রব;
সড়কে পুলিশ আছে সঙ্গ ঘোরে সৈনিকের দল—
ঘরে থাকো দূরে থাকো একা থেকে একা হয়ে যাও;
জানালার পর্দা তুলে মাঝেমধ্যে তাকাও আকাশে—
ওখানে নক্ষত্রবীথি তার পাশে স্বপ্নের কফিন।
২.
মানুষবিনাশী এই ভয়ঙ্কর হিংস্র ভাইরাস
ইতোমধ্যে তার নিরঙ্কুশ ক্ষমতার মূল শক্তি
দেখিয়ে দিয়েছে; অনায়াসে বিজয়ী বীরের মতো
ঘটিয়ে চলেছে দ্রুত পৃথিবীর প্রায় সব দেশে
এ নতুন ওহান ভাইরাস; এক নামে পরিচিত—
বিশ্বমারী ঘাতক করোনা; দিন যায় মাস যায়—
সমূলে বিনাশ হবে এরকম লক্ষ্মণ দেখি না,
কখনো বাতাস থেকে অক্সিজেন হাওয়া হয়ে যায়।
কী করে করোনা জানে জীবনের প্রথম চাহিদা
অক্সিজেন নিতে যদি ব্যর্থ হয় মানব সন্তান
তবে যে নিঃশ্বাসহীন কবরেই দেহ চলে যাবে;
ইতোমধ্যে বহু লোক—ধনী বা নির্ধন নির্বিশেষে
করোনা পীড়িত হয়ে যমের দুয়ারে পৌঁছে গেছে—
হাসপাতালে রোগী নিয়ে ঝগড়া করে স্বজন-সেবিকা।
৩.
ঘড়ির ডায়ালে বসে স্থবিরতা বরফে ঘুমায়,
আমার আসে না ঘুম, গত রাতে ঘুমোতে পারিনি।
দুর্বিনীত করোনাকে বাগে আনতে সরকারি নির্দেশ
যখন ঘোষিত হয় তখন সবাই গৃহবন্দি
জীবনে জাবর কাটে; আমিও উদ্বেগে উৎকণ্ঠায়
ভোরের ভেতরে খুঁজি কত দূরে আলোর ফোয়ারা—
সমুদ্রে ঝড়ের আগে পাল তোলা নৌকা বেয়ে যাবো!
এক দূই তিন চার গুণতে গুণতে দিন গুনতে থাকি।
করোনা বিস্তার রোধে সারা দেশ যখন প্রস্তুত,
লকডাউনে টানা হলো বিধি আর নিষেধের বেড়ি
তখনই সংবাদ পাই সহোদর হাফেজ নুর-উস
ছফা নেই—আমাদের বাবার মতন কালেমায়ে
শাহাদাৎ পড়তে পড়তে মহান আল্লার ডাকে সব
মায়ার বন্ধন ছেড়ে চলে গেছে মা-বাবার কাছে
(ইন্নালিল্লাহে ওইন্নাইলাহে রাজেউন—নিশ্চয়ই তিনি
প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম করেন না—আমার দাদাকে
প্রতিশ্রুত জান্নাতে রাখবেন)।
৪.
এমন দুর্ভাগ্য যেন আর কারো জীবনে না-ঘটে,
যেমন শিকার আমি দুর্বিষহ দৈব অভিশাপে।
শুনেছি মায়ের কাছে—বহু বার কেঁদে কেঁদে তিনি
বলেছেন তাঁর জীবনের প্রথম শোকের কথা:
আমারও জন্মের বহু আগে ভীতিকর মহামারী
কলেরায় মায়ের নাড়ির ধন, প্রথম সন্তান;
মছু ভাই মারা যায়; সে-সময় একান্ত কাছের
স্বজনেরা ছাড়া আর অন্য কেউ পাশে তো ছিল না!
আমাদের জেঠামনি প্রয়াত আতর আলী হাজি
আরবি আতর মেখে গল্পে শোনা আমার না-দেখা
ভাইকে কবর দেন তাঁর বাবা অর্থাৎ আমার
দাদা কালামিয়া মালাদার, যিনি আমার জন্মের
বহু পূর্বে মারা যান সাপের কামড়ে, তার পাশে;
ওলা বিবি সবংশে শিকার করে আমার মামাকে।
৫.
এবার মায়ের পাশে ভাইটাকে শোয়ানো হয়েছে;
সবাই আছেন কাছে—ছেলে-মেয়ে, প্রিয় প্রতিবেশী—
সবার ওপরে তার বুকে গাঁথা কোরানের আলো,
খোদার ফেরেস্তা তাকে লাঠিহীন প্রকৃত গন্তব্যে
পরম মর্যাদা দিয়ে নিয়ে যাবে, আমার বিশ্বাস;
প্রশান্তির দীর্ঘ ঘুমে মৌনতায় ঘুমোচ্ছেন দাদা
যেমন মায়ের কোলে শুয়ে আছে নিরাপদ শিশু;
কফিন চলেছে উড়ে—পিছে কত শত লোক যায়!
শরীরে সৌরভ মেখে গৌরবের স্মৃতি চিহ্ন রেখে
খোদার অতিথি হয়ে চলে যাচ্ছে নূর-উস ছফা,
বুবু আর আমি শুধু তার ওই অন্তিম যাত্রায়
অংশ না- নিয়েই দূরে—দূর থেকে বিলাপ করেছি—
যে বুকে কোরান জ্বলে ওই বুক আগুনে কি পোড়ে?
আমার চোখের জলে নরকের অগ্নি নিভে যায়।
৬.
এ কেমন অক্ষমতা কেউ তার জবাব জানে না!
এত অসহায় আমি কোনোদিন নিজেকে ভাবিনি,
সুদূর কৈশোর থেকে ভালোবেসে আপন স্বভাবে
বিপন্ন মানুষ দেখলে সেবা নিয়ে আমি ছুটি গেছি ;
চোখে ভাসছে সত্তুরের সেই ঘূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ্বাস,
বঙ্গোপসাগর পাড়ে অগুনিত লাশের মিছিল—
দক্ষিণে কালির চরে কত কত লাওয়ারিশ লাশ
দাফন কাফন ছাড়া নিখোঁজ রয়েছে প্রিয় জন।
শবাকীর্ণ সন্দ্বীপের উপদ্রুত দীর্ণ উপকূলে
খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যাই অনাত্মীয় মৃতদের দেহ;
অদূরে শিয়াল কাঁদে—কুকুরের দারুণ উল্লাস;
দিগন্ত চৌচির করে এই সত্য উচ্চারিত হয়—
নদীর ওপারে আছে জীবনের শেষ চাওয়া-পাওয়া;
মরে গেলে মানুষের আর কোনো স্বজন থাকে না।
৭.
গোত্রমিত্র পরিজন লুপ্ত হয় সমাজকাতারে
সামাজিক দায় থেকে সবাই সবার পাশে থাকে,
প্রকৃত মানুষ হাত রাখে অচেনা মউতের মুখে
দুঃসময়ে এ হাতে অনেক লাশ দাফন করেছি
কবরে রেখেছি কত বিকৃত বিবস্ত্র নরনারী।
অথচ এমন এক দুঃসময়ে আপন ভাইয়ের
জীবনের শেষ দৃশ্যে আমি নেই—এমন নিয়তি,
কী আর করার আছে নিয়তির নিয়ম না-মেনে!
আমার হিসাবে প্রভু! যদি কিছু নেকি জমা থাকে
তা থেকে ভাইয়ের নামে কিছু আমি লিখে দিতে চাই,
বাকিটা মায়ের জন্য—সঙ্গে বাবা যৌথ দাবিদার;
আমার নগন্য আর্জি পাঠালাম তোমার অফিসে;
কবুল না হলে দ্যাখো পুড়ে যাবে হিসাবের খাতা:
প্রজারা বিশ্বস্ত থাকলে রাজা নাকি নিরাপদ থাকে।
৮.
আমি তো সামান্য বান্দা; সারাক্ষণ তোমার সেবায়
নিজেকে রেখেছি রত, এমন ভাবি না; তবে ঠিক
নিরাকার তোমাকে এমন রূপে ধারণ করেছি
আমি একা কিন্তু একা নই; আমার রক্তের মধ্যে
ধারণ করেছি আমি সমুদ্রের উত্তরাধিকার
নিখিলের ধ্যানচক্র, কুয়াশার সমূহ বিনাশ,
আমার মায়ের মতো ভালোবাসি গোলাপের হাসি
বাঘের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া হরিণীর প্রেম।
আমার ভেতর দিয়ে বহমান অনন্ত কালের
নদীর ধারাকে তুমি যদি অন্যদিকে, অন্যখানে
নিয়ে যেতে চাও, তবে নাও—আমার আপত্তি নেই
যা কিছু তোমার ইচ্ছে যখন তখন করতে পারো;
তোমার বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়াবার শক্তি আছে কার?
সুন্দরের আমি অন্ধ সেবাদাস—তোমার পূজারী।
৯.
সমস্ত সৃষ্টির মূল শূন্যতার তুমি অধিশ্বর;
রাজা আসে রাজা যায় স্হায়ী শুধু তোমার আসন।
তোমাকে পাওয়ার জন্য মুনি ঋষি গাউস কুতুব
বুকে যে আগুন জ্বালে আমি তার উত্তাপ কুড়াই।
তুমি তাই ডিক্টেটর ক্ষমতার একক মালিক!
অনেক হয়েছে খেলা; ফাউলের শাস্তি লাল কার্ড
অনেক দেখালে প্রভু! আর কত—এবার থামাও,
আমাকে তোমার নামে যদি বলো শত কোটি বার
সেজদা দিতে তাও দেবো, শুধু বিশ্বব্যাপী চলমান
দুর্বীনিত জীবাণু যুদ্ধের সমাপ্তির পর্দা টানো;
না-টানলে বিনষ্ট হবে বিশ্বাসের বেহেস্তি আঙুর।
করোনার দুঃসময়ে যারা আজ প্রয়াত হয়েছে
তাদের হিসাবে যদি পাপ বলে কিছু লেখা থাকে
পাপটাকে মুছে দিয়ে নিজ গুণে পুণ্য লিখে দাও।
আরও পড়ুন:
সাম্প্রতিক সাহিত্য