বৃষ্টির শব্দ
বৃষ্টির শব্দে জেগে ওঠে পুরনো শহর,
পানসি হাওয়ায় দোল খাওয়া পালকের মতো
হারিয়ে যাওয়া মুখগুলো অবিরাম
থরথর করে কাঁপে; নিঃসঙ্গতার মুদ্রায়—
দিগন্ত ডুবে যায় নিবিড় অন্ধকারে।
বিগত জন্মের ঋণ—
কিংবা একটানা গল্পসূত্র
ক্রমাগত লীন হয়ে যায়
ক্ষয়িষ্ণু রাতের মায়ায়
অনাহূত খেঁকশিয়ালের চোখ
আরও কিছু মায়া বাড়ায়,
বাড়ায় আরও দুঃস্বপ্নের দিন।
পথ ভুলে একদিন যারা
নেমে এসেছিল আরশের গন্ধম হাতে
আতরের সৌরভ মাখা উর্দিখানা তারা
রেখে গিয়েছিল বিদ্বেষের কার্নিশে
ফলে বৈষম্যপিষ্ট রাতের অভিঘাতে
খসে যায় সহস্রযুগের চন্দ্র-তারা
ভেঙে যায় বিশুদ্ধ ফুলের সংসার
সাপের লেজের ভেতর থেকে
তৈরি হয়েছে যে রাস্তা
নদীর চেয়ে সুন্দরতম নারী
জলের চেয়ে কল্যাণকর পুরুষ
কিভাবে জন্ম নেবে সেখানে
কিভাবে পড়বে বাঁশির চেয়ে অধিকতর
স্নিগ্ধ হাসির রোল
আদমের কোমরের হাড়
হাওয়াকে বানিয়েছে নারী
অথচ এক টুকরো আঁচলের ভাঁজে
পৃথিবী লুকিয়ে রেখেছিলো সে
তারপরও এক খণ্ড হাড়ের সংগীত
শুনে শুনে থেমে যায় জোয়ার-ভাটা
ইবলিশ হতে পারেনি শুদ্ধতার প্রতীক
হাওয়া হতে পারেনি জগতের মালকিন।
দেয়ালের পেছনে যে দেয়াল থাকে
চর্মচক্ষু ছুঁতে পারে না সেখানকার ছায়া
মর্গে পড়ে থাকা দেহের ভেতরে
লুকিয়ে থাকে অসংখ্য মানুষের আর্তনাদ
কেউ শোনে না, কেউ দেখে না—
লাশ কিভাবে কাঁদে,
লাশ কতটা কাতর হয় শোকে।
ধর্মশালায় আটকে থাকলে সমূহ-বিবেক
কালো মেঘ এসে আলোর বয়ান শোনায়
পবিত্র আত্মা মুখ থুবড়ে পড়ে যায়
পৌর ভাগাড়ে কিংবা এসবই খালের
বিপন্ন জলের সিথানে; বিপ্লব কোনোদিন
বেড়ালের চোখ থেকে জন্ম নেয়নি—
বাঘের থাবা কিম্বা সিংহের গর্জন ছাড়া
শুদ্ধতম জীবন হয় না,
মুক্ত-স্বাধীন বাতাস বয় না।
অ্যারিসের রক্তাক্ত ঢাল ও ব্রোঞ্জের বর্শা
ভুবন-ভোলানো দেহসৌষ্ঠব
আটকাতে পারেনি ব্যর্থতার ইতিহাস
যেদিন হেফাস্তুসের লৌহজাল বন্দি করে
অ্যারিস এবং আফ্রোদিতির প্রমোদকলা
সেদিনও বৃক্ষের চোখ বেয়ে বেয়ে
রক্ত ঝরেছিল। কারণ—কিউপিডের জন্ম-প্রদীপ
নেভাতে পারেনি পৃথিবী।
ইটভাটার চিমনি চুঁইয়ে চুঁইয়ে
বের হয় নারীর শরীর, ধোঁয়ার আদতে
উড়ে যায় তেরশত নদী
পুড়তে পুড়তে মাটি হয়ে যায়
দেয়াল, মাথার ওপরের ছাদ—
রোদের সঙ্গে ক্ষিপ্ত হয়ে
রুখে দাঁড়ায় আকাশের বিরুদ্ধে
একদিন থেমে যায় সকল বিদ্রোহ
মুছে যায় সমস্ত গৌরব
মাটি তাকে জড়িয়ে নেয় ফের।
প্লায়োসিন থেকে হলোসিন যুগের
মধ্যমায় দাঁড়িয়ে কে কবে গেয়েছে
সত্য-ত্রেতা-দ্বাপর কিংবা কলিযুগের গান
লোমশ ম্যামথের শরীর থেকে যেদিন
ঝরে পড়েছে বরফকুচির শাদা শাদা দুঃখ
প্রথমবারের মতো মানবজাতির জন্ম হয় সেদিন
তারপর সবুজ ঘাসের আস্তরণে—
নির্বিকার পড়ে রয় এক একটা ফসিল।
রূপ-লাবণ্য নিষ্পাপ মেডুসার
কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল যেদিন; সেদিন—
দেবী অ্যাথেনা তাকে রক্ষা করেননি
লালসাকাতর পুরুষেরই হয় বিজয়
পার্সিয়াসের হাতে সঁপে দেওয়া মেডুসার
স্বর্পকেশী মাথা রক্তে রঞ্জিত হলেও—
এ যে ছিল পরম মুক্তি, ভীষণ স্বস্তি
রেহাই পেল পাথরযন্ত্রণার কলঙ্ক-অধ্যায়।
ওই যে উড্ডীন আকাশ, যার বুকে—
শতাব্দির আগুন জ্বলছে দাউ দাউ
একদিন সব দুঃখ মুছে দেয় সে
জলের প্রহারে ফসল জাগায়
রোদের উত্তাপে পাকায় বারোয়ারি ফল
তবু তার বিরুদ্ধে শতসহস্র অভিযোগ
নানান জাতের অপবাদ কাঁধে নিয়ে
শূন্যে ঝুলে থাকে সে অনন্তকাল।
বৃষ্টি যদি বিশুদ্ধ করে নগর
বৃষ্টি যদি নিভিয়ে দেয় আগুন
ফিরে পাবো আমরা হারানো একতারা
পথে-প্রান্তরে ফুটবে সিঁদুর-রঙা পালান
অ্যাক্রোবেটিক বৃষ্টি জাগিয়ে তোলে পুরনো নদী
নেচে ওঠে স্নিগ্ধ কদমের শরীর
শুধু থেমে যায় মানুষের কোলাহল
আলুর মতো পিঠ জাগিয়ে জেগে থাকে
এক একটা হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি!
আরও পড়ুন: দীর্ঘ কবিতার আয়োজন: দূরের যাত্রী