জীবনের দাগে
যখন দাঁড়ায় মন—গোধূলির কোলে
দিনশেষে স্নিগ্ধ জলে আমিও ধীবর;
জীবনের মর্মজ্বালা অচেনায় দোলে
ইচ্ছেগুলো জমে জমে অচেনা পাথর।
যখন কেবলি ছবি—পূর্ণতায় জাগে
নিগূঢ় সত্যের কাছে মোহনীয় রূপ;
কে তাকে সান্ত্বনা দেবে জীবনের দাগে
বিভ্রান্তি তবুও মানি অন্ধতায় চুপ!
বহুকাল অনর্থক—পথে পথে থামি
আঁধার পেরিয়ে পাই আঁধারের মমি
মিছিল ফেরত রাতে—বৈষম্য সড়ক
এভাবে নিদাঘ তোলে নিজস্ব নরক
ফিসফাস গল্পে চলে—জলের শাসন
ধ্বনিতেই মজে থাকে উচাটন মন!
পাতার ডায়েরি
অঘ্রাণের ভেজা মাঠে চিকন আলোয়
কিসের নিলাম ডাকে নিখিলের বোধ?
কার প্রিয় ওগো তুমি—মুগ্ধ প্রাণ এক
বিস্ময়-দরজা খুলে সীমাহীন ওড়ো!
পাতার অক্ষরে লেখা—এইসব ঋণ
মায়ার জলধি জুড়ে ফোটায় ফেনিল;
লিখেছে কে এ-যাতনা কলহ-রঙিন
বলো: কে ফেরায় ফের, ভবঘুরে দিন?
পায়ে পায়ে, যদি নাচে সময়ের মাছি
মধুকুপী দিন, শিশিরে ফোটাবো আমি
সূক্ষ্ম চেতনার হুল—অন্য কোনো ভোরে
তারপর; সয়ে যাবো—সুনীল প্রবোধ!
রাতভর ফোটে কেন—হতাশার ফুল
প্রেরণা গুঞ্জনে তার কে ভাঙায় ঘুম!
কোনো দৃশ্য মিথ্যে নয়
স্বপ্নের ভেতর; কোনও দৃশ্য মিথ্যে নয়—
কিন্তু, দৃশ্যাবলি সুষম না-হলে প্রণয় আটকে যেতে পারে
এমন প্রস্তাবে, শতাব্দী পুরনো আমি শিল্প ও ভূ-খণ্ডে;
পৃথিবীর পথে পথে যত ধুলো, মর্ম ও নিনাদ
চিরন্তন কল্লোল তার, বুঝে নিও—
সচিত্র প্রতিবেদন আঁকা আছে মৃত্যু ও বিষাদ;
যে কৌশল একপাশে সরিয়ে নিদ্রায় ডুবে গেছি
সেখানেও, ভালোবাসা ছিল নিরঙ্কুশ-
পরিত্রাণের অহমিকায় নিজেকে প্রজ্ঞাপিত করা;
হায় শকুনি! এভাবেই, ভালোবাসার অন্যপিঠে-
কৌরবের ধ্বংসই লিখেছো; নিজেকে মহিমান্বিত
করতে হয়ে উঠেছো, চিরস্থায়ী মিথের অক্ষর;
চুপচাপ শীতে
অরণ্য বললো ডেকে:
‘নদীতে ভাসিয়ে দাও—পৃথিবীর জরা’;
ঋতুর ভেতর দিয়ে যেতে যেতে সব মুখরতা
একদিন পৌঁছে যাবে চুপচাপ শীতে;
শুধু, এই ধুলোর শহরে; অনন্ত জিজ্ঞাসা—
সুললিত কণ্ঠে কে পাঠায় স্বেচ্ছামৃত্যুর ডাক?
যাপনের সংঘাতে আমার দ্বিধা নেই;
রঙিন স্বপ্নসমূহ একপাশে রেখে নির্জনের পথে
হেঁটে যেতেও নেই আড়ষ্ঠতা; যখন—
সমস্ত প্রহ্লাদ, ব্যক্তিস্বার্থ, ভাগ হয় গভীর প্রজ্ঞায়!
দেখো, নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছি ব্যক্তিগত খরা
বিরান প্রান্তরে ঘর; উঁচু-নিচু, স্বপ্নহীন সব সংস্কার;
ভাঙা সাম্রাজ্য, স্মৃতিগুলো কৌমসুখে আছে বেশ
বিস্ময় নেই, অবশিষ্ট নেই কোনো হাহাকার;
তবুও এই চুপচাপ শীতে—
কোন্ দৃশ্যে প্রশ্নশীল—ওহে ধীরতমা!
রাত্রিনামা
অনুপম সেই সন্ধ্যা, ওরা ভেবেছিল—অন্ধ আমি; তাদের চৌকষদল আমার গোত্র খুঁজে পায়নি। নামকরণেও ব্যর্থ হয়েছিল রাজপুরোহিত, আর, তাদের পাশে দাঁড়িয়েও নির্বিকার আমি, শুনছি—দূরে কোথাও ঘোষিত হচ্ছে তুমুল রাত্রিকথা!
এভাবেই লেখা হলো রাত্রিনামা—উপসর্গের আড়ালে!
আড়চোখে গোধূলি এঁকে ফিরে গেলে—বিদগ্ধ সারস, ভেবেছি বহুদিন—বিমর্ষ যে সন্ধ্যায় জন্ম হয়েছিল আপাত সত্যের, সেখানেও কি গোপনে লেখা ছিল অন্ধতার কাহিনি?
সভ্যতা সেঁচেও দেখেছি, চোখ থাকা সত্ত্বেও কেউ কেউ অন্ধ অজগর। সুতরাং অনুপম সন্ধ্যায় ভাবনার আসমানে উড়ে যেতে দোষ নেই—
অর্ধনমিত
প্রণয়ের বাঁকে কোনো নৈর্ঋত থাকে না—
চোখের ভেতর, বহুকাল, উড়ে যায় নকলনবিশ;
রহস্যরাত্রির মেধা ছিন্নভিন্ন শেষে—গোপন প্রতিভা!
প্রতিদিন বিকেল বাজিয়ে যায় গন্তব্যের ট্রেন,
অবগুণ্ঠন ফুঁড়ে উঠে আসে তেইশ বছরের খনিজ
গোপনের সহজাত শীর্ষ বেজে ওঠে অলঙ্কারসমেত।
চারু, দেখো—ঋতুর চমকে সপ্রতিভ এই সংলাপ
বহুমুখী ক্লেদ নিয়ে শীতের সায়াহ্নে নির্নিমেষ ঝরে;
প্রণয়ের বাঁকে কোনও নৈর্ঋত থাকে না জেনেও
অর্ধনমিত দুটি চোখ ভাঁজ খোলে—মাটির সম্ভারে!
হাঁটছি আমরা
সকাল হেঁটে যাচ্ছে—
কাঁধে কুয়াশাজর্জর শীতবস্ত্র; হাঁটছি আমরা
নগরীর বাহুল্যবাগান পেরিয়ে রাত্রি অভিমুখী;
নিখিলবিশ্বে নেচে ওঠা সেলফি উৎসব আরও রঙিন
দিকে দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে শান্তিতামাশা,
সুরক্ষিত ভেতরমহল, রক্ত আলোকে উজ্জ্বল!
আমরা হাঁটছি, পদশব্দে ভুলফুল; দেখি—
শাস্ত্রীয় উঠোন যেন পৃথিবীর সমস্ত আর্তচিৎকার
উপমিত হাসি আর মানবভস্মে গম্ভীর!
ভেতর-বাহির পোড়াগন্ধ, হাঁটছি আমরা—
হেঁটে চলেছে শীতবস্ত্র, গভীর রাত ও অগ্নি-তামাশা
আড়ালে আলোকের গোপনগর্ভ, গতিশীল বাস্তব।
জীবনমুদ্রা
যে ভাবেই দেখো—জীবন এক প্ররোচনাময় টগবগ, কতিপয় ঘোরেই সুস্থির!
বরং অননুমোদিত সেইসব দিনের কথা ভেবে হেঁটে যাও প্রাগ্রসর পথে, হয়তো শুনতে পাবে— পর্যটনপ্রিয় ঘোড়াদের হ্রেষাধ্বনি মিলিয়ে যাচ্ছে শ্রাবণভূমির অচেনা সন্ধ্যায়, বুঝে নিও—অশ্রু ও বর্ষার শাশ্বতরূপে প্রোথিত রয়েছে রূপান্তরের বিপুল সম্ভার। কিংবা, ঊরুস্তম্ভে উল্কি এঁকে বিকল্প উৎসেও খুঁজে পেতে পারো জীবনের প্রকৃত নৈর্ঋত!
এভাবেই—হাঁটতে হাঁটতে ভেঙে ফেলো অক্ষরের শব আর কাচের মহিমা; প্ররোচনা এড়িয়ে—ভাবে ও আচারে পুনরাধুনিক হয়ে ওঠাই বরং শ্রেয়তর!
চলো, নির্লিপ্ত হেঁটে যাই
মোহনীয় সেই গোধূলি—আমরা হাঁটছিলাম। এবড়ো-খেবড়ো আলপথে ছড়িয়ে পড়ছিল রক্তিম আলোক। চোখের পর্দায় গলিত সবুজ এবং সম্ভ্রান্ত একটি সংসারের প্রতিধ্বনির ভেতর ফুটে উঠেছিল হলুদ হাওয়া—উদ্দেশ্যহীন! তবুও কয়েক শতাব্দী হেঁটে সেইসব প্রণয়বেলা আমরা গড়িয়ে দিয়েছিলাম প্রান্তরের ঘাসে—
আমরা সাক্ষী ছিলাম ঝরে যাওয়া সময়ের; ভেবেছিলাম—হাস্যকর কোনো ভোর নিয়ে যাবে প্রস্তর যুগের ভোজসভায়!
কিংবা, নরম অন্ধকার উসকে জেনে নেবে ক্ষরিত জীবনের সমগ্র রসায়ন। ভাঁজ হওয়া বিকেলের মসৃণতা থেকে জাগিয়ে দেবে অদেখা ভুবন; পাঁজরভাঙা চিহ্নলোকও ফিরে আসা অমূলক নয়। অথচ, শেষাংশ গণনায় দেখি—দণ্ডিত পৃথিবী!
অরণ্য প্রাচীন হলে, তার ছায়াতলে, জেনেছিলাম—গড়ে ওঠে পরিবর্তিত বসতি! কথারও অলঙ্কার আছে, সময়ের মোচড়ে ধ্বনিত হতে পারে প্রত্যাশিত রাগিনী ফের; চলো, নির্লিপ্ত হেঁটে যাই—ধূলিরাঙা প্রাচীন গোধূলির পথে…
রাতকে ডেকে বলি
গোধূলিসারস, অবিরাম উড়ে যায় ঘনসন্ধ্যার পথে—
রাতকে বলি: অন্ধত্বের সুতো ছিঁড়ে প্রাচ্যের আকাশে জাগো;
কেননা, গুমোট আঁধারে গোল হয়ে আছে সময়—মৃতবৎ!
গতিশীল হতে গিয়ে—যে দেয়াল প্রলম্বিত চারপাশে
প্রত্নযুগে রচিত সে ইতিহাস! অসংখ্য খুন বিধৌত মৌনহাসি
মূলত, স্বার্থ আর ভোগের ঝরনাধারা; কলস্বরে বাজায়—
তাপানুকুল হাওয়ার সমঝোতা!
যে অরণ্যগুহায় সমাধিস্থ সাম্প্রতিক বিবেক,
তার রংমহলজুড়েও সাপিনীপ্রেম ফোটে টগবগ,
ফণাশীর্ষে লোভনীয় স্বর্ণমণি; আর—
বাস্তুসাপের তাড়া খাওয়া ধাবমান যাত্রীরাও দেখছে,
তেঁতুলনগর দাউদাউ—পিশাচ তাড়ানোর হোমাগ্নি!
ওহে সময়, উদগীরণ মানেই আগ্নেয় লাভার বিকিরণ—
রাতকে ডেকে বলি: গুমোট ইতিহাস পুড়তে দাও…