ঘোড়সওয়ার
জনসমুদ্রে জেগেছে জোয়ার,
হৃদয়ে আমার চড়া।
চোরাবালি আমি দূরদিগন্তে ডাকি–
কোথায় ঘোড়সওয়ার?
দীপ্ত বিশ্ববিজয়ী। বর্শা তোলো।
কেন ভয়? কেন বীরের ভরসা ভোলো?
নয়নে ঘনায় বারে-বারে ওঠাপড়া?
চোরাবালি আমি দূরদিগন্তে ডাকি?
হৃদয়ে আমার চড়া?
অঙ্গে রাখি না কারোই অঙ্গীকার?
চাঁদের আলোয় চাঁচর বালির চড়া।
এখানে কখনো বাসর হয় না গড়া?
মৃগতৃষ্ণিকা দূরদিগন্তে ডাকি?
আত্মাহুতি কি চিরকাল থাকে বাকি?
জনসমুদ্রে উন্মথি কোলাহল
ললাটে তিলক টানো।
সাগরের শিরে উদ্বেল নোনাজল,
হৃদয়ে আধির চড়া।
চোরাবালি ডাকি দূরদিগন্তে
কোথায় পুরুষকার?
হে প্রিয় আমার, প্রিয়তম মোর।
আয়োজন কাঁপে কামনার ঘোর,
অঙ্গে আমার দেবে না অঙ্গীকার?
হালকা হাওয়ায় বল্লম উঁচু ধরো।
সাত সমুদ্র চৌদ্দ নদীর পার
হালকা হাওয়ায় হৃদয় দু-হাতে ভরো,
হঠকারিতায় ভেঙে দাও ভীরু দ্বার।
পাহাড় এখানে হালকা হাওয়ায় বোনে
হিমশিলাপাত ঝঞ্ঝার আশা মনে।
আমার কামনা ছায়ামূর্তির বেশে
পায়ে-পায়ে চলে তোমার শরীর ঘেঁষে
কাঁপে তনুবায়ু কামনায় থরো থরো।
কামনার টানে সংহত গ্লেসিআর।
হালকা হাওয়ায় হৃদয় আমার ধরো,
হে-দূর দেশের বিশ্বজয়ী দীপ্ত ঘোড়সওয়ার।
সূর্য তোমার ললাটে তিলক হানে
নিশ্বাস কেন বহিতেও ভয় মানে।
তুরঙ্গ তব বৈতরণীর পার।
পায়ে-পায়ে চলে তোমার শরীর ঘেঁষে
আমার কামনা প্রেতচ্ছায়ার বেশে।
চেয়ে দেখো ঐ পিতৃলোকের দ্বার।
জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার—
মেরুচূড়া জনহীন—
হালকা হাওয়ায় কেটে গেছে কবে
লোকনিন্দার দিন।
হে প্রিয় আমার, প্রিয়তম মোর
আয়োজন কাঁপে কামনার ঘোর।
কোথায় পুরুষকার?
অঙ্গে আমার দেবো না অঙ্গীকার?
বোহিনিয়া
কোথায় গিয়েছে সেই দিন! তার স্মৃতি
আজ শুধু একাকিত্বে জাগে।
অন্য যে, সে জীবনের যুদ্ধে বীর কৃতী;
কৃতিত্ব কোথায় বলো স্মৃতির সংরাগে?
সময়ের দুই পিঠে দিয়ে জোড়াতালি
একজন আজও দেখে নিবিড় আকাশ,
সেই ঘর, জানলার পাশে বোহিনিয়া,
সে-গাছে দু-জন লোক এক অবকাশ
জোড়ে-জোড়ে গেঁথেছিলো।
. আজ একজন
সে-গাছে খোঁজে না ফুল, ডেলিয়া জিনিয়া
সিঁড়ির দু-ধারে টবে রাখে তার মালি।
অন্য ঘরে সেই ফুল রাখে একজন,
বেয়ারাই আনে খাসকামরায় ডালি।
আমার ঘরের পাশে ঝরে বোহিনিয়া।
ভিলানেল
দিনের পাপড়িতে রাতের রাঙা ফুলে
সে কার হাওয়া আনে বনের নীল ভাষা।
জোগায় কথা তাই সোনালি নদীকূলে।
আলোর ঝিকিমিকি তোমার কালো চুলে,
উষার ভিজে মুখে দিনের স্মিত আশা,
দিনের পাপড়িতে রাতের রাঙা ফুলে
পরশ মেলে মেলে তুমি যে ধরো খুলে,
হৃদয় সে উষায় থামায় যাওয়া-আসা,
জোগায় কথা তাই সোনালি নদী-কূলে।
কে খোঁজে পথে আর কে ঘোরে পথ ভুলে;
অস্ত গোধুলিকে কে সাধে দুর্বাসা
দিনের পাপড়িতে রাতের রাঙা ফুলে?
ঈশান মেঘে আর ওঠে না দুলে দুলে
ত্বরিতে কাঁদা আর চকিতে মৃদু হাসা,
জোগায় কথা তাই সোনালি নদী-কূলে।
সে-তরু এ হৃদয়, তুমি যে-তরুমূলে
বসেছ ফুলসাজে, ছায়ায় দাও বাসা
দিনের পাপড়িতে রাতের রাঙা ফুলে,
জোগায় কথা তাই সোনালি নদীকূলে।
ক্রেসিডা
স্বপ্ন আমার কবিতা,
অমাবস্যার দেয়ালি,
ধুম্রলোচন নিদ্রাহীন
মাঘরজনীর সবিতা।
হৃদয় আমার খেয়ার যাত্রী বৈতরণী পার।
কাণ্ডারীহীন বালুকাবেলায় চোখ পুড়ে মরে দূরে।
হৃদয় আমার ছাপিয়ে উঠেছে বাতাসের হাহাকার।
দিনগুলি তুমি তুলে নিলে অঞ্চলে।
বালুচরচারী দৃষ্টিতে ঝরে সান্নিধ্যের ধারা।
রাত্রিও চাও? শ্রাবণের ধারাজলে
মুখর হৃদয় তালীবনদিঘি কল্লোলে অবিরাম।
ক্রেসিডা! তোমার থমকানো চোখে চমকায় বরাভয়।
তোমার বাহুতে অনন্ত–স্মৃতি ক্রতুকৃতমের শেষ।
মত্তপ্রলয় তোমাতেই করি জয়।
মহাকাল আজ দক্ষিণ কর প্রসারে আমরই করে।
ভীরু দুর্বল মন।
দৈবের হাতে হাত বেঁধে যাওয়া মহাসিন্ধুর পারে।
সর্ব–সমর্পণ।
হেলেনের প্রেমে আকাশে বাতাসে ঝঞ্ঝার করতাল।
দ্যুলকে ভূলোকে দিশাহারা দেবদেবী।
কাল রজনীতে ঝড় হয়ে গেছে রজনীগন্ধা -বনে।
বৈশাখী মেঘ মেদুর হয়েছে সুদূর গগনকোণে।
কুরুক্ষেত্রে উড়েছে হাজার রথচক্রের ধূলি।
স্বপ্নগোধূলি ডুবে গেল খর রক্তের কোলাহলে।
লালমেঘে ঠেলে নীল মেঘ,নীলে ধোঁয়া মেঘেদের ভিড়।
মেঘে মেঘে আজ কালো কল্কির দিন হল একাকার।
বিদ্যুৎ নেভে ঈশানবিষাণে, বজ্রও দিশাহারা।
এলোমেলো পাখা ঝাপাটি তবুও ওড়ে কথা ক্রেসিডার।
ভ্রান্তি আমারে নিয়ে যায় যদি বৈতরণীর পার,
ভবিষ্যহীন আঁধার ক্লান্তি কাকে দেব উপহার?
তপ্তমরুর জনহীনতায় কোথায় সে প্যান্ডার?
স্বসমুত্থ সে কোন দেবতার দ্বিরাচারী সম্ভাষে
অমরাবতীর সমাহারী নারী হেলেনের বালালোল!
আমারই শেফালী জেবলী কেবল,ঝরে জবাসঙ্কাশে!
সূর্যালোকের ধারায় জেগেছে জীবনের অঙ্কুর।
আত্মদানের উৎসেই জানি উজ্জীবনের আশা।
অসূর্যলোকে বন্দী, কুমারী, তোমাতেই খুঁজি ভাষা।
সময়ের থলি শতচ্ছিদ্র, বিস্মৃতিকীট কাটে।
প্রাণোপাসনার পূজারি তাইতো তোমার শরণ মাগি।
প্রাণহন্তারা রলরোলে চলে ট্রয়ের মাঠে ও বাটে।
ঊষসী আকাশ ধূসর করেছে মরণের আনাগোনা।
হেলেনের বুকে শবসাধনার বিশ্রাম আর নেই।
আমার হৃদয়–ঘটাকাশে শুধু জীবনের আরাধনা।
ট্রয়ের প্রাচীর ভঙ্গুর কেন?কোন হেলেনের
অমর রূপের প্রখর আবেগে বিপুল বিশ্ব হারাল দিশা?
লোকোত্তর এ রূপসী বা কেন? লোকায়তিক এ-মরণ তৃষা?
জানি জানি এই অলাতচক্রে চক্রমণ।
সোৎপ্রাসপাশে বলিনাকো তাই কথা।
ক্রেসিডা। আমার প্রচণ্ড আকুলতা–
জিজীবিষু প্রজাপতির বিভ্রমণ।
সোনালি হাসির ঝরনা তোমার ওষ্ঠাধারে।
প্রাণকুরঙ্গ অঙ্গে ছড়ায় চপলমায়া।
মুখর সে গান ভেঙে গেল।আজ স্তব্ধ তমাল।
হালকাহাসির জীবনে কি এল ফসলের কাল?
এই তবে ভোরবেলা।
হে ভূমিশায়িনী শিউলি! আর কি
কোনো সান্ত্বনা নেই?
রজনীগন্ধা দিয়েছিলে সেই রাতে,
আজো তো সে ফোটে দেখি –
মদির অধীর রাতের তন্বী ফুল-
রজনীগন্ধা, বিরাগ জানে না সে কি?
দুঃস্বপ্নেও প্রেম করেনি আশা।
শত্রুশিবিরে কুমারীর নত চোখে, মুখে, সারা শরীরের নগ্নভাষা।
হে গ্রিক-নাগর!ট্রয়কে হারালে আজই!
কালের বিরাট অট্টহাসির ছায়া
ঢেকে দিল ঢেকে তোমারও মরণ-মায়া–
হে মাতরিশ্বা, মহাশূন্যের সুখে
তুড়ি দিয়ে যাই তোমারও প্রবল মুখে।
তুমি ভেবেছিলে উন্মাদ করে দেবে?
উদ্বায়ু আজো হয়নি আমার মন।
লোকায়ত মনে স্বেচ্ছাবর্মে লেগে
বর্শা তোমার হয়ে গেল খান-খান।
বুদ্ধি আমার অপাপবিদ্ধমস্নাবির।
জড়কবন্ধ অন্ধ কর্মে ফুৎকার করি নর্মাচারে।
প্রাক্তন–পাশ্চাত্য মাগি না।মন তুষার।
পাহাড়ের নীল একাকার হল ধূসর মেঘের স্রোতে
পাঁচ পাহাড়ের নীল।
বাতাসেরা সব বাসায় পালাল মেঘের মুষ্টি হাতে।
স্তব্ধ নিথর সাত-সায়রের বিল।
শিবা ও শকুনি পলাতক জানি ভাগ্য তো কৃকলাস।
কুরুক্ষেত্রে ইন্দ্রপ্রস্থ, পরীক্ষিতেরই জয়!
শরৎমাধুরী লুট করে ফিরি–জয় জয় ট্রয়লাস।
উল্লাসে গায় পালে পালে ক্রীতদাস।
বিজয়ী রাজার দানসত্রের শ্রাবণপ্লাবনে ভাসে
পুরজন যত গৃহহীন যত বুভুক্ষু ভিক্ষুক।
হায়নার হাসি আসে স্মৃতিপটে–বেহিসাবি ক্রেসিডা সে?
তুমি চলে গেলে মরণমারীচ মায়াবীর ডাকে মূক
বধির ওষ্ঠাধারে।
তারপরে এল রণমন্থনে দূরবিদেশের নারী।
কালো সন্ধ্যায় দিলে শ্বেতবাহু দুটি–
স্মরণ তোমায় হানে আজো তরবারি!
সে কবে
সে কবে গেয়েছি আমি তোমার কীর্তনে
কৃতার্থ দোহার|
পদাবলী ধুয়ে গেছে অনেক শ্রাবণে;
স্মৃতি আছে তার|
রৌদ্র-জলে সেই-স্মৃতি মরে না, আয়ু যে
দুরন্ত লোহার|
শুধু লেগে আছে মনে ব্যথার স্নায়ুতে
মর্চের বাহার|
জল দাও
তোমার স্রোতের বুঝি শেষ নেই, জোয়ার ভাটায়
এ-দেশে ও-দেশে নিত্য ঊর্মিল কল্লোলে
পাড় গড়ে পাড় ভেঙে মিছিলে জাঠায়
মরিয়া বন্যায় যুদ্ধে কখনো-বা ফল্গু বা পল্বলে
কখনো নিভৃত মৌন বাগানের আত্মস্থ প্রসাদে
বিলাও বেগের আভা
আমি দূরে কখনো-বা কাছে পালে-পালে কখনো-বা হালে
তোমার স্রোতের সহযাত্রী চলি, ভোলো তুমি পাছে
তাই চলি সর্বদাই
যদি তুমি ম্লান অবসাদে
ক্লান্ত হও স্রোতস্বিনী অকর্মণ্য দূরের নির্ঝরে
জিয়াই তোমাকে পল্লবিত ছায়া বিছাই হৃদয়ে
তোমাতেই বাঁচি প্রিয়া
তোমারই ঘাটের কাছে
ফোটাই তোমারই ফুল ঘাটে-ঘাটে বাগানে-বাগানে।
মহাশ্বেতা
নয়নে তোমার মদিরেক্ষণ মায়া।
স্তনচূড়া দিলো ক্ষীণ কটিতটে ছায়া।
স্বপ্ন-সারথী, তোর কি যায় দেখা?
অমরলোকের ইশারা তোমার চোখে
ক্রান্তিবলয় মিলায় সুমেরুলোকে।
আজ কি আমাকে ভুলেছ মহাশ্বেতা?
অমৃতের ঝারি মদির ওষ্ঠাধরে
স্মৃতি-বিস্মৃতি শরতের ধারা ঝরে।
আজ কি আমাকে ভুলেছ মহাশ্বেতা?
শরীরে তোমার অলকনন্দা গান।
আচ্ছোদনীরে করো তুমি যেই স্নান
স্বপ্নবাণীতে শিহরায় ক্রন্দসী।
ভাস্বর তব তনুতে অমৃত জ্যোতি
প্রাণসূর্যের একান্ত সংহতি,
ক্রান্তিবলয়ে শিহরায় ক্রন্দসী।
উত্তর করে মুদ্রিত বরাভয়,
তামসীকে করো খণ্ডন, করো জয়।
স্বপ্নসারথী, তোরণ কি যায় দেখা?
পশ্চাতে ধায় মরণ চাঁদের আলো
দিগন্ত-ফণা তুহিন, পাণ্ডু, কালো।
বিস্মরণীর বালুতীর যায় দেখা?
হে বীর অতনু, নচিকেত ধনু টানো,
দেহ-দুর্গের রক্ষায় মোরে আনো…
তোমার প্রাকৃত বহুতে মহাশ্বেতা॥