হৃদয় জুড়ে খরা এখন
হৃদয় জুড়ে খরা এখন
চৈত্র মাঠও চৌচির
চাতক পাখির মতো এ মন
বৃষ্টি পেতে অধীর।
এমন সময় হৃদ্-আঙিনায়
তোর যে আনাগোনা
কখন যে তুই ঢুকলি মনে
হয়নি কভু গোনা।
বৈশাখে আজ ফুটুক প্রেমের
একটি কাঁঠালচাঁপা
মৌ মৌ মৌ গন্ধে সে প্রেম
যায় কি কভু মাপা?
উত্তরাধিকার
আমার হৃদয় নিয়ে বড় বেশি সংশয়ে তুমি—
সেখানে অধিবাস কার?
এ নিয়ে আজকাল নির্ঘুম রাত কাটে তোমার!
কী দিয়ে কিনতে হয় বুকের জমিন?
একটি পবিত্র হৃদয় ছাড়া কিছু কি হতে পারে দাম তার?
হায়! সেই হৃদয় তোমার কই, রূপাঞ্জনা?
হায়! তোমার জন্য করুণা, শুধুই করুণা!
জানো তো—
দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল অধিক স্বস্তির!
দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল অধিক স্বস্তির!
সেই দুষ্টু গরুর অনিষ্ট হতে আশ্রয় চাই
প্রভাতের প্রতিপালকের কাছে!
শূন্য এই হৃদয়ে আজ অধিবাস কার?
একদিন এই বুকে আশ্রয় খুঁজেছিলে তুমিও—
যে বুকটি ছিল শান্তির কটেজ!
আজ কোন্ প্রদোষে তুমি হারালে তার উত্তরাধিকার?
আত্মার শান্তির জন্য
হাজার বছর ধরে খুঁজে চলি পরশ পাথর এক
পথ থেকে পথে, ঘাট থেকে ঘাটে!
তার পরম স্পর্শে আমার হৃদয় হোক
সুনিবিড় শান্তির কটেজ!
তপ্ত এই বুকে আজ আসবে কোন্ হৃদয়িনী?
শুভ্রতার কাছে পরাজিত
সেদিন চিড়িয়াখানার লেকে সুদর্শন বকজোড়া দেখে অবাক হলাম
ওরা একে অন্যের কতো কাছে! বুকের ভেতরে রেখে বুক-
এক অজানা আবেগে অবগাহন করছে-
যেনো ভুলেই গেছে, ওদের আলিঙ্গন দেখে ফেলছে কেউ!
এইতো সেদিন তুমি নিবিড় আলিঙ্গনে আমাকেও জড়িয়ে নিলে বুকে
আর আমি মুখ লুকালাম বকুলের বনে!
অদূরেই কৃষ্ণচুড়া গাছটি লজ্জ্বায় লাল হয়ে
দেখছিল দাঁড়িয়ে…
সেই শুভ্র বক আর আমাদের মিলনের মিল
খুঁজে চলেছি আজো; যেমন কাল থেকে কালে
খুঁজে ছিলাম তোমাকে-তুমি আমাকে
বহু বসন্ত পেরিয়ে অবশেষে দেখা হলো দু’জনে-
যখন শ্মশ্রূমণ্ডিত এই আমি পৌরুষের প্রতীক হলাম
কাজলকালো কেশগুচ্ছ শুভ্রতার রঙে
রঙিন হতে বড় বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লো…
তবে কি শুভ্রতাই সব ঐশর্যের আধার?
দ্যাখোনি, পৌরুষ প্রকাশের আগে বিধাতার
প্রেরিত পুরুষের কাছে আসেনি জিবরিলও!
সকাল গড়িয়ে দুপুর, আসে পড়ন্ত বিকেল-
তারপর কৃষ্ণপক্ষ রাত…
এভাবেই নদীর স্রোতের মতো সময় বয়ে যায় অবিরাম
জেনে রেখো, সময়ের মতো জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই সুন্দর!
সেই সুন্দরের আরেক নাম শুভ্রতা-
যার কাছে পরাজিত তুমি, আমি-সকলেই…
পরিমাপ
প্রিয়তমা,
সব কিছুইকি নিক্তির ওজনে পরিমাপ করা যায়—এবং তা কি উচিত? সব বিষয়ের আদ্যোপান্ত মাপজোখ করার এ প্রবণতা তোমার মাঝেও এসে গেলো কী করে—বুঝি না। এ কেমন দোকানদারি করো তুমি আজকাল ক্ষুদ্র হৃদয়ের মানুষের মতো? অথচ তোমার মাথা সুউচ্চ আকাশ ছুঁই-ছুঁই করছে! তোমার হৃদয়টাতো আকাশের চেয়ে বিশাল হবারই কথা—কিংবা সাগরের চেয়েও গভীর! অথচ এক সাগর প্রেম বলে কী সহজেই না পরিমাপ করে ফেললে তোমার নিজেরই প্রেম! এখানেই তোমার-আমার মাঝে বড় বিরোধ ও মতান্তর।
এভাবে আমার সাথে নিরন্তরই মতান্তর ঘটে আমার নিজস্ব প্রতিবেশ, সমাজ ও রাষ্ট্র; মানুষ ও মানুষের মন—এমনকি প্রেমের তত্ত্ব ও বাস্তবতা—সকল ক্ষেত্রেই! আজকাল এইসব বিষয়ের সাথে মতান্তর ও বিরোধে জড়িয়ে পড়ি কী সহজেই। খাল কেটে কুমির আনার মতো কেইবা ডেকে আনে নিজেরই ক্ষতি?
ভাবতে পারো? কী এমন প্রয়োজন ছিলো তোমার প্রেমের পরিমাপ নিয়ে মাথা ঘামানোর? কিন্তু তা না করে উপায় কী বলো? এমন বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলোই আজকাল আমাকে কেন যে জড়িয়ে জড়িয়ে নেয়, কেন যে ভীষণ পীড়া দেয়—ভাবান্তর ঘটায় হৃদয়ে! আজকাল প্রেম নিয়ে চলছে এ কেমন দোকানদারি?
আমি ভাবতে থাকি—কী সহজেই না মানুষ প্রেমের পরিমাপ করে ফেলে! প্রেমের মাঝেও আজকাল লাভ-ক্ষতির ব্যবাক অংক! প্রেমের আড়ালে অভিনয়ের নিপুণ অভিনিবেশ এবং শিল্পীতভাবেই অভিনীত হয় তার ষোলোকলা! কী যে সুলভ ব্যবসা! এমন ব্যবসা আজকাল বলো, কে হারায়?
এক চিলতে প্রেম আর পৃথিবীর সব সমুদ্রের জল—কী করে সমান হয়? যদি সমানই তা হবে—তাহলে প্রেমের মর্যাদা কোথায় বলো? এক ফোঁটা প্রেমের বিবরে পৃথিবীর সব সমুদ্রের জল—কী সহজেই না স্থান করে নিতে পারে! প্রকৃত আমিতো তাই মনে করি। এখানেই তোমার আমার মাঝে এমন নিরব, নির্বিবাদ, শীতল বিরোধ! এবং এরূপ অন্য অনেকের সাথেই আমার নিরন্তর মতান্তর ঘটে আজকাল। এমন ব্যবাক অসঙ্গতি ইদানিং আমি আর মেনে নিতে পারি না সহজে। হয়তো আমার এমন অপ্রিয় উচ্চারণ তুমিও পারোনি মেনে নিতে সহজেই!
মুখোশ এবং দ্বিধান্বিত আমি
আমার সমস্ত গন্তব্যেই বহুরূপী মানুষের ভিড়। প্রকৃত রক্তের রঙে পার্থক্য কোথায়, বলো? অথচ মনের রঙ চেহারার পার্থক্যের মতো সতত বিচিত্রতর! আর এখানেই সুপ্ত থাকে মানুষের বহুরূপী রূপ-রহস্যের আড়ালে অজানা! একথা ক’জনা জানে? অথচ আমি তো জানি; আমি তো ফেলেছি জেনে রক্তের প্রকৃত রহস্যের কথা। আমার তৃতীয় চোখে রক্তের দৃশ্যত রঙ ভেদ করে দেখে ফেলি মনের রহস্যাবৃত রঙ! আমার চতুর পার্শ্বে জানি বহুরূপে কারা আসে; কখন, কেন বা আসে, প্রিয় মুখ—প্রেমিকার বেশে! আমার দৃষ্টি তো কবেই গিয়েছে খুলে, বন্ধু!
সাম্য মৈত্রী এবং অধিকারের মাথা খেয়ে পৃথিবী এখন দেউলিয়া। অধিকার কাকে বলে তাও আজ ভুলে গেছে সে। এখানে এখন তিরোহিত মানবতা—এইসব গুণ মানুষ আর করে না বহন। হিরোসিমা-নাগাসাকি, গাজা-কিংবা কাশ্মীর ঘুরে এসে আমিও পেয়েছি এক তৃতীয় নয়ন! আমি দেখেছি মানুষের প্রকৃত সত্তাকে বদলে যেতে। বদলে গেছে মানুষ—সভ্যতার শিকলে বন্দি সে। বদলে গেছে পৃথিবী—সভ্যতার কারাগারে বন্দি সে। পৃথিবী এখন দানবের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাকেই প্রকৃত কর্তব্য মনে করে! এর প্রবক্তা ও স্বার্থক রূপকার মানুষ নিজেই! ইদানিং দানবের মুখেও কবিতা! কবিতা কিসের বাহন তবে? দ্বিধান্বিত আমি। তবে কি কবিতা ছেড়েছুড়ে দিয়ে আমিও হাত গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকব? কিংবা বসে বসে চুষব আঙুল? না কি কলমের ডগায় শান দেব? দানবিকতার বিপরীতে জন্ম দেব সাম্য মৈত্রী ও কল্যাণের কালজয়ী কোনো পঙ্ক্তির?
আমার প্রতিভার পদচিহ্ন
হঠাৎ হৃদয় আজ প্রার্থনায় সুস্থির হাতের মতো উঠেছে উর্বর, উঁচু হয়ে
পৃথিবী পড়েছে নুয়ে—যেন তার শৃঙ্গগুলো সিজদায় এখনই পড়বে লুটিয়ে!
মাটির নির্যাস থেকে একে একে উঠে আসে সকল আত্মা আজ
সমস্ত জগৎ কী যে আনন্দে উঠেছে হেসে—
সুন্দরের অনন্ত আহ্বানে মিলেছে কি আরেক সুন্দর?
কার হুকুমের সুরে সায় দিয়ে থেমে গেছে সময়ের গতিটাও
জিবরিল নিয়ে এলো কার গান—কার মহা জ্যোতির পরাগ?
আমার পবিত্র আত্মা হলো বুঝি আরো নিষ্পাপ, পবিত্র এক আলোর কুসুম
তারপর সেই মহা জ্যোতির পরাগ স্থিত হলো হৃদয়ে আমার!
বিরল মুহূর্তে এসে আমি আজ অতিথি কি তাঁর?
বলো, কার?
জানি আরশের আর তার সুমহান প্রতিপালকের!
দেখালেন তিনি সব চাক্ষুষ রহস্য আর নিরূপম নিদর্শন তার বিরল ভ্রমণের রাতে!
আরশের আসনের কাছে বিরল ভাষণের মতো ঘোষণা করেছি আমি চির উন্নত
সেই মহিমা আমার! মহাবিশ্বের পরতে পরতে এঁকে দিয়ে এসেছি
আমার প্রতিভার পদচিহ্ন!
দু’টি সনেট
দানবীর আলাউদ্দিন আহমেদকে নিবেদিত
১.
সন্ধ্যার আকাশে আজ দেখি কার হৃদয়ের রঙ
সুস্পষ্ট ছড়িয়ে আছে, হয়ে আছে গোধূলীর গান
দীনের দীনতা লেপে দিয়ে গেলে আশার আযান
নিস্পৃহ দুঃখীর মন রাঙিয়েছো তুমিই বরঙ
শিল্পের সম্মানে তুমি করে গেলে সব কিছু দান
তিলে তিলে গড়ে তোলা আপন সম্পদ সমুদয়
বিলিয়েছ অকাতরে, করেছ যে কৃপণতা জয়
মানুষের পাশে এসে গেয়ে গেলে মানুষেরই গান
কৃতি ও কীর্তিতে গড়া কুষ্টিয়ার যে কৃতি সন্তান
হাতেম তায়ীর মত হালের খালেস মহসিন
যেমন ছিলেন দাতা হাজী মহম্মদ মহসিন
পঙ্কিল পুঁজির ঠিক বিপরীতে নিলে অবস্থান
ভোরের সূর্যের নূরে দূর হোক দারিদ্র্যের ক্লেদ
ইতিহাসে লেখা থাক দাতা আলাউদ্দিন আহমেদ!
২.
এখনো ক্ষুধার তোড়ে ওষ্ঠাগত মানুষের প্রাণ
এখনো মানুষ মরে এখানে,—পথের ধারে ধারে
জোর যার রাজ্য তার—দুঃখীর মুখের গ্রাস কাড়ে
সাততলা—গাছতলা গড়ে ওঠে স্পষ্ট ব্যবধান
অবহেলা, বঞ্চনা ও নিপীড়নে নিষ্পেষিত হয়ে
আবাল-বনিতা বৃদ্ধ এখনো যে আহাজারি করে
সুসভ্য মানুষ-রূপী যত হিংস্র্র পশুর নখরে
কত যে নিরন্ন-জন সাধের জীবন ফেলে ক্ষয়ে
এমন ক্ষুধার রাজ্যে কে আর হাতেমতায়ী হবে
এমন দুর্ভিক্ষ টুটে কে আর খাদ্যের ফেরি করে?
গলিত লাশের জন্য কে আর কাফন ক্রয় করে
বঞ্চিত শিশুর মন ভরে দেয় ঈদের উৎসবে—
এমন নিঃস্বপ্ন নীড়ে আশার পাখির মতো তুমি
শস্যের সম্ভাবে ভরে দিতে এলে এই মরুভূমি!
নদী ও নারী
পৃথিবীর ব্যাবাক প্রান্তরে—সাগরের তলদেশে প্রতিদিন খুঁজে ফিরি যত সব মণি-মুক্তা, রত্নের সম্ভার। মেটে না সে তৃষ্ণা তবু; আমার যে প্রয়োজন উপমার রত্ন-তলদেশ! পর্যটক পাখির মতন নিরন্তর হেঁটে যাই, অথবা অশ্রান্ত ডুবুরির বেশে সারা বাংলাদেশে! কিংবা এই ভূখণ্ডের সীমানা পেরিয়ে পারস্যের প্রান্তে—অবশেষে কোনো একদিন এসে পড়ি আকাঙ্ক্ষিত নদীটির কাছে; শান্ত, সৌম্য সেই ডাকাতিয়া নদী; কেমন তন্ময় হয়ে শুধু দেখি তার রূপ—অন্তহীন সৌন্দর্য সুষমা! তোমার পিঠের মত দুই পাড় সরু তার মেলে আছে স্নিগ্ধতার ছায়া! ছুঁয়ে দেখি সেই পিঠ—নদী ও তোমার মাঝে পাই নাতো কোনো ব্যবধান! নদীর পাড়ের মতো তোমার নিপুণ প্রিয় পিঠ আমাকেও করেছে উদাস! তাইতো আমি ছুটে যাই বারবার শান্ত-সৌম্য নদীটির কাছে!
স্রোতের নদী
স্রোতের নদী যায় কি রোখা
স্রোতে যদি হয় অধিক
বেঁধে রাখা যায় কি তারে
যে জন দূরের পথিক!
মনকে ধরে রাখতে হলে
মন দিতে হয়, মন—
আস্থা এবং প্রীতি ছাড়া
মন বাঁধে কোন্ জন?
আঁকড়ে ধরে স্মৃতির খেয়া
হই যে পারাপার
উথাল-পাতাল ঢেউ তোলে মন
জানতে তুমি কার!