একটি মা গাছ ও ছিন্নপত্রাবলির ক্লোরোফিলগুলো
একটি মা বৃক্ষের সাথে কখনো কখনো আমার দেখা হয়। খোলা চুল, দুপুরের স্নান সেরে রোদের পিঠে দাঁড়িয়ে থাকে সে। পাতায় পাতায় শতরন্ধ্র রান্নাঘর প্রখর সূর্যতাপে সয়ে যাওয়া…
গাছটিকে কখনো হাসতে দেখি না, কাঁদতেও দেখি না প্রাণ খুলে। মাথানিচু সংসারে দুপুরের দাওয়ায় যেন চিরকাল হাতপাখা নিয়ে বসে থাকে সে, পাতার অক্সিজেনগুলো বাতাসে ছড়ায়…
ঝড়ে ও বিদ্যুতে মা গাছটির কোনো রা নেই। ডালপালা ভাঙে, শব্দ হয়, ঝড় লাগে। তার কোনো প্রতিবাদ নেই। দেনা-পাওনার সংসারে চারপাশ থেকে সে কেবল টেনে নিচ্ছে নিকষ কার্বন। মাঝে মাঝে দুরের পাখিটি আসে। মগডালে বেঁধে রেখে যায় খড়কুটো, প্রণয়ের ডিম…
গত বৈশাখে সমূলে লুটিয়ে পড়েছে যে পুরুষ বৃক্ষটি তার কাছেও কোন অনুযোগ ছিল না কোনোদিন। বিচ্ছেদের বেদনায় ভরা ডালপালাগুলো আবার ছড়িয়ে দিয়েছে সে বৃষ্টির কাছে। বাচ্চা গাছগুলো এ নিয়েই লেপ্টে থাকে তেল চিটচিটে আঁচলের গায়ে…
শুধু সইয়ের বাড়ি থেকে যে দুরের পাখিটি আসে তার সাথে কথা বলে অচিন পাতাটি। দুজনের কত কথা হয়! পরস্পরের কাছে যে যার গল্প ঢালে। মা গাছটির বুকের কার্বনগুলো এভাবেই হালকা হয় রোজ সন্ধ্যায়। ভোরবেলা খুলে যায় ছিন্নপত্রাবলির ক্লোরোফিলগুলো…
বালুকণা রায়
আমি বালুকণা রায়, কানে সফেনের দুল
বিবাহবিচ্ছিন্ন আকাশ ও মেরুর মেয়ে,
সূর্যতপা…ওপারে আমার বোন নারকেলবীথি,
দুজনের মাঝে কত ট্রলারপুরুষ…নৌকোর কানকোরা এসে
শ্বাস ফেলে নিভৃতবেলায়। আমি বালুকণা রায়…
ঢেউয়ের মাংসগুলো আমার প্রেমিক।
আমাদের দোটানার মাঝে প্রচ্ছন্ন বিলিন সাঁকো,
ভেজানো পায়ের পাতা…শেষ ভূখণ্ডে যেখানে উপকূলরেখা
পুরোনো পৃথিবীর শ্যাওলায় মোড়া গল্পের জেটি…বিগলিত গ্লেসিয়ার…
এসো হে অভিন্নটুকু
নৌকোদের ঘুম পাড়িয়ে এসো
এসো রাতকথা, নিচুস্বর দেহের প্রোটিন
এসো উড়ন্ত মরাল, লৌহ ও আকরিক…
ভেসে ভেসে এসে যদি
তারা প্রাণ ফিরে পায়
আমি দিকচিহ্নহীনা
বালুকণা রায়…
এপ্রিল-২০২০
একদিন তমুল ভাইরাসেরা
ছুটে এলো আমাদের গল্পের দিকে
বরফের দেশ থেকে এলো
গবেষণাগারের কাঁচ ফুঁড়ে এলো
ছুটে এসে তারা পাখিদের হয়ে
শীষ দিয়ে গেলো,
ফুটিয়ে তুললো পুড়ে যাওয়া আমাজন, মরা ডাল
খাতা খুঁটে লিখে গেলো দানার বকেয়া
আর বেঁধে বেঁধে নয়
আমাদের গল্পের দিকে এসে তারা
রেখে গেল পুরনো করোটি
নিজেদের প্রত্যেকের ছায়ার তফাত
বাংলা কবিতা
কে যে তুমি দিন লিখো, রাত লিখো
পাতায় পাতায়, কাজলের কালিতে লিখো ফোঁটা ফোঁটা চোখের বর্ণনা, অস্পষ্টতা
সরে গেলে দেখি কাঠের আদল, দেহের দুরত্বগুলো মেপে নেয় পরিধির ছায়া
বর্ণনার শেষটুকু তাই আলিখিত ফেলে নদী চলে যায়, ভাঙনের পরিসর থাকে
সাপে কাটা নসিবের মতো গ্রাম থাকে লোহার বাসর, ভাটিদেশ থাকে…
সাতাশে ডিসেম্বর
বারান্দার দুদিকে পরস্পর পিঠ ঠেকানো দুটি চেয়ার
একটিতে গা এলিয়ে বসতেন আমার বাবা
অন্যটিতে এসে বসত বিকেলের রোদ
দুটি পড়ন্ত আলোর মাঝামাঝি
সারা জীবনের গল্প, খাঁচা ও পাখির উপমা
বিকেল গড়িয়ে গেলে দুজনের দুদিকে
নেমে আসত সন্ধ্যার উপসংহার
প্রতিটি গল্পের শেষে যে রকম রেশ থেকে যায়
পশ্চিমের বারান্দায় এখনো সে রকমই
বসে আছে একটি শূন্য চেয়ার
অন্যটিতে এসে বসে থেকে থেকে
ক্রমশ জুড়িয়ে যাচ্ছে গল্পের পৃথিবীর রোদ…
শীতকাল এলে
আমার জীবনে শীতের শুরু এক কার্তিকের ভোর বেলায়। সেই থেকে প্রতিবছর শীতকাল এলে আমি শুধু নিজের উপমা খুঁজি। একটি নির্জন সকালের পূর্বপৃষ্ঠায় যার জন্য লেখা হয়েছিল নহবত, ছড় টেনেছিল অঘুমা রাতের বাতাস, গায়ে কাঁটা তোলা হিমের বেহালা…
শীত এলে নিজে থেকেই পাতাগুলো ঝরে যায়। খুব হাল্কা করে শুন্যে ভাসিয়ে দেয় দেহ। বাকলের গা থেকে নিজেদের আলাদা করে নেয় সরলবর্গীয় গাছেদের সারি। মায়াত্মক ফেলে সাপিনীরাও যে যার ঘুমের গর্তের কাছে ফিরে যায়। শীত এলে গ্রামের শুকিয়ে যাওয়া নদীটির পাশেও ফুঁটে ওঠে চরের উপমা…ঝুরোবালি…অতীতের চাপা উন্মাদ! এরা প্রত্যেকেই নিজের উপমা। শীত এলে প্রত্যেকেই যে যার নিজের মতো করে সব ছেড়ে চলে যায়…
আমার উপমা নেই। একটি ছায়ার যমজ আর তার গরিব শরীর, উপমাতুল্য এছাড়া আমার আর কিছু নেই। কার্তিকের শীতের সকাল এলে টের পাই কনকনে করাতের ঘোর। হালকা বাদামি পাতা, উপমার মতো চর, সাপিনীর মায়াত্মক, ঝুরোবালি, প্রতিবছর শীতের সকাল এলে টের পাই আমার চারপাশে এসে জড়ো হচ্ছে এরা সব।
সাকিন
কাকে পাঠাচ্ছ নদী
কাকে পাঠাচ্ছ বাঁক
পলি নিঃসৃত ছন্দ ও অনুপ্রাস
জলের অসুখের দিনে ছড়িয়ে পড়েছে সে
জীবাণুর মতো, যে করে কষ্ট ছড়ায়
কাকে পাঠাচ্ছো সেই থেকে কথা
কথার উল্টো পিঠেই নিভু নিভু গ্রাম
পঙ্ক্তির অভিন্ন দিকেই যার ঢালু
কাঁটা ছেঁড়া সাকিনের নাম!
পঁচিশে বৈশাখ
শরীরে নৌকো জড়ানো একটি মহানদী
অতিক্রম করে গিয়েছিল গোটা বাংলাদেশ
তাঁকে ধরা দিয়েছিলো প্লাবনের জল
আমের মুকুল,সাজানো পানসির রঙ লতাপাতা,
পলির অনুপ্রাস…
আকাশের আহ্লাদ হয়ে আলখাল্লায়
আঁকা হয়েছিলো একটি ঝড়ের ঋতু
বাংলাভাষার মতো চকিত বিদ্যুৎ
আর উপনিষদের হোম
এর একটু দুরেই ছিল
ঘরছাড়া মানবীর মানহারা পাড়া
বিভাজিত গ্রাম, পুঁথিলেখা সন্ধ্যার
এক ছায়ানদী, দুঃখী সনকা যার নাম
গায়ে আলখাল্লা জড়ানো একটি ঝড়ের ঋতু,
কালিঢালা পৃষ্ঠার আকাশ গীতবিতানের মেঘ
সেই থেকে ছেয়ে আছে গোটা বাংলাদেশ,
যারপর থেকে শুরু বিদুর শ্রাবণ,
রচনাবলির তোমার আমার কথা….
গ্রামের লুপ্তপ্রায় সাঁকোটিকে
প্রপিতামহের মতো মনে হয় সাঁকোটিকে
যার বুকের ওপর দিয়ে বাঘ শিকারের
গল্পগুলো শহর অবধি এসে পৌঁছায়
নিজেদের প্রবল ঘ্রাণশক্তি ও ডোরাকাটা ফেলে
তারা আবার অতিতের রোমহর্ষের কাছে ফিরে যায়
সাঁকোটির আর কোন আত্মজীবনী নেই
গমনাগমন নেই, থাবার নৈঃশব্দ্যের নিচে
মৃগয়ার অপেক্ষায় থাকে নড়বড়ে গাঁটের
আওয়াজগুলো, বাঘ শিকারের গল্পগুলো
বুকের ওপর দিয়ে হেঁটে গেলে তারা সহজেই তৃপ্ত হয়
ঘুমের প্রহরগুলো মৌমাছিদের
স্লিপিং পিলের গায়ে লেখা থাকে রানি মৌমাছিটির নাম, হা করা রাক্ষস
আর অর্ধনিমিলিত রাজকুমারীর চোখের বর্ননাও লেখা থাকে তাতে,
মৌমাছিদের মতো রোজ রাতে ঘুমের গল্প পাঠায় সে
ক্রমশ নিশ্চুপ মশারি চুইয়ে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা ঘুম,
ঘুম পাড়ানো শেষে প্রায়ান্ধকারে নির্জন আসবাবের দিকে
হেঁটে চলে যায় তার উপক্রমনিকা
অবশেষে আমাকে একলা রেখে ঘরে অনিদ্রিত এইসব
নিঃশ্বাসধ্বনি ও শীত ঘেরা পাহাড়তলীর নৈশপ্রহরগুলো মিশে যায় রাতের কুহকে….