বাবুল হরিজন
সামান্য মদ খাব, কোমরে গুঁজে রাখা
আধ-খাওয়া বিড়ি ধরাব নাড়ার আগুনে।
মঞ্চে তখন মন্দিরার ঝনাৎ সুরে
খেই হারাবে বাউল সুন্দরী!
রাত অর্ধেকে কেরোসিন ফুরোবে―
বৌ শাসাবে একচোট!
সামান্য মদ খাব, বাংলা কিংবা চোলাই!
ধানউৎসবে ভোর হবে মুচি-বাড়ির বারান্দায়
ঢাক-ঢোলের সঙ্গে কাঁচাপাকা ধানের গন্ধেও
মিশে থাকবে মাতাল মহুয়া!
মধু ও মর্মরের অভিন্ন সুর কেবল
এই নদীমাতৃক অববাহিকাতেই শুনতে পাওয়া যায়।
রাত ভারী হবে, শস্যবতী মাঠ পেরিয়ে
মিহিসুরে বাজবে কারো গোপন ব্যথার একতারা
হাত বাড়িয়ে চেয়ে নেব সাঁইজির রসদ
সটান শুয়ে পড়ব নক্ষত্র বরাবর
একটা দুটো তারা ছুটে এসে বসে থাকবে চোখের ওপর!
আমার বৌ কুলো হাতে ফি-বছরের শঙ্খ বাজাবে
সামান্য মাতাল হব
নাকে-মুখে দুই টান দিয়ে হয়ে যাব বাজিমাৎ!
নতুন সুরের রাগ ওঠাব বৃন্দাবনের ভৈরবীতে
মঞ্চে তখন বাউল সুন্দরী
মোরগবাগে জোয়াল কাঁধে ছুটতে হবে…
হাজার তারার চোখ মেলে চেয়ে থাকা
আকাশের নিচে শুয়ে আছে বাবুল হরিজন,
বুকের ওপর ফুলের মতো সুতোয় গাঁথা
কিছু ঘাসকলি পড়ে আছে নিথর।
৫২ বছরের জীবনে বহুবার বাবুলের ডাক পড়েছে
নাগরিক মানুষদের বিষ্ঠা সাফ করার কাজে,
বছরে একবার পশুবর্জ্য থেকে
নগরকে দুষণমুক্ত করাতেও তার ভূমিকা থাকতো।
পুরোহিত করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে নিলেন সমাজের কাছে…
বিত্তবানদের আবর্জনা সরাতে―
কখনো বা বাবুলের দেরি হয়ে যেত!
[বাবুল হরিজন। পারিবারিক পেশার বাইরে বাবুল ক্ষেত-খামারে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। বাউল গানে ছিল তার অসম্ভব আসক্তি―এখান থেকেই তাকে চেনার সুযোগ হয়েছিল।]
দোয়ার খোঁয়াড়ে বাংলাদেশ
আপনারা সারাবছর দোয়া-আশীর্বাদে ভরপুর থাকেন
কেউবা ইসলামের হেফাজতে কোমরে সুইসাইড ভেস্ট লাগায়া―
বিবিজানের গতরে ঢালছেন দগদগে কেরোসিন।
আরেক দল, জয় মা দুগ্গা ধ্বনি তুলে ঝাঁপ দিচ্ছেন নর্দমায়।
এ এমনই এক দেশ…
কেবল হেফাজতি আর দুগ্গার্থীরাই না
এদেশের মন্ত্রী আমলা এমনকি
লেখক বুদ্ধিজীবীরা পর্যন্ত স্ত্রীসঙ্গমেও আস্থা রাখেন না,
তাদের দৌড়ুতে হয় দেওয়ানবাগে-সায়েদাবাদে
নয়তো কাছিম কিংবা গজার মাছের মাজারে!
ওদিকে ত্যাড়া চোখের লোকনাথ জীর্ণ দুই ঠ্যাং উদোম করে বসে আছে,
সে নাকি জল-স্থলের মহাশক্তি!
বাবা কোনো অনাচারই সহ্য করতে পারেন না,
রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে একবার ওই নাম মুখে আনলেই কেল্লাফতে!
দোয়া-আশীর্বাদ ছাড়া এদেশের কবি-সাহিত্যিকদেরও একদিন চলে না।
অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিক রাজনীতিবিমুখ,
তবু দোয়া চেয়ে চেয়ে তাদের অবিরত কাৎরাতে দেখা যায়!
ছেলের বর্ধিত চামড়া কর্তন থেকে শুরু করে
কনের জন্যে পাত্র নির্বাচন, সর্বত্রই―
দোয়ার ভাণ্ডার! দোয়া চাই, দোয়া চাই। দোয়া সারা বাংলায়!
মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীকেও রুটিন করে দৌঁড়াতে হয় দোয়ার মাজারে,
সিলেটে-আজমীরে, মক্কা-মদিনাতো আছেই দোয়ার মুক্তবাজার
মোছলমানের জাহান চৌচির হয়ে যাচ্ছে দোয়ার ঘাপানে!
ধান্ধা একটাই, দোয়াগ্রস্ত জনগণের
দোয়া ছাড়া তারা ক্ষমতায় টিকবেন না।
চুরি-চামারী রাহাজানি সব ওই দোয়ার বরকতে,
ধর্মের ছলাকলা আর দোয়াই তাদের ভরসা।
পদস্থ আমলা থেকে ডাকবাহক, সবারই
চোরাই সম্পদ হালাল করাতেও ঐ মক্কা-মদিনা
নয়তো এলাকার মসজিদ-মাদ্রাসা,
কওমী দোয়ার খোঁয়াড় তো আছেই দেশজুড়ে হাজারে হাজার…
এদেশের খুন সঙ্গম ও আজানের ঘটনাগুলো ঘটে একসঙ্গে, প্রত্যুষে।
মসজিদের শহর যখন প্রকম্পিত করে
‘ঘুম হইতে নামাজ উত্তম’র বাণী ভেসে আসছিল
তখন এদেশের সবচে মর্মান্তিক বেয়নেটটি চার্জ করা হয়―
একজন গর্ভবতী মায়ের জঠরে থাকা শিশুর
ফিনকি দিয়ে ছিটকে পড়া ওই রক্তের দাগ
এখনো অক্ষত আছে ৩২ নম্বরের বাড়ির দেয়ালে।
শহরের নর্দমা তখন ভরে উঠছিল লক্ষ কোটি মমিনের অজু-গোসলের পানির ঢলে,
তবু ওই সুবেহসাদিকে এক ফোঁটা পানি জোটেনি শিশু রাসেলের বুকফাটা আর্তনাদে!
এ এমনই এক দেশ মতি মিয়া, এদেশে―
একদিন লোকে ফুল নিয়ে শহীদ মিনারে যায়।
একদিন লোকে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার তোড়জোড়ে মেতে ওঠে।
একদিন লোকে শ্রমজীবী মানুষের ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহ নিয়ে রসিকতা করে।
তুমি যদি ন্যায়ভিত্তিক সমাজের কথা বলো, যদি বলো― কয়েক হাজার বছর ধরে মানবসভ্যতা রচনা করে চলেছে শ্রমিকেরা। বিশ্বময় নিরন্তর শস্যের হাসিতে ভরে তুলছে কৃষক। তবে ওই ভণ্ডরা তোমাকে গণতন্ত্রের দোহাই দেবে। যদি বলো, মার্ক্স কিংবা লালন তবে ওই গর্দভেরা তোমাকে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে ছুরি হাতে তেড়ে আসবে।
তুমি যদি বলো সুপারসনিক নিউট্রন প্রোটন ইলেক্ট্রন তবে সর্বগোত্রীয় গর্দভেরা দাবি করবে—বেদ-বাইবেল-কোরানেই সব আছে! যদি বলো, আটলান্টিকের ওপারে আরও একটি বিরাট ভূখণ্ড এবং সেখানেও মানবজাতির বিকাশ ঘটেছিল একই সময়ে। বোরাক বা জিবরাঈল তার কোনো খোঁজ জানলো না—তখন গর্দভের পাল নারায়ে-তাকবির ধ্বনি তুলে অন্ধকারে তলোয়ার হাতে তোমাকে অনুসরণ করবে।
তবু খরস্রোতা নদীর মতো বয়ে চলা এই দেশে, বহু মানুষের চোখ ভিজে ওঠে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’র সুর শুনে…
শ্যানেনডোয়াহ’র স্কাইলাইন, ঘাসফুল!
ফুটে আছ ঘাসফুল, একাকী গহিন পথে
তোমাকেই লেখা হবে প্রভূত বিন্যাসে, আবার তোমাকেই হবে না—
তুমি এক অপরাজিতা বিয়াত্রিচে!
এই যে রোদ,পাতা আর পাখিদের স্বরলিপি ঠোঁটে
তোমাকেই আঁকা হবে সুলতানের ক্যানভাসে, আবার তোমাকেই হবে না—
তুমি এক বিষণ্ণ খরস্রোতা দূরগামী ছায়াপথে !
ফুটে আছ ঘাসফুল, চোখে ও চোখের চারদিকে
রোদমিছিলের মলাট হয়ে একদিন, ঘুরে আসো দিগ্বিদিক
ছুঁয়ে আসো ভাটিয়ারী অথবা শ্যানেনডোয়াহ, যেদিকে খুশি
লুরে কাভার্নের জলপাথরে একবার কান পেতে শুনে নিও
চিরহরিৎ ম্যান্ডারিনের সুর, ব্যথাতুর অর্কেস্ট্রা !
আলপথ খুঁজে পাবে অশ্বারোহীর দল, রোদ ঝড় বৃষ্টিতে তুমি কেবল থেকো অবিচল ।
তুমি বন্ধু একাকী গহিন পথে—
সব ব্যথা কলিতে ধরে, ফুটে উঠে ঝরে যেও নিভৃতে, গোপনে!