০১.
ঘুমের ভেতরে স্বপ্নে অলৌকিক মেঘের পৃষ্ঠায়
আমি এই কবিতাটি যখন লিখছি, তখন আমার
কেন জানি মনে হয় কবিতার কাছে ছুটি চাই:
একটি শব্দের জন্য সারা পৃথিবীতে কী উন্মুখ
অপেক্ষার যন্ত্রণায় অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে
সদ্যজাত গোলাপের কুঁড়ি—এমন আকাল দিনে
কুঁড়িতেই ঝরে যাচ্ছে স্বপ্নপাপড়ি, চুমুর বন্ধন ছেড়ে
উড়ে যাচ্ছে প্রেমিকের মন, খোঁপাহীন প্রেমিকার
চুলে যে সুগন্ধী হাওয়া তৈরি করে পাখির আশ্রম—
ওখানে লোবান জলে মুখ দেখে মৃত্যুর ফেরেস্তা;
চারিদিকে এ কেমন নৈঃশব্দ্যের আতশবাজি খেলা!
অদৃশ্য আতঙ্ক বুকে যারা হাঁটে কাঁধে লাশ নিয়ে
স্নানঘরে ঢুকে তারা দেখতে পায় অন্য এক লাশ—
যে-লাশে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ কোটি স্বপ্নের জীবন।
০২.
আমি এ কবিতাটি যখন লিখছি তখন শহরে
বৈদ্যুতিক বাতিগুলো লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স দেখে
ভয়ে হুট করে নিভে যায়—অন্ধকারে ডুবে গেলো
পথ আর পথিকের পায়ের ঠিকানা; বাড়িগুলো
জীবন্ত পাথর হয়ে পড়ে থাকে সড়কের পাশে;
হঠাৎ কুকুর ডাকে; এ কেমন উড়ন্ত সন্ত্রাস
এক গুপ্তঘাতকের!একা চাঁদ জেগে থাকে দূরে
ম্লানমুখে বসে থাকা আইবুড়ো কুমারীর মতো।
রিয়েলি ভীতির মধ্যে ডুবে আছে ভোরের কুসুম;
কাফনের গন্ধ ভাসে গোলাপের নিশ্বাসে নির্যাসে
জানালা কপাট বন্ধ প্রকৃতির অনিন্দ্য-সুন্দর
মুখ থেকে ক্রমান্বয়ে খসে পড়ছে আলোর মহিমা;
মৃত জোনাকির খোঁজে সন্ধ্যা নামে শহরতলীতে—
কুয়াশা জড়িয়ে কাঁদে ভালোবাসা, পৃথিবীর ওম।
০৩.
এ আমি সে আমি নই–যার চোখে দৃষ্টি আছে ঠিকই
কিন্তু কোনো দৃশ্য নেই–আলোহীন পটভূমিজুড়ে
নাক-কান এখন আগের ন্যায় জায়গা মতো নেই—
যথারীতি কাউকে গন্ধের জন্য নারীফুল কিংবা
পুরুষ ফুলের কাছে যেতে হয় নাকটাকে কেটে;
পথে নেমে মনে হয় পথ এখন গভীর ঘুমে
বিশ্রামে রয়েছে বহুদিন; সামনে যেতে পা বাড়াতেই
মনে হলো আসলে পা বলে কিছু পায়ে নেই আজ।
তবে কি পায়ের ছুটি? তার কাজ খুব বেশি নয়;
আপাতত ঘরে থাকা—বেডরুম থেকে রান্নাঘরে,
কখনো ওয়াশরুমে কখনো বা বারান্দায় বসে
বাতাসের সঙ্গে জীবনের টুকটাক চাওয়া-পাওয়া নিয়ে
অন্তরঙ্গ গল্পবলা: যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে দেখতে
ডানাহীন শূন্যে উড়ে যাই; শূন্য থেকে নেমে আসি।
০৪.
যদিও সময় প্রায় থেমে আছে ঘড়ির কাঁটায়
কী দারুন আকাঙ্ক্ষায় জ্বলতে চায় নেভানো লণ্ঠন;
হঠাৎ খেয়াল হলো, আরে! যার জন্যে এত উড়াউড়ি
সে কেন পাথর হয়ে পড়ে থাকে পাহাড়ের খাদে—
ঝর্ণার মুখরা জলে! স্বপ্নে দেখি—স্বপ্ন ভেঙে গেছে;
স্বপ্ন ভেঙে গেলে দেখি—স্বপ্ন এক মৃত প্রজাপতি।
যখন এ কবিতাটি আমি লিখছি তখন স্বপ্নকে
শাদা কফিনের অন্ধকারে ভরে কবর দিয়েছি।
তখন পৃথিবী জুড়ে চলছে এক ভয়াল তাণ্ডব;
জীবনের মায়াকুঞ্জে পৃথিবীর প্রতি জনপদে
ঘুমের বদলে মৃত্যু; এ কি নিদ্রা মানুষের চোখে!
মৃত্যুই চূড়ান্ত সত্য—গন্তব্যের ঠিকানা কবর;
তা সত্ত্বেও আশাদীপ জ্বেলে জ্বেলে তাড়াতে আঁধার
পাখির খাঁচার মধ্যে খুঁজি আমি আলোর কুসুম।
০৫.
কুয়াশাকে কাঁধে নিয়ে সামনে যায় মানুষ এগিয়ে;
উড়ন্ত ঘোড়ায় চড়ে পাড়ি দেয় জলের পাহাড়
নক্ষত্রের জামা গায়ে জয় করে নীলিমার নদী—
শরীরের শেষ রক্তবিন্দু ফুরিয়ে যাবার আগে
সন্তানের মুখে দেখে অমরত্ব—উত্তরাধিকার;
আশা ও স্বপ্নের নামে চায় মৃত্যুকে হটিয়ে দিতে;
তবু থাকে মৃত্যু ভয়—হাতে ধরে অলৌকিক লাঠি:
সাজানো গোছানো ঘর সংসার তছনছ করত করতে
জনারণ্য ভেদ করে অদৃশ্য তীরের ফলা; হায়!
ধনী বা নির্ধন ছোট বড় নির্বিশেষে যাকে পাচ্ছে
তাকে ধরছে—বিদ্ধ করছে—নিখুঁত নিশানা:
ঠুস-ঠাস শব্দ করে ফেটে যাচ্ছে প্রাণের বেলুন
স্বনির্মিত অন্ধকারে বন্দি পাখি হারিয়েছে ডানা।
০৬.
যখন এ কবিতাটি আমি লিখছি তখন পৃথিবী
একটা স্তব্ধতা কাঁধে অসহায় ভিক্ষুকের মতো
হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে; তার চারপাশে
মশা-মাছি দুই সহোদর আনন্দে গাইছে গান
পুরনো মেথরপট্টি জেগে রয় নতুন উদ্যমে
রাতভর পথভোলা মাতালের অশ্লীল নেশায়
ছায়াকে জড়িয়ে গায়ে অন্ধকারে হাঁটে পথচারী
যৌবন বিপন্ন হয় রক্তহীন বরফের নিচে।
শরীরের দায়-দেনা বেচা-কেনা তবু থেমে নেই;
মধ্যরাতে ঘুম ভাঙে—নিশিকুঞ্জে নেশার আড়ৎ:
কিছু কিছু নেশা আছে কেটে গেলে নেশাই থাকে না;
কিছু নেশা আছে এমন উদগ্র আর দুর্বিনীত
কেটে গেলে ইচ্ছে হয় আবার নতুন স্বরে গাই
মহুয়া ফুলের গন্ধে জীবনের অজানা সংগীত।
০৭.
যখন এ কবিতাটি আমি লিখছি তখন বাইরে
কী অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় চলছে এক অচেনা কার্ফিও,
যে কার্ফিও পৃথিবীর বাসিন্দারা কখনো দেখেনি—
এ উদ্ভট উল্টোরথে যে-মানুষ কখনো চড়েনি
সেও আজ চলতে থাকে অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে
এ রথ পেছন দিকে এইভাবে যেতে থাকে যদি
হয়তো-বা চাকা খুলে ঢুকে যাবে রাক্ষসপুরীতে;
আহা, মানুষের এই পেছনযাত্রা কে পারে থামাতে!
কোন পথ ধরে হাঁটে মানুষের বাঁচার ঠিকানা?
যে গ্রহে মানুষ নেই জীব-জন্তু কখনো ছিল না
সে গ্রহের নাম মুখে জ্বলবে নাকি সন্ধ্যার জোনাকি;
ক্ষেতের ফসল ফেলে মাঠ ছেড়ে তাকে যেতে হয়
কুয়াশা তাড়ানো ভোর আসবে কবে দিগন্তের পেটে—
নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বলে তাজা শিউলি ফুটবে কবে!
০৮.
আমি এই কবিতাটি যখন লিখছি তখন দেখছি
শহর-বন্দর গাঁয়ে পথে ঘাটে বাজারে মাজারে
এমনকী গণিকার নিখদ্দর বেকার কুটিরে
গার্মেন্টস পল্লী হতে শুরু হয়ে শপিং সিঁড়িতে
অফিস পাড়ায় আর কেরানীর গোপন পকেটে
হোটেল-মোটেল-পার্ক, শরণার্থী রোহিঙ্গা শিবিরে
সারি সারি মিলিটারি টহলে নেমেছে; দেখি
সৈনিকের হাতে কোনও মারণাস্ত্র নয়, ধরা আছে
বন্দুকের পরিবর্তে নিরাপদ স্যানিটাইজার,
মাস্ক মুখে হাঁটে খণ্ডখণ্ড ব্যক্তিগত নিরাপত্তা—
সামাজিক দূরত্ব বিধানে মানুষের আয়ু তাতে
যদি-বা নিশ্চিত করা যায়! একজন সৈনিকের
মাথার খোড়লে সারাক্ষণ পড়ে থাকে গুলিবিদ্ধ
স্বপ্ন নয়, লক্ষ কোটি মানুষের বিপন্ন হৃদয়।
০৯.
মানুষ মারার জন্য মানুষেরা বহু আগে থেকে
দেশে দেশে গড়ে তুলছে সশস্ত্র বাহিনী, দক্ষ যোদ্ধা!
এসব যোদ্ধার হাতে দেশ ও মানুষ রক্ষা পায়
বিদেশি শত্রুর গুপ্ত কিংবা প্রকাশ্য হামলা থেকে;
সর্বদা প্রস্তুত থাকে সৈনিকেরা—যেকোনো দুর্যোগ
মোকাবিলা করে থাকে অসীম সাহসে, এমনকী
জীবন উৎসর্গে তারা কিছুতেই পেছনে হটে না—
‘মার কিংবা মরো’–এই মন্ত্রে সব দেশে সৈনিকেরা
দীক্ষা নেয়—প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে, অন্য কোনো রাস্তা
খোলা নেই একজন পেশাদার সৈনিকের চোখে।
অথচ এমন এক মহাযুদ্ধে নিরস্ত্র সৈনিক
অদৃশ্য শত্রুর আগ্রাসন কিভাবে থামানো যায়
তা-ই ভেবে শঙ্কাহীন দিন রাত টহলে রয়েছে—
মানুষ বাঁচাতে তার এই কেমন অকুণ্ঠ সাহস!
১০.
মানুষের ইতিহাসে এই কেমন জন্ম-মৃত্যু খেলা!
করোটির মরা কোষে অস্বাভাবিক অমাবস্যার
লোকোচুরি দেখতে দেখতে যে-বালিকা ঋতুবতী হয়
মৃত্যুর বাংকারে মুখ গুঁজে পড়ে আছে দুধখোলা
সে-সরল গ্রামের কনেটি—যার জন্যে তৈরি হচ্ছে
অদূরেই লাশকাটা তাঁবু; অন্যদিকে বালুচরে
ম্রিয়মাণ জীবনের ফুটোনৌকো টানতে টানতে যার
জন্ম বৃথা, সেও শুনতে চায় সুজলা নদীর গান।
নতুন গর্ভের বীজ ফুলে-ফলে পল্লবিত হবে—
শূন্যতার কাটামুণ্ড খসে পড়বে শিশুর কান্নায়
প্রিয় স্বজনের মুখে দেখতে চায় সৈনিকের হাসি,
যে-সৈনিক হাসপাতালে বেডে শুয়ে আসন্ন মৃত্যুর
কথা ভুলে পুনরায় যুদ্ধে যাবে শত্রুর বিরুদ্ধে;
আবার ফুলের গন্ধে বাতাসের দরজা খুলে যাবে।