যে বৃক্ষ সহোদর আমার
চিনে রাখি এইসব রক্তযোনিছাপ। যে পাতা দখল করে
রেখেছে মাঘের দুপুর আর লালপিঁপড়ের লালা, চীৎকার
দিয়ে সূর্যও ফেটে পড়ছে আমাদের মাথার ওপর—আর
বলছে; থামাও সঙ্গম—হে নদী, হে জীবনের কালোপথ।
লিখে রাখি সেইসব বন্দিদের বনেদি নাম। যারা কারার
কপাটে ঘষেছে মস্তক, অবনত কৃষ্ণকাহনে সেরেছে পূজো
অভাগা পূজারীরাও মুক্তমাঠকে বৃষ্টির মন্দির ভেবে।
জানি আমার চেনা—লেখায় কিছুই যায় আসে না। প্রতারক
পর্বতের পাদদেশ ঠেকিয়ে রেখেছে আমার পৃষ্ঠদেশ। যে
পাতা আমার ছায়া হতো, ধর্ষণের দ্বিতীয় নোলক পরে
আজ তারাও ঝুলে আছে বৃক্ষে। যে বৃক্ষ সহোদর আমার।
বদলের বাদলরঙ
অনেকটা আদিম রজনী থেকে ঝরে পড়ছে মেঘ ।
যদিও কাম্য ছিল না, তবুও কামনার সমুদ্রে
ভাসাই সাম্পান। একদা ভিড়ে যাব সেই মগ্ন
মোহনায়—এই সান্ত্বনা নিয়ে খুঁজি স্বপ্নের মুখাবয়ব।
কখনো স্বপ্নগুলো ও বদলায় রঙ। আদিমতার উত্তরসূরি
হয়ে বেঁচে থাকে আধুনিকতা। অথচ আমরা পেরিয়ে
এসেছি বলে ভুলে যাই আমাদের প্রত্নঅস্তিত্ব। খোলা
আকাশের নিচে নিবাসের কথা। কিংবা ধূসর রঙের পত্রবসন।
প্রাচীন চন্দ্রের সান্নিধ্যে ফিরে যাই অন্ধ—অবকাশে
পার্থক্যের তরঙ্গ দেখে বুঝে যাই বৃষ্টি ও বারুদের মন
যখন আদিম ছিলাম, তখন যেমন ছিল হৃদপিণ্ড
এখনো তেমনি আছে ঠিক। শুধু বদলেছে দৃষ্টির ফটিক।
যে প্রেম ছিল কুসুমগন্ধ মাখা
আর বুনি না ফেরার প্রিয় তাঁত
আর খুলি না ঘরের তাম্রতালা
জানি সবই মেকি ঢেউয়ের জল
সবই ফিকে, ধূসর শব্দমালা।
অথচ এই প্রেমের ভুবন জুড়ে
ছিল বীণা, বাজতো আলোর ছলে
কেউ নামতো পদ্মপুকুর মাঝে
কেউ কবিতা শুনতো কালের কলে।
কলের গানে বেজে যেতো গান
বাঁশরিয়ার দুপুর চেরা বাঁশী
ডাকতো কাছে আঁকাবাঁকা পথে
পড়শীরা ও দেখে যেত আসি।
ডাঙা বুকে সেই নদীদের নাম
আমিও লিখে রেখে দিতাম পাশে
প্রতিবেশী ছিলাম কি না , তাই
যুগের কোলাজ সাজিয়ে অভিলাষে।
আঁকা আমার কাজ ছিল না জানি
তবু কেন মুখের দিকে চেয়ে
তোমার ভুরু আঁকতে গেলেই শাদা
শিশিরগুলো ঝরতো গণ্ড বেয়ে !
তা কি তবে কান্না ছিল কোনো
চৈত্রমনে বসন্তেরই দোলা
খুঁজে আগুন, আকাশ ছিদ্র করে
দেখছি চেয়ে প্রান্তপরত খোলা।
মিশে গেলে ইচ্ছে শস্যদানা
মাটিও তারে যে সহজ গ্রহণে
টানে বুকে দুঃখ ভুলে গিয়ে
নীলরঙা দিন অস্ত যায় উজানে।
আমার দুপাশে অস্তমিত রোদ
ফেরার বাসনা, গতায়ু ইতিহাস
যে প্রেম ছিল কুসুমগন্ধ মাখা
তা নেই তাই পাখির কারাবাস।
রোদের ঋতু
লাইনটা সোজা করে দাঁড়ান। বিদায়ের ঝড়বিন্দু
কুড়াতে কুড়াতে এই দক্ষিণ সমুদ্র করে যাবো ভ্রমণ।
আর ঋতুর শাদাত্বকে রেখে যাব কালের আঁচড়।
শিশুরা খেলতে এসে পেয়ে যাবে চৈত্রের পুষ্পভগ্নাংশ
আর অমিত বৈশাখি ভোরের লালছটা ।
এবং আপানার সোজা করুন আপনাদের মেরুদণ্ড
তাকিয়ে দেখুন, কী খোলা আকাশ আপনাদের ছায়া ,
কী রোদের ঋতু, আপনাদের ঐতিহ্য।
লাইনটা সোজা করে দাঁড়ান।
এর আগে আরেকবার চেয়ে দেখুন, পেছনের লাইনটাও
সোজা হয়েছে কি না!
মনে পড়ে আমাকেই
আজকাল আমার, আমাকেই মনে পড়ে খুব—
আর মনে পড়ে সেই সড়ক, যে তার নাম ভুলে
গেছে অনেক আগেই। সবুজ শুশ্রূষা পেয়ে সেরে
উঠেছে যে নগর, তার চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে একাকী
বেহালা বাজায় যে বিবাগী বাউল , মনে পড়ে তার
চাহনীর দূরমালা, কিভাবে স্পর্শ করে আকাশের মেঘ ।
আজকাল নিজের নাম লিখে বর্ণিল অক্ষরে সাজাই তার
চারপাশ। রঙ দেখে চিনি আলোর ইন্ধন। লাল – কালো
রূপের তপস্যা। দেখি খুব কাছেই নোঙর ফেলছে নতুন,
আত্মকেন্দ্রিক ভোরের ছায়া। আর পুরাতন বিকেলগুলো
কিছুই পারেনি ভেবে ক্রমশ হারিয়ে যেতে চাইছে পূবের
দিগন্তে। ভাবি, মানুষও তো এমনিভাবে হারায় নিজেকে,
ভুলে যায় নিজ নাম। তারপর স্মরণের বেলায়, পোষে পাখি
নাম শিখিয়ে, উড়িয়ে দেবে বলে ।