ফেরা
ছুটির পর থেকে আনমনা হাঁটছি—হয়তো কোনো এক প্রেমিক যুগলের হাসির স্ফটিকে বিকেল চৌচির; নয়তো উসখুস কোনো দম্পতির ভসকা আতরের হাওয়া মেখে নিচ্ছে মুখর পার্কের কোণার নিমগাছ। দূরের ঝাউবনেÑÑ বাদল বাতাসের শিরশিরানি মিড়ে আনন্দ কাকার একাকিত্ব সুর; রঙ্গনের ঝোপে দু’টি তরুণ প্রাণে কপোল-নাক-ঠোঁটে মাখামাখি আতর খোঁজে বুকের ’পর। টিফিন বক্সেও সমস্ত দুঃখ বৈকালিক রোদে পোড়াতে দিয়ে যায়… সাঁঝের ঝিঁঝি গান। একতারা জীবনেÑÑ আশ্রয় পালক খসে খসেই পড়ে, পাখিরাও ফিরছে…। পাতায় নির্বিষ রেখে ফেরে সবাই। ছুটি ছুটি বিকেলে আলগা সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে আজান, পলাতক শরীরে হৈহৈ মাতম। খোয়াবনামা ভুলেÑÑ মাদলের ঘণ্টা বুকে নিয়ে হাঁটছি… অজন্তা-ইলোরা, পেত্রার ধূসর অতীতে, চাপরাসি জীবন অর্থহীন হলে ঘরে ফেরার চাপে পানিশূন্য চোখ অন্ধ হয়ে যায়। ঠোঁটের ’পর ঠোঁটে কুশিকাটায় বুনে—মহাকালে চলেছি… চোখ বুঝে হাঁটছি, কবে যে হবে ফেরা!
ভিন্ন ভিন্ন আলোকায়ন
হেঁটে হেঁটে যে পথ গিয়েছে… অফিসের বারান্দা অবধি, তার দু‘পাশে কৃষ্ণচূড়ার থোক থোক লাল-রঙ-বিষাদ—এখনও চুয়ে চুয়ে নামছে সাদামাটা পথের ’পর—যেন অচেনা সাদা সাদা বিরহের পাতায় লিখে রেখেছে সাদা অক্ষরের চিহ্ন। তবু লু’বয়ে যায়—পায়ের-ই তলায়, শিরশিরানি বুকে চৌকো পার হয়! এই তো সেই পথ, এখনও পড়ে আছে অনাদি আহ্বানে… তিনি নেমে এলেন—ধীর, স্থির ও ধ্যানী বাতাস কানেকানে… ঝিরঝির পাতায় গোপনে বলে গেল—বারান্দার ওপারে বসে আছে আগামী। পথ যত মসৃণ থাকার কথা ছিল ততো শীতল নয়! আষাঢ়ের দুপুর ঘুমিয়ে আছে, পথে… অচেনা উলঙ্গ এক নারী-শারীরে… আচমকা বিঁধলো এক কাঁটা, ফুটে উঠল সাদা রঙের ক্যানভাস! অশরীর ব্যথায় ভিজল নীড়ঝোলা, লাস্য-দীর্ঘকায় উলুখড়ের চুল, শরীর ঢেকে দিল—রঙ-সাদা কাফন। শুভেচ্ছার ঢাক, করতাল বাজছে… অফিস চবুতরে…। ঝরা কৃষ্ণচূড়া পথে… বেলিফুলের ঘ্রাণ নিতে যাচ্ছি না, ক্ষমা করো নিয়তি—আর একটু থাকি, এ শ্মশান ভূমিতে… অন্য কোন পথে… ৫৬ হাজার বি-(চ)-ছিঁরিছাদে…
স্বপ্ন ও বিভ্রমে নৈসর্গিক যাত্রা
যেখানে দাঁড়িয়ে সূর্যের চলে যাওয়া, ঝাউয়ের আড়ালে সে অধোগতির ক্ষণিক বিভ্রমে একান্তই হারিয়ে যায়। আধ খাওয়া গলিত লাভার থালা—দৃশ্যের অন্তরালে সুটিটার্ন পাখির কোমল ডানা থেকে দু’একটি পালক তখন ঝরে যায়। পেন্ডুলাম আকাশ মেদুর মেঘের ছলকে তাতিয়ে তাতিয়ে দূর অদৃশ্যে দিশে পাঠায় এক একটি চিত্রকল্প। অদূরে সন্ধ্যাবাতির মৌন আলোয় পিছু নেয় লবণাক্ত খামিরের জল। অস্বচ্ছ ক্লান্ত জলের পরিপাটি নীরবতার ভেতর তাকিয়ে যখন নিজের দিকে ফিরে আসছে বারবার, তখন প্রাণের পাঁচ অস্তিত্বের চোখ সরে যায় মকরক্রান্তির অচলায়তনে। ভেঙে যাবার আগেই ভেঙে যায়—দিনান্তের উষ্ণীব আলো। জাহাজের মাস্তুল থেকে ভোঁ ভোঁ সাইরেন বেজেই যাচ্ছে… কিন্তু কোথাও যেন কিছু নেই, সাড়া নেই, শব্দ নেই, শব্দহীন নিস্তব্ধ খাঁ-খাঁ মরুভূমির এক আঁজলা আঁচল বিছিয়ে রেখেছে মানুষের অন্ধকার-ইট-পাথুরের বৌদ্ধিক মাদুর। তারারা যদ্যপি সুযোগ পেলে একান্তবর্তী চাঁদকে নিয়েও নেমে যায় বিনীত সন্ধ্যার দিকে… সেই অলক্ষ্যের অসীম শূন্যতার বুকে। যে শূন্যতার ভেতর অকিঞ্চিৎ আলোর চারিধার নিষ্প্রভ ও নির্লিপ্ত। চারকোল চা-বিকেলের পর থেকে কোথায় কতটুকু—কী রং লেগেছিল রং মিস্ত্রির ছোঁয়ায়! আর কতটুকু রং ঢলে পড়েছিল তুলি চুঁইয়ে পৃথিবীর ’পর। তা জানার আগে পাড় থেকে দূরে… ইঞ্জিনচালিত কিম্ভুতকার শব্দের ভেতর প্রিয়ার টংকার কর্ণ কুহুরে বারবার ধাক্কা দিচ্ছিল—সেই অবোধ বিবাহত্তোর বালিকার ছেঁড়া কান্নার অহংকার, যখন তীব্র-উষ্ণ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমাদের বুকে লুটিয়ে পড়ত হতবিহ্বল। আমরা চোখ বুঝে সমস্ত শূন্যতার কবিতা নিয়ে একা—শুধু একাই হেঁটে যাচ্ছি সমুদ্রের দিকে… যেখানে সমুদ্র একটি ভাসমান সরলরেখা এঁকে রেখেছে অপর যোজনায়।