ওজনের আত্মবিশ্বাস
কুয়াশার গভীরে লুকিয়ে থাকে সূর্যের ছটা।
পৃথিবীও সেই ছটায় দেখে নিজের মুখ।
আর যারা নিজেদের মুখ দেখতে ভুলে যায়,
. তারা নিজেদের পরিমাপ করে আগুনের ওজনে!
অথচ পোড়াবার দক্ষতা তারা ভুলে গেছে অনেক আগেই।
ওজনহীন যে হাওয়া মানুষকে শক্তি দেয় প্রতিমুহূর্তে;
মূলত তা’ই সূর্যের প্রথম আত্মবিশ্বাস। আর দ্বিতীয় বিশ্বাসটি
যখন প্রঘাঢ় হয়ে বুকে দানা বাঁধে—
. মানুষ তখন একান্তই প্রেমযজ্ঞে ধ্যানী হয়।
ভুলে যায় অনেক কিছু। সহিংস আগুন তখন আর
. তাকে স্পর্শ করতে পারে না।
বরাদ্দের মোহমাত্রা
আমার জন্যে বরাদ্দ করো কয়েকটি পাতার ভ্রমণ
যারা উড়ে যাবে এবং বদলাবে রঙ, তারপর
ঝরে পড়বে এই মাটিতে—
যেখানে আমি একদিন ছুঁয়েছিলাম মমি, অথবা
অনেক বিশ্বাসে গড়তে চেয়েছিলাম তৃতীয় বসতি।
আমার জন্যে সংগ্রহ করে রাখো কয়েকটি বিকেল
যে ক্ষণটুকু কেবল আমারই হবে—
. শুধুই আমারই,
যেখানে ভাগ বসাবে না কোনো পাখি, কোনো পতঙ্গ।
শুধু এই ঝরে পড়া লাল—হলুদ পাতাগুলো
আমার দিকে তাকিয়ে লিখবে পত্র। আমি পড়বো
কেবল পড়েই যাবো—কোনো উত্তর দেবো না।
আমার আঁচলে এঁকে রাখো এই ভাসমান রোদ,
হেমন্তের উজ্জ্বল দুপুরে যে সূর্য একাকি দাঁড়িয়ে থাকে—
আর জমা রাখে নিজের কিরণ,
এতটুকু ভালোবাসা পেলে আবার ভ্রমণে বেরোয় প্রাকৃতজন।
জাহাজ ও জতুগৃহ
তারপর এখানে—এইঘাটে ভিড়েছিল নোঙর। মানুষগুলো নেমে
পড়েছিল, জীবনকে সামনে নিয়ে, স্বপ্নকে সামনে নিয়ে, প্রেমকে—
বলেছিল—আবার দেখা হবে বিজয়ীর বেশে। এই লালভুবনে।
জাহাজকে সাথী করে যারা দেশান্তরি হয়েছিল, তাদের ভাগ্যকথা
অনেকটা এরকমই ছিল। লাল ছিল তাদের প্রিয় রঙ। সবুজ ছিল
তাদের প্রত্যয়ের দ্রাঘিমা। আর সংগ্রাম ছিল প্রতিদিনের দ্রোহতালিকা।
আজ আমরা যে জতুগৃহ দেখি, কিংবা যে ‘ওয়ান ওয়ে’—মহাসড়ক
ধরে খুঁজি সুখের সুড়ঙ্গপথ, তা হয়তো অনেকেরই কাম্য ছিল না!
তারপরও স্রোত জাগে, সময় জাগে, কেউ ভুলে যেতে চায়, কেউ—
যেতে চায় ফিরে, এতটুকু মাটিকে বুকে ধারণ করেই বলে, আমি
আসছি হে ভূমি, আমি ফিরছি কিছু ঋণ শোধ করবো বলে পুনরায়।
মানুষের ভিড় দেখলেই
মানুষের ভিড় দেখলেই বুঝি, কেউ কাঁদছে। কিংবা হুলস্থুল দেখলেই
অনুমান করি—কারা বহন করে নিয়ে যাচ্ছে মেঘের শবদেহ।
যে মেঘ বৃষ্টি হয়ে আমাদের আনন্দ দিতো, যে বৃক্ষ বাজাতো একক
টাপুর—টুপুর আওয়াজ।
সমুদ্রে ভাঙা বাঁশি ভাসতে দেখলেই বুঝি, কেউ ঝাঁপ দিয়েছে যৌথ
ভ্রমণ শেষ করে। কেউ ইতিহাস লিখতে বসে, অভিমানে পৃষ্ঠাগুলো
ছিঁড়ে উড়িয়ে দিয়েছে বাতাসে। আর দুঃখী মানুষের কান্না বয়ে বেড়াচ্ছে
অভিমানী চাঁদ। জ্যোতিগুলো হেলে পড়ছে।
মানুষকে আলোহীন দেখলেই বুঝে যাই, অন্ধকারগুলো আরও দীর্ঘস্থায়ী
হচ্ছে। যাদের কথা রাখার কথা ছিল—তারা যাপন করছে পলায়নপর
জীবন। মুখদর্শনের ভূমিকায় অবতীর্ণ আমাদের দূরদর্শনগুলোও পুরনো
আর্কাইভ থেকে বিলি করছে বেদনা আর হতাশা সিরিজ।
একটি চাঁদোয়ার গল্প
এই পৃথিবী আমাকে বহুবার শুনিয়েছে দিবস ও রজনীর গল্প।
ভয়ে আঁধারের দিকে তাকাবার সাহস না পেয়েই নিমগ্ন থেকেছি
আরাধনায়। আর বলেছি—এই সৃষ্টিকূল আবার ভাসুক
. মাতৃময় নক্ষত্রের ছায়ায় ছায়ায়।
এই সমুদ্র আমাকে কেবলই দেখিয়েছে তার ঢেউয়ের তাণ্ডব।
জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে এলো চুল উড়িয়ে দিয়ে বারবারই
খুঁজেছি সমুদ্রের মাতৃত্ব। পাখিরা শিকল ভেঙেছে—
. আর মানুষেরা গ্রহণ করেছে অকাল বন্দিজীবন।
আমি ভূমিকেই আমার জননী জেনেছি আজীবন। মায়ের হাত
ধরে যেদিন ভূমিতে দাঁড়াবার শক্তি পেয়েছি, সেদিন থেকেই
বুঝেছি; মাথার ওপর থেকে চাঁদ সরে গেলেও
. চাঁদোয়া হয়ে থেকে যায় শুধুই গর্ভধারিণীর আঁচল।
বিশ্বদেশ ঘুরে এসে
পাড়ি দেওয়া সহজ কাজ নয়। কিংবা পড়ে দেখা—
ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্ক;
যেখানে রক্তের দাগ লেগে থাকে—সেই দৃশ্য ভুলে
থাকা যায় না মোটেও। অথবা যে সড়ক, বিষাদ হয়ে
একদিন ঢুকে পড়েছিল গ্রামে। তারপর ছিটিয়ে দিয়েছিল
অনেকগুলো বারুদমিশ্রিত পাথর!
একাত্তরে আমাদের গ্রাম পুড়ে ছাই হয়েছিল,
একাত্তরে আমাদের পড়ার বই ভেসে গিয়েছিল নদীতে
আমার মা বলেছিলেন, যুদ্ধ শেষ হোক—
নতুন বই কিনে দেবো। যে বইয়ের রঙ হবে নতুন।
যে বইয়ে লেখা থাকবে নতুন ইতিহাস।
আজ আমি বিশ্বদেশ ঘুরি। সেই নতুন বইটির দিকে
তাকাই। এখনো নতুন এই ঘাসের ডগা! এখনো
নতুন এই পাখির গান, আর ভোরের কলতানগুলো।
আমাদের বৃষ্টিতত্ত্বপর্ব
তোমাকে গান শোনাবার কথা ছিল আমার,
কথা ছিল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে উড়িয়ে দেব
মুগ্ধ গোলাপের রেণু; বিশ্বের তাবৎ মানুষের জন্যে—
আর পিপাসিত পাখিদের জন্য জমিয়ে রাখবো
. কয়েক ফোঁটা জল।
তোমাকে কবিতা শোনাবার কথা ছিল আমার,
একদিন পৃথিবীর তুমুল ঝড়গুলোকে
একত্রিত করে পাথরকে শিখাবার কথা ছিল
ভাঙার কৌশল। যাযাবর নদীর মতো বেহিসেবী জীবন।
আমাদের আমূল বৃষ্টিতত্ত্ব লিখে রাখার কথা ছিল,
সকল বৈশাখের জন্য।সকল বসন্ত বিগত হলে—
যেমন প্রান্তরে পুষ্পের জন্য উৎসব হয়,
যেমন করে মায়ের মুখের দিকে তাকায়
. ধরণীর সকল সন্তান।
পুনরায় পাতালপথে
একটি দীর্ঘ ট্রেন চলে যায়। একটি থিতু হওয়া চাঁদ
পরিচয় করিয়ে দেয় নিজেকে আরেকটি চাঁদের সাথে।
মানুষ চাঁদের ভাষা জানে না। জানলে চাষা হয়ে নিজ
বাগানে চাষ করতো সম্পর্কের চাঁদ। বিতরণ করতো আলো।
পুনরায় পাতালপথে যেতে যেতে কথাগুলো আমার খুব
মনে পড়ে। মনে পড়ে, চাঁদ কুড়ানো সেই বালিকাবেলার গল্প,
বৃষ্টির ঝাপটাকে সামনে রেখে যে নৌকো উজান যায়—
তার যাত্রী হওয়ার অভিকল্প আর অভিজ্ঞতার বুনন।
অনেক কথাই লেখা যায় না। অনেক প্রীতি মিশে যায়
পাতার সাথে। যে সবুজ আমাদের চারপাশে প্রহরী হয়ে থাকে
জানি এরাও একসময় স্মৃতি হয়ে যায়,
আর রেখাচিত্রে নিজেকে সাক্ষী রেখে,নিজেরই প্রতিচিত্র আঁকে।
মৃত্তিকার মলাট
আমি অনেক আগেই জেনে গিয়েছিলাম, তরুণী ঘাসের অতীত
অনেক আগেই; পড়েছিলাম দ্বীপের দুর্ভিক্ষগুলো—
কিভাবে মানুষ অনাহারী থাকে,কীভাবে মৃত্তিকার মলাটে
নিজের ছায়া রেখে রেখে ক্রমশ এগোয় মেঘ।
জেনেছিলাম, বিচারক বৃক্ষের বেদনাবোধ। স্রোতের ওপারে
হারিয়ে যেতে যেতে যে নদী নিজের পরিচয় হারায়
তার ঠিকানা। জেনেছিলাম মূক মানুষদের ফিরে আসার গল্প।
কোনো সত্যই গোপন থাকে না—বলতে বলতে যে পাহাড়
তার বুক খুলে দিয়েছিল;
কিংবা যে নক্ষত্র অনেক অভিমানে লিখেছিল তার অতীত
আমি তার শুভার্থী হয়েই লিখেছিলাম চিঠি—
তোমাকে, উদার দুপুরের কিনার ছুঁয়ে ছুঁয়ে।
ভ্রাম্যভূষণ
কোনো বৃষ্টিই আক্রান্ত হচ্ছে না আর—
মানুষই মানুষের রক্তে কাটছে সাঁতার,
যারা এর আগে ভালোবেসেছিল, ফুল—প্রান্ত ও পরান
তারাও এখন হয়ে যাচ্ছে; পাষাণের চেয়েও পাষাণ
কী ভুলমন্ত্রে দীক্ষা নিচ্ছে জল, প্রতিবেশী পরিমল
এবং আমাদের ঘরঘিরে জমে থাকা আনন্দ সকল
আরও শান্তি চাই, চাই সৌহার্দ্য সাম্যের বাণী
চাই পাঁজরকে শুদ্ধ করে গড়ে তোলার এতটুকু জ্বালানি
যারা যাবে মিছিলে, অথবা যারা দিয়ে যাবে সজোরে ডাক
এসো না—সমবেত হই। শুধুই সমবেত;—এই কথাই থাক।