গড়াই নদী
আমার যৌবনবতী জননী নদীটি কোথায়
আমার যৌবনবতী গড়াই নদীটি কোথায়
নদীস্তন পানে একদিন জেগে উঠত সবুজ ফসলের মাঠ
নদীমুখ মুগ্ধতায় ভেসে বেড়াত কাব্যভেলা গ্রাম-নগর
আমার স্বপ্নপাপড়ি পানসি নৌকার ঢেউখেলা নদীটি কোথায়
খোঁপাভাঙা রমণীর মতো ঢেউবতী পরমা নদীটি কোথায়
আমার নদীটি যেন যৌবনেই যৌবনহারা বুকপোড়া সরলারমণী
আমার নদীটি যেন দুগ্ধহীন শুকনো বুকের কঙ্কালসার জননী
আমার নদীটি যেন যৌবনবতী মায়ের যৌবনপোড়া দুঃখকথা
আমার দু’চোখ ভরে থাকা বর্ষাসুখের কেবলি মৃত্যুউৎসব
আমার যৌবনবতী জননী নদীটি কোথায়
আমার যৌবনবতী গড়াই নদীটি কোথায়
আমার উন্মত্ত মাতাল ঢেউখেলা নদীটি কোথায়
ভরাট লোমশ বুকে দাপিয়ে বেড়ানো বাঘা যতীনের
নদীটি কোথায়
শরৎশশীর জীবনআঁচলে বাঁধা শিশুর সাথে খরস্রোতা প্রবল যুদ্ধ
‘তোমাকে ব্রিটিশ তাড়াতে হবে—যুদ্ধ করো যুদ্ধ শেখো’
ব্রিটিশ তাড়ানো যুদ্ধযৌবন তৈরির সাহসিকা নদীটি কোথায়
আমার যৌবনবতী জননী নদীটি কোথায়
আমার যৌবনবতী গড়াই নদীটি কোথায়
ঋষিকবি রবি ঠাকুরের মুগ্ধবতী বিচিত্ররূপী গড়াই নদীটি কোথায়
‘ছিন্নপত্রে’ পাতায় পাতায় ছড়ানো মুক্তোজ্জ্বল গড়াই নদীটি কোথায়
যে নদীর বুকে ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর’
যে নদীর বুকে ‘ভজন পূজন সাধন আরাধনা’ ঘরের কোণে মুক্তি
সেই নদীটি কোথায়—ইটপাথরের সড়ক কেন নদীর বুকে
আমার যৌবনবতী জননী নদীটি কোথায়
আমার যৌবনবতী গড়াই নদীটি কোথায়
গড়াই নদীতে ভেসেই লালন হয়েছে ছেঁউড়িয়ার—
মানবতা ধর্মবার্তা যেন তিনি দিলেন ছড়িয়ে নদীর
ঢেউয়ে ঢেউয়ে
গাঁয়ের পর গাঁ— দেশ-বিদেশ দূরের সীমানা— সময় গেলে
সাধন হবে না…
পড়শীর কাছে নদীর স্রোতে সাধনকথা
আমার যৌবনবতী জননী নদীটি কোথায়
আমার যৌবনবতী গড়াই নদীটি কোথায়
লাহিনীর জানালায় নিস্তব্ধতা ভাঙা নদীটি যেন পাড়ার চঞ্চলা
চোখে চোখে লেগে থাকা কিশোরিকা— মীরের বুকে কাব্যিকাপ্রণয়
গৌরী গভীরতা ছেনে যেন আঁকলেন রূপের ভয়ংকরতা—
‘বিষাদ-সিন্ধু’ আজো কথা কয় বেদনা সংগীতে
মীর সাহেবের জানালার সাথে লেগে থাকা নদীটি কোথায়
এ কেমন আগুনে বুক পোড়ে সুদর্শনা বালিকার…
আমার যৌবনবতী জননী নদীটি কোথায়
আমার যৌবনবতী গড়াই নদীটি কোথায়
প্রখর স্পর্ধায় যেন অগ্নিফণা হয়ে উঠত কাঙালের সংবাদ
কেঁপে উঠত জমিদারের ভেতর-বাহির
নদী ছাড়া আর কে পারে এমন করে রক্ত-আগুন জ্বালাতে
সেই স্পর্ধার শাণিত স্রোতে দুর্বার আঘাতে ফুঁসে ওঠা
নদীটি কোথায়
দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রবল ভয়ার্ত ফণাধারী সেই নদীটি কোথায়
কার অভিশাপে পোড়ে চেতনাশাণিত নদীতিকা বুক
আমার যৌবনবতী জননী নদীটি কোথায়
আমার যৌবনবতী গড়াই নদীটি কোথায়
অগ্নিফণা তোলা বিষধর গোখরার মতো মরণকামড় কৌশল
কী অদ্ভুতভাবে শিখিয়েছিল একদিন যৌবনা শরীরের মতো নদীটি
নদীর গভীরে নদী থাকে—জীবনের গভীরে জীবন—
ঘরের ভেতরে ঘর
জারজ বলে যাকে দিচ্ছ ছুড়ে সে তোমারই সন্তান—উত্তরাধিকার
সাহসিক উচ্চারণে বানালেন ‘অবাঞ্ছিত’
নদীতীরের আকবর হোসেন
যৌবনবতী নদীটি ছাড়া আর কে পারে জ্বালাতে এমন বারুদ
আমার সেই সাহসিকা যৌবনা জননী কোথায়
আমার সেই যৌবনবতী নদীটি কোথায়…
প্রহসনের খেলায় নবাবের নির্মম পরাজয় ও মৃত্যু এখনো নদীর
গভীরে গভীর বেদনাস্রোত— বুকের পাঁজরে কেঁপে ওঠে রক্তকান্না
গড়াইয়ের তীর ঘেঁষে দাঁড়ানো তেবাড়িয়ার মৈত্রীয়র
রক্তস্নাত ‘সিরাজউদদৌলা’—গৌরীজল যেন
হয়ে ওঠে সিরাজি রক্ত
একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা কত সোনার ছেলে এ নদীতে
ভেসে গেছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল
পবিত্র রক্তস্রোতধারা জননী নদীটি কোথায়
আমার প্রিয়তমা পরমা নদীটি কোথায়
কোন রাক্ষসী গিলে খায় আমার স্বপ্ন মৌতাত বর্ষাযৌবন
সবুজ জমিন
মিথ্যে প্রেমের মধুকথায় কী অদ্ভুতভাবে দখল করে নেয়
আমার যৌবনবতী মায়ের দুগ্ধভরাট বুক
আমার যৌবনবতী জননী নদীটি কোথায়
আমার যৌবনবতী গড়াই নদীটি কোথায়
শিলাইদহ কুঠিবাড়ির চিঠি হাতে নদীতীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে
স্রোতের মতো হেঁটে যায় আপন মনে বাঁধা
‘আমার মনের মানুষ যে রে’ মায়াবী কণ্ঠে গগন হরকরা
আমার এমন মধুর কণ্ঠভরা জননী নদীটি কোথায়
আমার দলিলে কেবলি একটি রহস্যস্বাক্ষর জেগে থাকে—
আমার গড়াই নদীটি আবার যৌবনবতী হয়ে উঠবে…
একটি সাধারণ ছবি
খুব সাধারণ মানের একেবারেই সাদাসিধে একটি ছবি
কী এক অদ্ভুত শক্তিতে
ধরে রাখে আমাকে গভীর সুতোবন্দি করে
একটুও যত্ন নেই ছবিটির কোথাও
শুধু নিখাদ মাটিতে দাঁড়ানো যেন কাঁচাবালিকা মুখ
পুষ্পিতা পাপড়ি ছড়ানোছিটানো
মায়াবী দু’চোখে যেন মেঘভরা কথার পালক—
উড়ে আসে ভেঙে ভেঙে
আমাকে অনেক কথা বলে যায় কোনো কথা না বলেই
ছবিটা কি রঙিন প্রজাপতি নাকি দোয়েলিকা পাখি
মনের অরণ্যে ওড়ে নিজমনে বাঁধা আপন সংগীতে
নাকি কবিতার রহস্যঈশ্বর জীবনছন্দে দুলে ওঠা
সুন্দরিমা স্বর্ণ ফসলের মাঠ
আমি কী যে মল্লিকা মুগ্ধতা নিয়ে ডুবে থাকি
ছবিটি কি তাহলে নদী অথবা সমুদ্র
আমাকে এ কোন স্রোতে টানে—
আষাঢ়ের বন্যা কীভাবে চেনে সে…
খুবই সাধারণ মানের মধ্যবিত্ত পরিবারের অষ্টাদশীর
সাদাকালো ছবি যেন
একটুও প্রসাধনের ঘষামাজা নেই— নগরীনাবিলার
ঘ্রাণ নেই বসনে— কোনোরকমে
একখণ্ড কুচকুচে কালো মৈথিলী মেঘের মতো একমুঠো চুল
ছড়িয়ে রয়েছে ঢেউবতী বুকের কার্নিশে
আনমনে কখনো হয়তো সে নিজেই নিয়েছিল টেনে…
কোথায় দেখেছি যেন—
কাহ্নপা নাকি বড়–চণ্ডীদাসের ঘরে—মনে পড়ে না
শিলাইদহ নাকি লালনের মাজারে—গভীর ধ্যানে খুঁজি
পথ ভেঙে পথে পথে—‘আমার মনের মানুষ যে রে…’
এই দেশের সবুজ প্রেম
এই দেশের সবুজ প্রেম—কাদামাটি মন—আলপনা আঁকা রঙধনু ছবি রেখে
সরল মাটির সবুজ আঁচল ফেলে, বৃদ্ধ পিতার অসুস্থ চাহনী পায়ে ঠেলে
ভোরের শিউলি বিছানো উঠোনে পূর্বপুরুষের পায়ের নিখাদ নিশ্বাস ফেলে
বিরানে পুড়িয়ে মায়ের মমতা— যাব না—যাব না, কোথাও যাব না।
এখনো এদেশে মৃত্যুযাত্রী ভূমিপুত্রদের ব্যাকুল পিপাসা থাকে মধুর মা ডাক;
অবারিত সবুজের এই দেশ—এই মাটি ও নদীতে মিশে আছে
ভেসে আছে বাতাসে ঢেউয়ে সবচে সাহসী ভাই—যৌবনা কুসুম বোন;
আমারই ভূখণ্ড কিনেছি যে আমারই বুকের কঠিন পাটাতন ভেঙে।
একতারা সুর—নদীর কিনার—আলপথ দুর্বাঘাস পায়ে পায়ে মেখে
হেঁটে যাই মুগ্ধতায় কান পেতে অলিগলি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল;
আমি এ মাটিতেই থেকে যাবো সঞ্চয়িতা সঞ্চিতা বুকের মরমে জড়িয়ে
মাটির মেঝেতে শীতল পাটিতে শরীর বিছিয়ে সুখনিদ্রা স্বর্গের চেয়েও দামি।
আমি বাঁচি মুক্তিযোদ্ধার গায়ের গন্ধে পবিত্র নিঃশ্বাসে সাহসী তরীতে
আমি বাঁচি বৌদ্ধ খ্রিস্টান হিন্দু মুসলমান ভাইয়ে ভাইয়ে বুকে বুক মিশে;
সব রক্ত একই সাথে মিশে থাকি পদ্মা মেঘনা যমুনা একই স্বপ্ন সাম্পানে;
প্রেমের গোলাপ ফোটে মান-অভিমানে বেলা অবেলা জীবনভেলা।
তামাটে শরীর এই মাটিতে বানায় ফসলের গান,
পূর্ণিমায় ডুবি বাউলের গানে— নতুন সকালে বুক পাতি প্রাচীন সাহসে
আপন সত্তায় পলিমাটি উর্বর যৌবনে চাষ করি কবিতার;
‘বউ কথা কও’ ব্যাকুল আকুতি সাদাসিধে সুখীঘর ভালোবাসি বাংলাদেশ।
প্রতিটি শব্দ প্রতিটি নিশ্বাস
কবিতার শব্দগুলো আমাকে দূরের গল্পে বহু দূরের
কথা বলছে—অতটা ভালোবেসে
আর কে কবে জড়িয়েছে
কবিতার প্রতিটি শব্দ তোমার নিশ্বাস দিয়ে জড়ানো
অন্যরকম এক নকশিকাঁথা
তোমার হাতের স্পর্শ কাঁচাবালির মতো নতুন করে জেগে ওঠে
তোমার কবিতা থেকে অদ্ভুত এক জীবন জেগে ওঠে
যে জীবন জীবন থেকে খসে গেছে কবেই
তোমার চোখের আলো দিয়ে যে শব্দপুঞ্জ গেঁথেছে
আমি তার ভেতর থেকে এক মানবীযমুনা চিনে নেই
যৌবনা শরীরে সাধারণ শাড়ি পরা
অপার্থিব এক লাবণ্য স্রোতের মতো তোমার কবিতার
সারা অঙ্গে—খুব গভীরভাবে আমি দেখি
তোমার কবিতা তোমার থেকেও অধিক রূপশ্রী হয়ে
জেগে ওঠে—গোলাপের লাল পাপড়িতে
কতটা বেদনা থাকে— সেটুকু জানার বাসনা নিয়ে
তোমার কবিতা যখন পড়ছিলাম
জীবনের খাতায় তখন পোস্টমর্টেমের কাটাছেঁড়া
তবুও মানুষ জেগে ওঠে
তোমার যৌবনা সুন্দরের থেকেও অনেক বেশি সুন্দর
একটি কবিতার জন্ম উৎসব
কবিতার প্রতিটি শব্দ তোমার নিশ্বাস দিয়ে জড়ানো
অন্যরকম এক নকশিকাঁথা