প্রিয় কবিতা প্রসঙ্গে দুটি কথা
প্রিয় কবিতা বাছাই করা কঠিনতম কাজ। অনেক শিল্পোত্তীর্ণ কবিতাও প্রিয় না হতে পারে। আবার অনেক সাধারণ কবিতাও প্রিয় হয়ে উঠতে পারে তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কোনো আবেগ বা স্মৃতিকাতরতার কারণে। এখানে যে পাঁচটি কবিতা নির্বাচন করেছি, সেগুলো আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সমুদ্রপৃষ্ঠা’ থেকে নেওয়া। কবিতাগুলো শৈশব আর কৈশোরের আবেগ, স্মৃতি আর প্রেম-বিরহকাতরতায় ভরপুর।
কবিতার জন্মপ্রক্রিয়া সৃষ্টিজগতের খুবই রহস্যময় একটা বিষয়। একে নির্দিষ্ট কার্য-কারণ সম্পর্কে বেঁধে রাখা মুশকিল। ঘোরগ্রস্ততার মধ্য থেকে বেড়ে ওঠা একটা কবিতা সম্পর্কে কবির নিজের ধারণাও তাৎক্ষণিকভাবে স্পষ্ট না হতে পারে। কবিতাটি শেষ পর্যন্ত কী হতে যাচ্ছে বা কোথায় পৌঁছুতে চাইছে—এ বিষয়ে তার স্রষ্টাও নিশ্চিত না থাকতে পারেন। এমনও হতে পারে যে, লিখে ফেলার কয়েক বছর পরে এসে সেই কাব্য সম্পর্কে কবির মনে একটা স্পষ্ট বোধ তৈরি হয়েছে। এখন, আমরা যদি ধরে নিই যে এটি প্রকৃতই একটি ভালো কবিতা, তাইলে অবধারিতভাবে কিছু প্রশ্নেরও জন্ম হয়—কবিতাটির জন্মপ্রক্রিয়ার সময়ে পুরোপুরি অনুধাবন না করেও কবি কীভাবে এটি লিখতে পারলেন? কিংবা কবি যদি ভবিষ্যতে এসেই এর বোধ সম্পর্কে জ্ঞাত হবেন, তাইলে এটি লেখাকালীন স্থানিক-কালিক বাস্তবতা বা পরাবাস্তবতার সাথে এই ভবিষ্যতের যোগসূত্রটা কীভাবেই বা ব্যাখ্যা করা যাবে? এ বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করা সত্যিই কঠিন। কেউ যদি এরকম উত্তর দেন, কবিতাগুলো নিজে নিজেই এমন হয়ে উঠতে চেয়েছে, এখানে কবির হাত-মস্তিস্ক-স্বপ্ন-কল্পনা-আবেগ শুধুই উছিলা মাত্র, তবে কি এই উত্তর খারিজ করে দেওয়া যাবে? না। আর এখানেই কবিতার চিরন্তন রহস্যময়তা। কথাগুলো এ কারণে বলা যে, আমার এসব কবিতার ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। এগুলো প্রিয় হয়ে ওঠার এটাও একটা কারণ।
টিএস এলিয়ট বলেছিলেন, ‘Jenuine poetry can communicate before it is understood.’ আমিও তা বিশ্বাস করি। একটি প্রকৃত কবিতা কোনো পাঠক না বুঝতে পারেন, কিন্তু এটি তার মর্মকে স্পর্শ করবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়।
‘চিঠি’ লেখা হয়েছিল শৈশবের স্মৃতিকে কেন্দ্র করে। আব্বা অঙ্ক শেখানোর সময় ঠিক এই উদাহরণটিই দিয়েছিলেন। আমার কোমল মনে কষ্ট জেগে উঠেছিল—বেঁচে থাকা পাখিটা তো একা হয়ে গেল। আর এই ব্যথাটা মনে গেঁথে থেকেছিল বহু বহু দিন। এই ব্যথার সঙ্গে পরবর্তীতে যোগ হয়েছিল কারো স্কুলে না আসা জনিত কারণে সৃষ্ট আরেক ব্যথা। স্মৃতিটা প্রায়ই মনে জাগত, কবিতায় ধরার চেষ্টাও করতাম। অবশেষে কোনো এক শুভক্ষণে ধরতেও পেরেছিলাম।
‘সংবেদনা’ কবিতাটি শিক্ষকতায় থাকাকালীন লেখা। স্কুলের দিকে মেয়েরা যখন দল বেঁধে আসত, তখন মনে হতো একগুচ্ছ লাজুক ধান দল বেঁধে ক্ষেতের দিকে এগিয়ে আসছে। এখানে মাছ-পাখির রূপকে ছাত্রী-শিক্ষকের আধো স্রদ্ধা-আধো প্রেম-আধো ভয় জনিত সম্পর্কের রহস্যময়তা উঠে এসেছে।
‘দুঃখ’তে বাঘ আর হরিণ, এই দুটি প্রতীকের মধ্য দিয়ে, মানবদুঃখের যে-বিমূর্ত রূপ, তার এক ধরণের মূর্তায়ন ঘটেছে। এখানে এও দেখা যাবে যে, একটি কবিতা কীভাবে তার কাঙ্ক্ষিত নৈঃশব্দ্যে উপনীত হচ্ছে। এ-কবিতা লেখার স্মৃতিটি ঠিক খেয়াল নেই। তবে এটুকু শুধু মনে আছে—এক ভরা দুপুর…আর আমার জানালা খোলা ছিল।
‘ফার্ন’ কবিতায় কৈশোরের মুগ্ধতা আর মোহাচ্ছন্নতা, সেই সঙ্গে বিরহের বিবশতা উপলব্ধি করা যাবে। এও দেখা যাবে যে এক কিশোরী ফার্ন গাছের ভঙ্গিতে বসে রয়েছে। আর সে জাসদের মতো দৌড়ে এসেছে। জাসদের প্রসঙ্গটা পাঠককে কৌতুকপ্রবণ করে তুলতে পারে। স্পাইরাল-দিনগুলো পাঠককে ভাবাবে মনে হয়। হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোতে আমরা কে কাকে কী নামে ডাকতাম তা ঘাই তুলতে পারে মনে পুকুরে। আর একটা পুকুর ছিল স্কুলের পাশে। তাতে এক কিশোর ভেসে উঠতে চেয়েছিল কারো নাম-নিদ্রাসহ। আর সেই চিঠিগুলো… ধূসর ছেঁড়া বইয়ের ভিতর ঘুমিয়ে থাকা চিঠিগুলো… কিংবা এমনও হতে পারে কেউ কোনোদিন কোনো চিঠিই লিখেনি… সবই স্বপ্ন কেবল…হতে পারে।
‘পায়ে বাঁধা দুটি সর্বনাম’ এই পাঠক হয়তো মনোযোগ দেবেন এই লাইনের প্রতি—‘তোমাকে জড়িয়ে ধরে মনে হলো ধান’। জড়িয়ে ধরার সত্যতা বা বাস্তবিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু জড়িয়ে ধরার ফলে ধানের যে-ব্যঞ্জনা পাওয়া গেলো তা অন্য কোনো পৃথিবীর। এখানেও ঘুরেফিরে স্কুল…নিচু ক্লাসের এক কিশোরী। আর ‘পায়ে বাঁধা দুটি সর্বনাম, পাখি উড়ে যায়’-এ যেন এক ব্যাখ্যাতীত সুন্দর। এসব সুন্দর আর প্রিয়তা নিয়েই এ জীবন। জয়তু কবিতা।
চিঠি
আজ বাবা অঙ্ক শেখাচ্ছিলেন।
বললেন ধরো, ডালে বসা দুটি পাখি থেকে
শিকারির গুলিতে একটি পাখি মরে গেলো,
তবে বেঁচে থাকলো কয়টি পাখি?
অঙ্কের বদলে এই মন চলে গেল
বেঁচে থাকা নিঃসঙ্গ সে-পাখিটির দিকে,
আর মনে এলো তুমি আজ স্কুলেই আসোনি।
সংবেদনা
দল বাঁধিয়াছি কালো চোখের অক্ষরে।
পরিচয় দিবসের ঘ্রাণে
সংবেদনার রক্তে আমি জবুথবু, মহাকাল,
লাজুক ধানের মতো ছাত্রী ভেসে আসে।
বই খাতা হাতে
রুল-করা আকাশের দিকে চোখ, আর,
একটি মাছ ভালোবাসে একটি পাখিকে।
দুঃখ
রাতের প্রতিভা-কণা তুমি
কত না সহজে তুমি খেয়ে ফেলো ভোর।
ভোরের আলোতে শ্লোক ভেঙে
লোকালয়ে নেমে আসে বাঘ।
দুঃখকে লুকিয়ে রাখি আমি
রক্তের ভেতর,
আর বলে ফেলি, মামা,
আমাদের ঘরে কোনো হরিণ ঢোকেনি।
ফার্ন
তুমি খুব জাসদের মতো দৌড়ে এসে
ফার্ন উদ্ভিদের মতো বসে আছ পুকুরের তীরে।
বাদলি করেছে মনে ঘনঘোর স্পাইরাল-দিনে।
আমি এ অঞ্চল ঘুরে, তোমাকে খুঁজতে,
অপ্রাপ্তবয়সের ন্যায় রাঙা কোনো
সূর্যাস্তে নেমেছি।
যদি নাম-নিদ্রাসহ ভেসে উঠি আজ
উড়ন্ত স্কুলের পাশে, জলে?
পরস্পরকে কী নামে ডাকতাম মনে পড়ে?
রাত্রে, তোমার ধূসর গ্রন্থে রাখি হাত,
অন্ধ পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে নিয়েছে কে?
আহা! অপ্রাপ্তবয়সে তুমি চিঠি দিয়েছিলে।
পায়ে বাঁধা দুটি সর্বনাম
নিচু এ কৌতুকে আজ মজে গেছে মন
বিস্তৃত অনাগ্রহের প্রতি উড়ে এলো মেঘ
তোমাকে জড়িয়ে ধরে মনে হলো ধান
মনে হলো উৎসব: জন্ম ভেঙে
. দূর দূর অন্ধ দ্রাঘিমায়
নিচু ক্লাসে পড়ো! আহা!
চুলে এত রৌদ্র-কুমকুম, চোখ যেন সমুদ্রপৃষ্ঠা,
টেনে নাও আমাকে তোমার ছত্রে ও ছায়ায়
পায়ে বাঁধা দুটি সর্বনাম, পাখি উড়ে যায়…