পান্ডুলিপি
বৃষ্টি আর স্তব্ধতার মাঝে
অলৌকিক ময়ুরের নাচ
কুয়াশার বুদ্বুদের
গভীরে উঠেছে জেগে
অর্ফিউসের বিষাদ মাখা মুখ
এদিকে ইফ্রেতিসের নীল জলে
হাতছানি দিয়ে ডাকে মরীচিকা
অর্কেস্ট্রায় বাজে অর্গান; ক্লান্তির
বিধুরতা লেখা হয় সাগরবেলায়!
কোনো এক নগ্ন-নির্জন রাতের
গালিচায় মিহি হাওয়ায় যখন
দোদুল্যমান-উদ্ভ্রান্ত জেটি
জীবন সায়াহ্নে গূঢ়লিপি
এঁকে চলেছে নিভৃত
নিঃস্বপ্নের মুহুর্মুহ ধ্বনিগুলো
আর মত্ত-মাতাল গাঙচিল শুধু
দূর থেকে দূরে উড়ে যায়,
দেহের সায়রে কাঁদে
উন্মাদ ঈশ্বর;
ঘোর আকালের দিনে
নাছোড় মৃত্যুকে বুঝি ছুঁতে চায়!
কবেকার সেই পুরাতন
মাস্তুলে এখনো সমর্পিত হয়
নীলাভ তরুণ পাল, আর
আলোর ঝলক তোলে
একাকিনী মেঘের উদাসী বুকে
চারিদিকে ঘিরে থাকে
অরণ্যের বিদেহী নিঃস্বাস
অবিকল গাছের মতোই
ত্রিবর্তুল অঙ্গময় কায়া, সেখানেই
সমস্ত মানস থেকে জন্ম দিতে চায়
বোধ ও বেদনাময় প্রলুব্ধ সভ্যতা!
এইসব ভাবতে ভাবতে
কার্তিকের শীতের সকালে
এমনই আলস্য দিনে
বাসনা-নির্যাস মেখে
ঝিমধরা স্মৃতিকে উসকে দিতে
আবারও লিখে চলেছি
অসমাপ্ত এক ছায়া ছায়া পাণ্ডুলিপি…
ডম্বরু বাদক
একটি ডম্বরু রাস্তায়
মরে পড়ে আছে,
তাকে যে বাজাতো
সে কোথায় হারিয়ে গিয়েছে
কেউই জানে না;
প্রথমে ডম্বুরুটির চামড়া মরে গেল
তারপর একে একে মরে গেল
চামড়ার টোপোলা গাঁঠি, ছাল;
সেই সাথে মরে গেল
সব সুর ও ঝংকার!
খুলে এল সুতোয় বাঁধানো
বাজানোর পাথরও,
ডম্বরুটি যে বাজাতো
সেই বাদক এখন মরে পড়ে
আছে রাস্তায় অথচ
বিদেহী ডম্বরুটি এখনো
পথে পথে ঘুরে ঘুরে
বাজিয়ে চলেছে তাকে…
শপথ
একটি নদীর কাছে যেতে
চেয়েছিলাম যার জলের রেখার
গহীন অন্ধকারে দহন লেখা থাকে,
লেখা থাকে উন্মাদ চাঁদের হাসি
অঝোর বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু স্বেদ
অপার্থিব গানের তরঙ্গ
আর আলোর কত্থকে
অবিরাম সে নৃত্য কী এক অপার্থিব
উজ্জ্বলতা ধরে রাখে!
প্রজ্বলিত আগুনে ঝলসানো হিয়া
হৃদয়ের ঘরে ঝড় তোলে
এভাবেই তবু তোমাকে চেয়েছি
দেবদূতির উজ্জ্বল কালো চুলে
বিলি কেটে কেটে
এমনই এক ব্যথাতুর চোখে
আমার হাসির চেয়েও অদ্ভুত!
অথচ বিমর্ষ অথবা বিহ্বল হয়ে
থাকা আত্মার মাঝখানে
ওহ! তোমার কী নিদারুণ নীরবতা!
অথচ আমার চেতনার মধ্যে
নির্মিত শপথ;
বারবার ভেঙে ভেঙে যায়
আবার নতুন করে জন্ম নেয়
এমনই এক রক্তঝরা রাতে।
ইলিউশন
ক্রমাগত বন্ধ করে চলেছি দুয়ার
অতীত পাহাড় হয়ে তবু
ফিরে আসে কাছে
ঐ জ্যোৎস্নাঘেরা রাতে!
ইলিউশন ! এক দুর্বোধ্য জীবনে?
আমি শঙ্খচিল হয়ে শুয়ে থাকি
নৈঃশব্দ্যের জলরঙে,
বিষণ্ণ কঠিন গুল্মবনে,
আর অবাক তাকিয়ে থাকি
ভ্যানগগের স্ট্যারি স্ট্যারি
নাইটের দিকে,
রিলকের সাথে হেঁটে যাই
সেই তটরেখার দুর্গচুড়ায় দেখি
বারুদের কুণ্ডলী পাকানো,
স্বচ্ছ ক্রিস্টালে ঝলসে যায়
দুচোখের ঘুম; আর
চৈতালি প্রেমের ভ্রান্তছায়া
হয়ে বসে রয়েছে যে বনভান্তে
তার সাথে বেধেছি জীবন
এক গন্তব্যহীন ট্রেনের কামরার ভেতর
খুঁজে চলেছি টর্চের আলো হয়ে
ধূসর রেখার মতো প্রবঞ্চক অলিগলি…
স্মৃতির কঙ্কাল
তুমি চোখ বুজে থাকো
শুধু স্মৃতিভ্রষ্টের শিয়রে,
অথচ চিতার আগুনেই হয়
সবটুকু মৌনতার পতন!
অন্ধকারে যখন গোপনে
রাগ বাগেশ্রী করুণ
সুরে বাজে কোমল ধারায়
তখন পাহাড় থেকে তীব্র অবগাহনে
আশ্চর্য জলপ্রপাত গলে গলে
এপিটাফের বাণী হচ্ছে জাফরান নদী;
অথচ আমি এখন ক্রমাগত
ছায়ানৃত্য দেখি
স্রোতের প্রান্তিক কুয়াশায়
দেখতে কি পাচ্ছো—
কত কত ছায়ামূর্তি
মৃত চিঠির মহল ফেলে
চলে এসেছে তোমার ছবিঘরে ?
আর উপত্যকার বালুকা
খুব ঘন হয়ে জমছে তোমার
আছোঁয়া দামী ক্যামেরার লেন্সে;
যতবার স্ন্যাপ নিতে চাই —
লুকিয়ে লুকিয়ে তবু
পাশে এসে বসে আর শুধু কথা কয়
অযাচিত সব স্মৃতিরকঙ্কালগুলো!