মেগাস্থিনিসের হাসি
নিঃশব্দ কামানে তুমি একা বসে ভরছো বারুদ।
শীতকাল গেলো;
নিঃশব্দ কামানে তুমি একা কেন
ভরছো বারুদ?
আমি ভাবছি:
মেগাস্থিনিসের হাসিও কি মেগাস্থিনিস?
শক্তিচালিত এই তামাশার মধ্যে বহু
বাদামি ঘোটক উড়ে যায়
—এঞ্জিনের শব্দ আর রোবটের কাশি শোনা যায়।
নিঃশব্দ কামানে তুমি এখনো কি ভরছো বারুদ?
শীতের দৈত্য
কেননা তোমার দ্বারা আমি সৈন্যদলের
বিরুদ্ধে দৌড়াই,
আমার ঈশ্বরের দ্বারা প্র্রাচীর উল্লঙ্ঘন করি’
স্যামুয়েল ২২/বাইবেল
আর দ্যাখো, ভৈরবে মেঘনার তীরে আমি বাদাম ফলাই
আর, শাদা বালুর ভেতরে হাত গলিয়ে
ক্রম-বর্তুল বীজের স্নেহ কুড়িয়ে চলি—ধীরে,
কুলিয়ারচর থেকে মাছ আর
তাদের সম্ভাবনাময় তরুণ ডিমগুলোকে
উপহার হিসেবে পাঠাই নানাদিকে
নানা রিরংসাঘন শহরের ঠিকানায়
অসংখ্য বনঘুঘু আর পায়রার লাশ মাড়িয়ে
আমাকে পৌঁছাতে হয় তোমার উঁচু প্রাকারঘেরা শহরে
সেখানে ঝাঁ-ঝাঁ রোদের ভেতরেও
করমর্দনের উষ্ণতাগুলো হয়ে আছে
ঠাণ্ডা-হিম ঘুমন্ত কামান
আর, প্রেম সেখানে ছেঁড়া ও পুরনো তাঁবুর ভেতরে
মৃত্যুর তরঙ্গবেষ্টিত
দূর, ধ্বস্ত, মলিন, কাতর মফস্বলে আমি থাকি!
রাত্রির অসংখ্য মরা নদী উজিয়ে ভাবি:
স্মৃতি-ভস্মের ধু-ধু প্রান্তর পেরিয়ে
বিপুল দামামাসহ আমি আবার
এক শীত থেকে অন্য শীতে
তোমার ক্রুর সৈন্যদলের পেছনে দৌড়াবো
মেরুন রাতের ডায়েরি
তোমাকে খুঁজতে এসে ঝর্নার কিনারে গিয়ে দেখি
সমস্ত জঙ্গল ঘিরে টুস্কে পড়ছে কালো রাত
সাঁকো নেই, চতুর্দিকে নদী;
জলের ডানার নিচে ওঁতপাতা হাঙ্গর, কুমির।
তদুপরি ভয়! মাংসলোভী কাফ্রিদল
ছুরি আর অজস্র মুষল নিয়ে ঘোরে
তবু আমি তোমাকে দেখার লোভে
সকল গাছের দৈর্ঘ্য মেপে মেপে ওপরে উঠেছি;
চাক্ষুষ প্রমাণহীন সেই ছবি জ্বলবার আগে গেছে নিভে!
তবু আলট্রা মেরুন রাতে একটি ইঁদারা তার সাক্ষ্যে টলোমল
হে গরুড়, ক্ষিপ্র ওজনহীন ডানা
তোমার স্ফটিকজলে শুয়ে আমি দেখবো আকাশ
অবসরে কনুইবন্ধের নিচে
মদেচুর লাটাই নাচাবো।
ক্রমহননের পথ
অপাপবিদ্ধের মতো জোড়া জোড়া চোখ দেখে ভয়;
এই বুঝি রিরংসা নামের কোনো বিস্ফোরণ ঘটে।
তবু নিথরতা;
দূরে ট্রেন চলমান, ঝাউবনে স্রোতকল্প দোলা।
এসো, তোমাকে উদ্ভিন্ন করি রাতপরিদের নামে
ইন্দ্রিয়ের ক্ষমজলে, তরল ক্ষীরের মতো
গলমান নির্বেদের স্রোতে।
সহস্র তীরের শব্দ, শত হুল তোমার পেছনে
তুমি একা। তাতে ভয়!
ভয় বুঝি সংবেদনের কোনো ডানা?
তাহলে উড্ডীন হও, উড়ে চলো বনের ভেতর
ক্রমহননের পথ পাড়ি দিয়ে দ্যাখো,
ঘাসে ঘাসে সিঁড়ি চলমান। পর্বতের ধাপে ধাপে
মনুষ্যখুলির ছায়া প্ররোচনা আকারে সাজানো;
আর দ্যাখো, জলের আঙুলে আঁকা চিত্রময়
শুয়ে আছ তুমি।
তোমাকে ঘিরেই জাগে শত শত দেয়াল, প্রাকার
ক্রমহননের পথ আমাকে বেষ্টন করে
ঝুঁকে আছে তোমার ওপর!
মধুব্রজনের জ্যামিতি
মধুবসন্তে আমরা রওয়ানা হলাম উৎপ্রেক্ষার বাড়ির দিকে
পথে উপমার গিরিখাতে তুষারে আটকে গেলো আমাদের গো-শকট
আর চলমান পায়ের মর্মর
আহা! এখানে অনুপ্রাসের মতো বয়ে গেছে পর্বতচূড়া
এখানেও উপমার আক্রমণ;
ব্যাজস্তুতির বাঘ নেচে বেড়াচ্ছে
গজদন্ত-ছড়ানো নৃশংস অরণ্যপথে
আর এই আপাত সরোবর সে তো
স্বপ্নহননের শীতল চাকুতে ভরা
বরফ গলার প্রতীক্ষায় আমাদের মদ শেষ
অপচয়িত সকল যবদানা;
শুধু হাওয়া এসে বলে যায়: ‘অপেক্ষা ভালো
রানি আসবে তার উচ্ছ্রিত ঘোড়ার বাহনে চড়ে!’
জানি না কী করে পেরোতে হয় কেওক্রাডংয়ের পথ!
—ডানায়, জেব্রার পায়ে না কি উড়ে?
শুধু আধোঘুমের ভেতর গতায়াত করছে
চিত্রকল্পের পাখি আর টুসুগানের সুর
কেবলি ঢুলছি আর হাই তুলছি
রক্ত-সরোবরের জলে কেউ শানাচ্ছে শীতল চাকু
কেউ আঁকছে জ্যামিতি!
তন্দুরের পাশে বসে
হেরাক্লিতাসের নদীতে, দ্যাখো, ভেসে চলেছে
অটোহানের লৌহ-ময়ূরেরা;
সকালের রেস্তোরাঁয়, দ্যাখো, টনকে টন গমদানা
ফুলে উঠছে সূর্য-তন্দুরের আঁচে
চাঁদের ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে স্বচ্ছ-শাদা মেঘ
আর, স্বনির্মিত ভুট্টাবাগানের মধ্যে
উবু হয়ে আছেন বিনয় মজুমদার!
মনে পড়লো তাকে
যখন আত্মধিক্কারের মতো মাথা নাড়ছে ঝাউবন;
পাতারা অকারণেই ঝরছে আর দিনভর
কেশে চলেছে ভূতগ্রস্ত আশ্চর্য মেশিন!
কত রকম তাস উড়ছে বাতাসে
চাষাধরা কলে ক্রমশ ভরে উঠছে আমাদের রক্তপলিটান;
আর, কবি দাঁড়িয়ে আছেন জ্বলন্ত গ্যাস বার্নারের সামনে
অহো, সিলভিয়া প্লাথ! নিজেকে পোড়ালে তুমি কাচের মতো!
—নড়ে উঠলো ভ্রম-দুর্বিপাক!
যারা পেরিয়ে এসেছ বহু ট্রাফিক-সংকেত
তাদের কার কী চেহারা?
কে তৈলাক্ত ভুট্টার প্রচারক আর কে নিজেরই পাখা
ঠেসে ধরেছিল উনুনে?
আপাতত তন্দুর থেকে কী বেরোয় দ্যাখো;
দ্যাখো, কোথায় ঘাপটি মেরে আছে ধাঁধা
‘লুনাটিক ইছাইলামে’ কে গো তুমি রয়েছ তন্ময়!
কী তোমার অভিজ্ঞতা এই নগ্ন তন্দুরের পাশে?
আগুন নিভলো কি না দ্যাখো,
দ্যাখো, দিনের আশ্চর্য রুটি কার দিকে প্রথমে দৌড়ায়!
ভুষণ্ডির কাক ও মেয়ে-কোকিল
কথার গাছ! তার বাকল তার হরিৎ পাতার
ঢাকনা খুলে ক্ষুৎকাতর পিঁপড়েদের ডেকে
বলবো: নাও, এই নিবিড় রোদনভরা গাছ
এই করুণ ফলসা পেড়ে বর্ষাঘন দিনে
এর রসে ভেজাও ঠোঁট, কাতর করো একে;
মধু ও বিষে গড়িয়ে নামে কম্প্র বিদ্যুৎ
মেঘের তাস ছড়ায় তার অনেক অঙ্কুশ;
শালের বনে শাবাশ-জরি, মাভৈ: চিৎকারে
গানপাগল মেয়ে-কোকিল চিরকালের বনে
ক্লান্ত হয় আবার ডাকে রক্তগীতময়;
গোপন থাবা, নখ ছড়িয়ে ভূষণ্ডির কাক
তার বুকের তন্ত্রী ছিঁড়ে তার গানের কলি
ঠুকরে খায় এই প্রাতে, পৌরাণিক রাতে;
গান থামে না, মরা কোকিল আবার গেয়ে ওঠে
জলপাইরঙ লাটিম ঘুরছে
লাল গম্বুজ, সৌম্য মিনার, লেলিহান মেঘে
নিঝুম শান্ত এমন বিকেলে, খাগড়াবনের
আবছা আড়ালে, শরশয্যায় কুরুক্ষেত্রে
তুমি কি আসবে শ্রীমতী সন্ধ্যা?
তোমার কোর্টে বল ছেড়ে দিয়ে
গুলশান থেকে ভূতের গলিতে
কাঠবেড়ালির লাশ নিয়ে বুকে
প্রহর গুনছি
তুমি কি আসছ?
তুমি যদি আসো
রাত্রিকে আজ আর ডাকবো না
দূষিত নগরে বকুল ফোটে না
উদাসীন গ্রহে ভদ্র-শ্বাপদ
জুলজুল চোখে, দাঁতে-নখে হাসে
রাষ্ট্রের ডিমে তা দ্যায় পুলিশ
—তা দিয়ে কিসের বাচ্চা ফোটায়?
খাকিরা এখন কামান দাগছে
নিরু কি বাজায়?
নিরু কী বাজায় দগ্ধ নগরে?
জলপাইরঙ লাটিম ঘুরছে
শহরের পথে, চাঁদের ফাটলে
মেঘ পুড়ে যায়, ঝরনা শুকায়
সবাই দেখছে
—কেউ দেখছে না!
রাষ্ট্রের ডালে জলপাই ঝোলে
ঝুলছে ঝুলুক, এ-নিয়ে ভেবো না
যা কিছু ভালো সবই ওনাদের
বাগানের ফল, জলের মৎস্য, এই নিসর্গ
নারী ও মদিরা, পায়রা-কোকিল, শক্ত বুটের ক্ষমতা মহিমা,
সরাইখানার আয়নায় আঁকা পীনপয়োধরা
পাতা-মর্মর, জল-কুজ্ঝটি, ডুমুর-বকুল
মদির পেয়ালা, কোমল পুতুল, আগামীর ভ্রূণ
ভাগ্যিস তুমি ধরা দাওনিকো
পাতার আড়ালে স্তব্ধ পেঁচার
স্থির চাহনির মতোন এখনো
ছদ্মছায়ায় আবছা আবছা
রয়েছো এখনো অ্যাম্বিগিউয়াস্!
রয়েছো এখনো ব্যক্তিগতই!
রাষ্ট্র জানে না, পুলিশচক্ষু তোমাকে চেনে না
ডুবো নৌকায়, তাঁবুর ভেতরে
কী ক’রে আজো রয়েছো লুকিয়ে!
আমিও এখন রয়েছি লুকিয়ে
খাগড়াবনের আড়ালে নগ্ন
কাঠবেড়ালির লাশ নিয়ে বুকে
নিজেই শিকার, নিজেই শিকারি
বকুলরিক্ত দুষিত নগরে
কোকিল এখন ডাকছে নিজেকে
গলায় রক্ত ঝরিয়ে কেবলি
আয়না এবার দেখছে নিজের
ভাঙা ও চূর্ণ মুখচ্ছবি
লাল গম্বুজ রম্য মিনার
কাঁদানে মেঘের ক্রুশে বেঁধা পাখি
…তবুও গাইছি—পুড়ছি আগুনে
সব ব্যথা ভুলে তবুও হাসছি
নিজেরই রক্তে ভেসে যেতে যেতে
দ্রুতলিখনের হাতছানিতে
ডাকছি তোমায়
…শরশয্যায়
. …কুরুক্ষেত্রে
জন্মান্তর
নিজেকে সরিয়ে দূরে, আলগোছে,
গাছের গোপন কোনো ডালে রেখে আসি;
নানা রকমের হাওয়া, রোদবৃষ্টি হিম-কুয়াশায়
পাখি এসে ঠোকরায়। ভাবে:
পেয়েছি কেমন ফল। বোঁটকা-ঘ্রাণ।
তবু কাছে টানে!
মৃত্যু-অশ্রু-হাওয়ার নিস্বন থেকে
তৈরি হয় গান। বাজে পাতার মর্মর
বিশাল ছাতার নিচে।
হয়তোবা আনে শিহরণ
পরিযায়ী ডানা;
নিজেকে ঘুমন্ত রেখে, ছায়ারূপে, বেরিয়েছি
সূর্যহীন কান্তারের পথে
নিচে গিরিখাত, নিচে পতনশীল হিমবাহের
ভেতর দিয়ে আধো-ভোরে নৌকা চলেছে একা।
বুঝিবা তারও গায়ে এসে লাগছে
বাঘের লাল ক্ষুধার আঁচ;
আর এখানে, এই সূর্যহীন অচেনা প্রদেশে, এই মৃগমদ-লালায়িত দেশে
অপণা মাঁসের পানে ছুটে যাচ্ছে তীর-ভল্ল, পাশুপত সহস্র বৃশ্চিক। আর
চতুর্দিকে জমে উঠছে রক্ত-ফেনিল শুধু শিকার! শিকার!
রক্ত-মাংসপরিতৃপ্ত শকুন-চিতা-হায়েনাদের ঘুমের বুদ্বুদ নিয়ে
নবদশাপ্রাপ্ত এই পৃথিবীতে ফিরে আসি যদি,
নিজেকে কি ফিরে পাবো
এরকমই চেনা রোদে, পাতায়-ছত্রাকে মেঘে মেঘে?
এ-আমার লুপ্তদেহ ধূমায়িত পাতার শিহরে!
আলকেমি
এ-হাসি আমার। তবু সে আমাকে ছেড়ে
অপরের গণ্ডদেশ আলো করে থাকে;
যেন আমি নিষেধ না-মানা কোনো মাছ
সবার অলক্ষ্যে ভেসে এসেছি এখানে;
আমাকে ঝুলিয়ে রাখে অন্য কোনো ধীবরের জাল
অপর দেহের রক্তে কেউ এসে মেশায় আমাকে
ব্যাখ্যাহীন আলকেমি! রাশি রাশি সন্দেহ-তুষার
মেঘ-রৌদ্র-নিশাদলে ধূমায়িত গূঢ় অম্লজান
লক্ষবীজ ফলের আকারে আমাকে ফলায় গাছে গাছে;
সমুদ্রযোনির গর্ভে যেন আমি মন্ত্রপূত শুশুকের ভ্রূণ!
দুর্লঙ্ঘ্য প্রাকার আর উচ্চাবচ পাহাড় পেরিয়ে যায় পাখি;
সুমেরু-কুমেরু তাকে টেনে নেয় চুম্বকের মতো।
তাকে ডাকে উত্তমাশা অন্তরীপ
আর ঘন নীল আসমান;
—ডাকে আমাকেও;
তার গর্ভে থাকি আমি
সে আমার ভেতরে বাঙ্ময়;
—বিমূঢ় বিব্রত; তবু
বিহসিত নীলে আত্মহারা
ঈর্ষার এঞ্জিন
(সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের জন্য)
ঈর্ষার এঞ্জিন গরজি ওঠে আজ; ঘুরছে মঞ্জুল মেঘাঙ্কুর;
ঘুম এক চিৎকার! আকাশে চুনিলাল সূর্য-ক্রন্দন ঝরায় খুন।
উন্মাদ চায় তার অধরে অনিবার স্বর্গবেশ্যার স্তনাগ্র।
কোন্ মন্কির কোন্ নকিরে লেখে মোর কোন সে-পাপ কোন অধর্ম?
অন্ধের তন্দ্রায় ক্রমশ খসে যায় রাত্রে বর্তুল ডালিমফল;
জন্মের-জঙ্ঘায় অঝোরে ঝরে মেঘ;—ফুটছে ফুল এক অলক্ষ্যে।
নিঃসীম কান্তার ঘুমে ও তৃণে পার। রজ্জুপথ—দূর—গভীর ডাক;
এক-ক্লোন-চণ্ডাল ঢুঁড়েছে পিপাসায় নফ্সে আম্মার—কি লান্নত!
বোর্রাক জন্মায় জেগেছে চিঁহি তার; শুনছে তন্ময় মদনটাক!
লোল্জিভ রাক্ষস আঁধারে খুঁজে যায় কূর্মপৃষ্ঠের আ-নীল মদ।
আর কার চরকায় কে এসে ঢালে তেল কার আপনজন কে কার পর?
রক্তিম জল্লাদ চেয়েছে রতি আজ বন্য রাত্রির আলিঙ্গন।
কোন মান্দাস কোন গরলে অচেতন ভাসছে ঘুম-নীল লখিন্দর?
কোন মৎসীর লেজ নিমেষে হয়ে সাপ বক্ষে বিষদাঁত ছোবল দ্যায়?
এক হিঙ্গুল মুখ ক্রমশ জোড়া চোখ ফুটছে ঘোর লাল এ-রাত্রে!
ঝঞ্ঝার মেঘ ধায় ছুটিয়ে ঘোড়া তার হানছে মৃত্যুর অপস্মার!
আজ তোর স্কন্ধের গরিমা খসে হায়! ছিন্নমস্তার তাথৈ নাচ!
মনসুর হাল্লাজ জপেছে দমেদম মাংসে মজ্জায় ‘আ’নাল হক্’
ষণ্ডের তিন শিং খুঁজেছে যোনিকূপ অন্ধ মুদ্গর আসন্ধ্যা
বল তোর উড্ডীন ডানাটা চাটে কোন ধূর্ত জম্বুক—মানিক মোর!
শিশ্নের উদগম! পেতো যে উপশম জাগতো হররোজ বালার্ক
ছম্ছম্ রাত্রির বেভোলা পথিকের রক্তে রম্ভার রতির স্রোত
চুপ-শ্যাম দাঁড়কাক দ্যাখে না কোনো চাঁদ উষ্ণ ফল্গুর সে-উদ্গার!
শয্যায় চুপচাপ দু’জনে দুটি লাশ ক্লান্ত, প্রেমহীন, নিরুত্তাপ!
স্পন্দন শেষ হায়! নদীতে ভেসে যায় কার গো কার লাশ মুখের ডৌল?
অস্থির খুর তার কাঁপিয়ে গিরিপথ রক্তে চঞ্চল ঘোটক ধায়।
হায় কোন খঞ্জর বাঁকানো খরশান চায় ঘুমন্তের লোহুর মদ?
দুগ্ধের নির্ঝর নোনা এ-শরাবের পাত্র উপচায় আ-সৎকার।
দিলখোশ পক্ষীর ঠোঁটে যে ধরা মাছ তারচে উজ্জ্বল কে ঝল্মল্?
স্পর্শের বিদ্যুৎ ছড়িয়ে কুহরণ রাত্রি বন্ধুর—উড়ালময়!
নিষ্ফল পুষ্পল কাননে মদালস জমছে হিম-নীল লিথির জল
বঙ্কিম চন্দ্রিম হেরো হে, এ-আনন—একটি ফল্গুর একুশ মুখ!
সুনসান প্রান্তর!—তবু কে কুহু গায় শূন্য মঞ্চের নেপথ্যে?
তবলায় তিনতাল বেজেছে অনিবার নৈশযুদ্ধের আমন্ত্রণ!
অদ্ভুত বর্ষার জঘনে ঝরে নুন লক্ষ তীবরীর তীরাস্ত্র।
ভঙ্গুর মুখ যার বোতলে ভরো তার তপ্ত নিশ্বাস ব্যথার ক্ষার।
পঙ্গুর ঈর্ষার কত না গুরুভার মৃত্যু-মুদ্রণ আকৈলাস!
অদ্ভুত পিঞ্জর পাখিরে ফিরে চায় স্বপ্ন-সম্ভব অলিন্দে;
মর্মের সংক্ষোভ বেদনা হাহাকার করছে মশগুল ভূমণ্ডল
ডুম্বুর পুষ্পের স্মরণে অনিবার মন্দ স্পন্দন এ-অঙ্গার!
বীতশোক ফিরে এসো
১.
বিকেলের করোটিতে সন্ধ্যারাগ ঢেলেছে আগুন;
জ্যোতিরথে চোখ রেখে চেনা পথ শান্ত পায়ে হেঁটে
নিজেকে শুনিয়ে কোনো গূঢ়কথা, গোপন মর্মর
বীতশোক, চলে গেছে। পশ্চিমের প্রত্যন্ত প্রদেশে।
আমার ‘সামান্য ক্ষতি’?–বিপর্যয়! খসে পড়ে ফল!
বহুঘুম-রাত্রিব্যেপে অনৃত ঢেউয়েরা!—তরী ডোবে!
২.
পুরাতন বিষণ্নতা, গোপনে যে আঙুরলতায়
ফল রূপে পেকে ওঠে, সারারাত তস্করের ভয়ে,
শুষ্ক তৃণে ঢেকে তারে সযতনে দিয়েছে প্রহরা।
৩.
প্রত্যহের দুঃখ-দৈন্য বেদনা ও ক্লেশে—হয়তো সে–
বসন্ত-রুধির এনে চেয়েছিল কিছুটা মেশাতে;
–যেন নীল প্রজাপতি এসে তার কাছে চায় মদ;
অধীর মক্ষিকা শুধু দ্রাক্ষা মেগে উড়ে উড়ে চলে।
৪.
সন্তর্পণে একা বসে পানপাত্রে দিল সে চুমুক;
লম্বা ঢোক গিলে নিয়ে স্তনলোভী শিশুর নিয়মে
আলগোছে মৃগনাভী ভরেছে উদকে–স্বার্থপর!
‘শিশির-চোঁয়ানো রাতে, মধ্যদিনে দহনের শেষে’
অন্যরা ঘুমিয়ে ছিলো?—এ-সুযোগে হলো সে কর্পূর?
৫.
হেমন্তের মঞ্চ থেকে গরুড়ের ছড়ানো ডানায়
অতর্কিতে চড়ে বসে শরীর সারাতে গেছে–দূরে।
কত দূরে? কাউকে বলেনি; শুধু উপশমহীন
অনন্ত গোধূলিপথ ছেয়ে আছে হলদে পাতায়!
–এই তবে গূঢ়লেখ? বৃথা তব নর্তকী ও মদ?
৬.
বীতশোক, তুমি আছ! অনন্ত পশ্চিমে না কি পুবে?
অসম্ভব ভুলে থাকা; লিথিজলও স্মৃতিসমুজ্জ্বল!
অফুরান দ্রাক্ষা থেকে অন্ধকার প্রশীর্ণ আঙুলে
নিজের ভিতরে, চুপে, শমদায়ী পেড়ে আনো ফল?
৭.
বিকেলের করোটিতে সন্ধ্যারাগ! জ্বলছে আগুন!
ফিরে এসো সেই পথে;–ঝরাপাতা-মুখর সরণি–
কিছুটা যবের মোহে, কিছু প্রেমে, শর্করার টানে।
৮.
উপশম হলো ব্যথা? পিঞ্জিরার ভেতরে পাখির?
দ্রুত তবে চলে এসো, পরিত্যক্ত আঙুরের বনে;
অনন্ত গোধূলিপথ ভরে দিয়ে পাতায়, মর্মরে।
গোলাপের জন্ম
[আল মাহমুদ স্মরণে]
ধূলিধূসর এক অচেনা উপত্যকার ঢালুতে আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। জেগে উঠে দেখি, সহযাত্রীরা আমাকে ফণীমনসার ক্যানোপির নিচে ফেলে রেখে গেছে। বিধবাদের রজঃশোষক ত্যানার মতো নেতিয়ে পড়ে আছি; ভ্রমণক্লান্ত, ক্ষুৎকাতর একা আর নিঃসহায়।
কোন ভাষায় যে কথা বলতাম এখন আর মনে নেই। মাথার ওপর মৌমাছির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে নানান অচেনা ভাষার অবোধগম্য শব্দেরা। চারপাশে ষাঁড়ের শিশ্নের মতো লাল-লাল উঁইঢিবি আর মরীচিকার ঢেউখেলানো কুহক।
জলবিভ্রম নামের এক বিভীষিকা আদ্যন্ত ঘিরে আছে আমাকে। আমার কাতর জিহ্বাকে তা করে তুলেছে আরও তৃষাতুর, বিশুষ্ক-করুণ।
গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে তিনটে আবলুশরং ধাড়ি ইঁদুর পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে; কুতকুতে চোখে তারা আমাকে দেখছে অসীম কৌতুকে। তাদের তাচ্ছিল্যভরা দৃষ্টির চাবুক প্রহার করছে আমাকে। আর এক ভয়াল খড়্গের নিচে রোরুদ্যমান এ-আমার পিগমি-দেহ। তাতে একে একে গজিয়ে উঠছে উপদংশের কষগড়ানো বীভৎস লাল ক্ষত।
এখানে এই ক্যাকটাস-কলোনিজুড়ে মুহুর্মুহু অজস্র রঙের বিস্ফোরণ। ঈশানে ফণীমনসার উদ্যত বিভীষিকা। নৈর্ঋতে কর্কট ব্যাধি আর নৈঃশব্দ্যের লাল তর্জনী। এরই নিচে চুপসে যাওয়া স্তনের মতো বয়ে চলেছে আবছা এক ক্ষীণতোয়া নদী।
আকাশের গোপন কৌটা থেকে আলগোছে আবির চুরি করে অস্তাচল-কিনারে বসে একমনে নিজেকে রাঙাচ্ছে এক একচক্ষু দানব; একসময় সে তার প্রকাণ্ড লাল চোখটি টুপ্ করে ফেলে দেবে পশ্চিমের পার্পল মেঘের নিচে; কাল আবার একে সে কুড়িয়ে নেবে উদয়-প্রহরে।
তার বিষণ্ন অক্ষিগোলকে বাক্য ও মনের অতীত এক সন্ধ্যা নামলো ধীরে; এর ভেতরের নৈঃশব্দ্য যেন কুণ্ডলি পাকানো এক র্যাটল স্নেক। এই ভাঁজময়, এই বল্মীকূটময় বক্র উপত্যকার নিচে অজগরের মতো নিঃশব্দে নড়ে উঠছে এক আলকাতরার নদী। যার নাম রাত্রি।
এসবের মধ্যে বসে থাকতে থাকতে ভুলে গেছি সঙ্গীদের মুখ। কানে কেবল পতঙ্গের অস্ফুট পাখার শব্দ; খদ্যোতের নেভা আর জ্বলা এফোঁড়-ওফোঁড় করে চলেছে রাত্রিকে। ওপরে নিকষ কালো গালিচাটাও কোন ফাঁকে চলে গেছে এদের দখলে; আদ্যন্ত আলকাতরা-মলিন আর ফসফরাস-ঝলকিত, আদি-অন্তহীন, অগ্রপশ্চাৎহীন সেই অনন্ত গালিচা।
আর কিছু নয়; কেবলই মনে পড়ছে তোমার হারিয়ে ফেলা মুখের ডৌল আর টোলপড়া গালে মদির হাসি। তাতে ফলে আছে তিলের সৌরভ; তাতে স্বেদকণা জমে হয়ে উঠেছে নিঃশব্দে-গড়িয়ে-চলা এক নদী!
চিবুক থেকে গ্রীবা, গ্রীবা থেকে স্তনের উপত্যকার দিকে ক্রমধাবমান সেই ধারা। দু’পাশে ঈষৎ আনত লাবণ্যের দুটি চূড়া; চূড়াশীর্ষে কেউ সযত্নে বসিয়ে দিয়েছে দুটি রসে ভরা জামফল। যা অতিশয় স্বাদু আর আমন্ত্রণময়; আর তা ভবিষ্যকালের ইশারামণ্ডিত; আর তা কামনামদির।
কিন্তু সে-দুটি বাসনারক্তিম, সুপক্ক জামফল চিরকালই থেকে যাবে সাধারণের নাগালের বাইরে;
যে চায় সে পায় না; যে চায় না, সে শুধু পায়!
দ্যাখো, তোমার স্মরণে আমার লোমকূপে জেগে উঠছে অসংখ্য গুজপিম্পল। চেনা ভাষার কোনো শব্দ উচ্চারণে অপারগ আমি। এখন আমাকে ঘিরে ধরেছে ভাষাহীনতার নৈকষ্যকুলীন অরব অন্ধকার। কিন্তু ঈষৎ ঝুঁকে থাকা এ-দুটি তসবিদানায় চুম্বন করবার পর আমি আবার উচ্চারণ করতে পারছি তোমার নাম।
কেবল তোমার নাম!
কেবল তোমার নাম!!
কেবল তোমার নাম!!!
যতবার উচ্চারণ করছি, ততোবার মাটি থেকে পাক খেতে খেতে উৎক্ষিপ্ত হচ্ছে এক লাল ঘূর্ণি। তোমার নামে স্যালুটের ভঙ্গিতে স্থির হচ্ছে নেত্রকোণা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর বিস্তীর্ণ ভাটিবাংলার সবক’টি গোপাটঘেঁষা জঙ্গলে নৃত্যরত দইগলের লেজ।
দোয়েলকে আমি আবার ডাকতে শুরু করেছি ‘দইগল’!
মগরা, খোয়াই, ডিঙাপোঁতা আর ধনুগাঙের ওপর থমকে থাকা মেঘের কুচি থেকে তোমার জন্যে ছড়িয়ে পড়ছে অসংখ্য অদৃশ্য পাপড়ির লাবণ্যসংকাশ।
আল মাহমুদ,
আমাদের বিস্মৃতির ধুলা সরিয়ে একদিন মৃত্যু নামের কালসর্পের ফণার ওপরে উড়ে এসে বসবে এক প্রজাপতি। যার অপর নাম প্রেম।
এভাবেই উপদংশের ক্ষত থেকে প্রতি ভোরে জন্ম নেবে শতশত আশ্চর্য গোলাপ!