পাখিদের ভাষা
নদীর ঘুম ভাঙিয়ে জলের সামনে দাঁড়াই, ক’ফোঁটা ঘুমে
ফুলের ভেতর জেগে থাকে কাঁটা, পাতার ভেতরে গাছ—
গাছের নাভীমূলে জলের নৃত্য, বলিরেখা—
ভাসতে ভাসতে কোথায় চলে যায় মানুষ, ঝরাপাতায়?
পাখির পায়ের তলে ভাগ হয়ে গেছে সময় ও শস্যদানা—
এই নাগরিক গুহাবাস, পৌরাণিক প্রণয়—
প্রতিরাতে পাখিটির দুটি ডানা দু’দিকে ভাগ হয়ে যায়
একটি তোমার দিকে
অন্যটি নদীর দিকে
জলের কিনারে বসে আমি সেলাই করি পাখিদের বর্ণমালা
আকাশে উড়বার কথা বলে যে আমাকে শিখিয়েছিল ভাষা।
বিনিদ্র পুষ্পের গুঞ্জন
বহুবার আমি ফিরিয়ে নিয়েছি পাখির ছানার মতো বৃক্ষের শরীর, পত্রপুষ্প ঘ্রাণ—
অথচ কোন কোন বাগানে অযথা ফুটে থাকে নির্জন গোলাপ—
ফুল ভেবে পাথর কুড়াতে কুড়াতে দেখি—
গাছের শরীর ঘেষে বয়ে গেছে সাপ ও পাথরের ঘুম
মৃত্যুমুখর প্রস্ফুটনের কোলাজ।
ফুলের পৃষ্ঠে আমাদের এই শহর ও নদী,
পাতায় সেঁটে আছে নিদ্রাফুলের মতো মঞ্জুরিত বারান্দা,
যাওয়া-আসার সাঁকো, পাখনা—
ঝরে গেছে ফুল ও পাথরের ব্যালকনি, পথে পথে কাঁচঘর,
ঢেউতোলা জানালা, নুড়িপাথর—
কার মুখ ভেসে ওঠে জলের গম্বুজে? নিমফুল ও পরাগে?
পাখির ভূগোলে কেন পুষে রাখি স্মৃতির নহর? বিনিদ্র পুস্পের
গুঞ্জন, ব্যথা?
মৃত্যুমুখর উদ্বাস্তু ঘুম
একদল সবুজ বৃক্ষের বেড়ে ওঠা দেখতে দেখতে
পাড়ি দেই সহস্র পাতার মৃত্যুমুখর উদ্বাস্তু ঘুম,
সূর্যপতন ভেবে জাগিয়ে রাখি দূরের পাহাড়, সমুদ্দুর,
দৌড়ের ভেতর বসে থাকি—বসে বসে দাঁড়িয়ে থাকে গাছ
অনেক বছর ঘুরে এই এক তিল দাঁড়িয়ে থাকা
অনেক পাখির জীবন শেষে এক টুকরো হাওয়া।
বৃষ্টি বুকে নিয়ে যে মেঘ উড়ে গেছে নারীর স্তনে
তার কি জানা আছে ঘুমের নামতা!
ঘুমিয়ে থাকতে থাকতে যে রাত্রি হয়েছে পাথর
সেও জেগে আছে—মুখে নিয়ে ব্যথার ট্যাবলেট।
অনেক অশ্রু পুড়ে একঘটি জলের কৌতুক; মানুষ।
অন্যমানুষ
চলে যাওয়ার সময় বার বার পেছনে তাকাই—
যদি কেউ ডাকে শেষবার!
ছায়ার মতো হাত নাড়ে—
যদি বলে—ফিরে এসো!
হাওয়ার পৃষ্ঠায় নিলাম হয়ে গেছে পিছুটান, নিদ্রিত মুখ—
যেতে যেতে পতনের শব্দ শুনি
প্রতিধ্বনি গিলে খায় নৈশব্দের ভাষা, ব্যঞ্জনের মুখমন্ডল
অনর্গল চেয়ে আছি—
পেছনে চোখ রেখে সামনে হেঁটে যাই, অন্যমানুষ।
দাঁড়িয়ে আছি জিজ্ঞাসা চিহ্নে
প্রতিদিন জিজ্ঞাসা চিহ্নের নিচে দাঁড়িয়ে থাকি
হাতে নিয়ে অসংখ্য উত্তর,
একটি প্রশ্ন রেখে উড়ে গেছে বিষণ্ণ কবুতর,
পালকে গোলাপের ঘুম ও ওম
ওষ্ঠে সবুজ সংকেত, অন্ধকার;
মরণ উৎসবে খুন হয়ে গেছে শরতের শেষ নিঃশ্বাস,
উত্তরেরা জড়ো হয়ে দিচ্ছে প্রশ্নের মহড়া, স্বাগত ভাষণ!
কে যেন জগত পুরে দিয়ে গেছে এই বটমূলে, নিরন্ন প্রহরে,
আমি ডুবে গেলে জেগে ওঠে অন্ধ গলি,
জলদীঘি, পুরাণ মোহর,
নিরুত্তর বুক নিয়ে ঝুলে থাকে যে বারান্দা—জলসাঁকো,
আক্ষেপে সে কোনদিন হয়নি ডাহুক।
প্রশ্ন হারিয়ে গেছে সম্মোহনের আয়নায়, মৃত শব্দের কফিনে।
রাত্রির অন্ধ কপাট
বুকের ভেতর কে যেন দাঁড় টানে জলের মতো একা—
জল কি নদীর দহন? রাতের মাইগ্রেন?
মুখাগ্নি জ্বালিয়ে রেখে উড়ে গেছে সামন্ত দিনের মেঘ
ধোঁয়ার অক্ষরে—
কতো মুখ ছাই হলো নিজেরই উত্তাপে—অনিদ্রায়—
আঁধারের তলপেটে জমে আছে ব্যথার ক্যানোলা, রক্তজবা—
ওখানে ঘুম নেই—খুলে রাখি রাত্রির অন্ধ কপাট,
বাতাসে উড়িয়ে পাল—ধসে গেছে নিদ্রার জলবীজ।
নিজেকে গিলে খাওয়া রাতে, রাত আসেনা সহজে।
নির্ঘুম জলের বারান্দা
দরজা খুলে রাখো—
নাভিতে মেলে রাখো নির্ঘুম জলের বারান্দা—
বহুপথ ঘুরে এসে দাঁড়িয়েছি এই পথে, একা।
তোমার শরীরে উড়ছে শুকনো পাতার ঘটি—
বৃক্ষতল।
চোখের পাতায় শুয়ে আছে নিদ্রাহীন মানুষের শবদেহ,
এখানে বাতাস সেলাই করছে সন্দেহের কিরিচ—
জলের চিতকার, পিপাসার দীর্ঘ আঙুল;
তোমার শরীর কি বহুগামি বাতাস! জলঠোসা! ঘামফুল?
মৃত্যুর মতো দাঁড়িয়ে থাকা এইসব বিভ্রম কেটে
কেন এখানে ফুটে থাকে অরণ্যবিষাদ?
স্মৃতির দূরবীন
সব স্মৃতিকে ঘুম পাড়িয়ে আজ শিকারে যাবো—
যাওয়ার কথা উঠলেই সিঁড়িতে পায়ের ছাপ
যেন সমুদ্র, যেন জলের পৃষ্ঠা এ শহর,
যেন শরীর জুড়ে বিপন্ন বুদবুদ—পারফিউম
মধ্যরাতে হাওয়া আত্মসাৎ করে দীর্ঘশ্বাসের গিলোটিন,
জলপতনের শব্দ আসে শিশিরখোয়া রাতের কবজিতে—
উড়ে যাব হাওয়াই জলে, মাছের কানকায়—
ঘামের একুরিয়ামে—
যেতে যেতে আকাশ বদল করে এতো দূরে চলে যাবো—
আমাকে কোথাও পাবেনা হে স্মৃতির দূরবীন।
কুয়াশা আশ্রম
গাছের সমস্ত শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, জলঘুমে—
উষ্ণতার জন্মরহস্য ভেদ করে গোপনে উড়ে গেছে
মধ্যবয়েসী পাতা—ফুলের আশ্রম—
ঘরে ঘরে আজ বিষণ্ন কুয়াশা—মনে নেই
শেষ কবে নদী ছুঁয়েছে তার দু’কূল, নিজের শরীর-
ঝরাপাতার কান্না বুকে নিয়ে বয়ে চলে জন্মান্ধ বাঁশি!
তোমার শরীর ঘেঁষে বসে থাকে কুসুম রাত্রি—শূন্যতা,
পাল তুলে চলে যায় দৃশ্যের করাত—দূরে, বহুদূরে—
হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে তোমার ইশারা, বৃষ্টিরেখা—
আমি কোনখানে দাঁড়াই এমন ঘোরলাগা কুয়াশায়?
বৃষ্টিরেখা
বৃষ্টি পড়ছে ভেতর বাহির—
তবু জল জানে না বৃষ্টিরেখা আর কতদূর!
আলমারিতে গুছিয়ে রেখেছি নদী,
তার ঘুম চুরি করে নিদ্রার ভেতর বয়ে চলেছে
প্রিয়তম নাকফুল—ঝাউপাতার প্রলাপ,
আমার না থাকাজুড়ে পড়ে আছি আমিই—
আঙুলে ডুবিয়ে রেখেছি ঈশ্বর
স্রোতের জলে ডুবে গেছে দ্রুতগামী ট্রেনের জংশন
আমাকে খুঁজতে এসে, না পেয়ে ফিরে গেছি
আমি নিজেই।