নিদ্রামেঘের গান
এক.
পাতার মর্মর শুনে উড়ে আসে পাখি বনগাঁয়
ঘুমন্ত নদীর তীরে থমকে দাঁড়ায় সিঁথিহাঁস
শুনেছি তোমার হাতে মেহেদির রঙ কনে মাস
তোমাকে হল না বলা বেনে বউ ডানা ঝাপটায়
তুমি চলে গেলে ক্ষুধার্তের পান্তাভাত নুনহীন
তুমি চলে গেলে ধূ-ধূ করে কলতলা তাঁতিপাড়া
হাজার বছর ধরে জেগে থাকে একা সন্ধ্যাতারা
চলে গেলে কুয়াশায় হালভাঙা মুখ কী মলিন!
তোমাকে ডাকছে মাঠ ঘাসের বালিশে এ আশ্বিন
তোমাকে ডাকছে বনভূমি পানকৌড়ি—উষ্ণ রক্তে
তোমাকে ডাকছে সুরে মুয়াজ্জিন রোজ পাঁচ অক্তে
তবু দেখি দিগন্তে সূর্যরা জ্বলে যায় ক্ষমাহীন।
তোমাকে ডাকছে মেঠোচাঁদ ঘাই খেয়ে কার্নিভাল
তোমাকে ডাকছে লুপ্ত সভ্যতা বিবর্ণ গাড়িয়াল।
দুই
থেকে থেকে চিলকায়; পুরনো ব্যথারা, একা হলে
আড়লের ছায়া, যেন নীল ঢেলে দেয় দুই ধারে
গ্রামোফোনে শুনি, তুমি নাকি ছিলে দিঘিবনপাড়ে
পাতার জমিনে ডাকা, একা টুনটুন বিষ ফলে।
চারুর সৌকর্য নিয়ে, জলের ঝিনুক; তুমি যাও
হাওয়ায় আগলে রাখি শুধু, চলে যাওয়ার ঘ্রাণ
যেন কাতরায় কেউ টেঁটাবেঁধা মাছের লাহান
বর্গীর পাখালি তুমি, ধানের বেছুন খুঁটে খাও
দিনের বোরাক নামে, এইখানে, চিতাখোলা মাঠে—
কাঠকয়লার দিন বেঁধে রাখে স্তূপের মায়ায়
পাথর ভাসানো খেলা, খেলে, যার একা দিন যায়
আইস-সিম্ফনি, শুধু—তুষারের কুঁচি পায়ে হাঁটে
কোথায় হারিয়ে যায় রাঙাদির পায়ের ঘুঙুর
থেকে থেকে চিলকায় একা হলে জামিরে দুপুর
তিন
যেই দিকে হেলে থাকে রঙ করা আড়লের ছায়া
তোমাকে হাঁটায় যেন ধূলশুরা পথের বিজনে
যতবার ফিরে আসো পলি মেখে এই দিঘিবনে
জলামাঠে বুনোহাঁস লিখে রাখে সোঁদা রাখালিয়া
পাতার জড়তা ভেঙে ভেঙে তুমি যাও কলপাড়ে
তোমার হাঁটার মুদ্রা বিন্দু বিন্দু খুনে মুহ্যমান
তোমাকে শেখায় যারা স্বরমণ্ডলের শ্রুত গান
আর যত ঢেউ দেওয়া দূর জলমিতা নিখুঁত সাঁতারে—
শুশুক ভাসায় ফেরে যে চরের চরিত কথায়
আঁধার উগরে দেওয়া পেঁচারা ধূসর এইখানে—
পলির শুক্রাণু বুনে ঘরে ফেরে ঈষ টানা প্রাণে
ঋণের কৃষক সব—ভোরের অথই কুয়াশায়
নদী জাগে—জাগে জীর্ণ শঙ্খের কণ্ঠিরা বটের ছায়ায়
শুধু তুমি নেই: আড়মোড়া ভাঙা গাশ্বির মেলায়।
চার
বোবা স্বরলিপি, একটা মেঠোকে উবুড় করে হেঁটে যায় চিতাখোলার
বাউকুড়ানির দিকে—
এখানে পানিবট তলে মেঘবাদকের আলতো জোনাকি সন্ধ্যার ভগ্নাংশ নিয়ে
উড়ে আসে চিনচিন ব্যথার খুব কাছে—
ধীরে ফুটতে থাকে অবিকল তোমার মুখশ্রী।
পেরিয়ে যাই গাঢ় আড়লের ছায়া আর
লুপ্তির পুঁথির সুরে টিলিক দেয় হরপ্পার চাঁদ।
তারপর থেমে যায় ঝিঁঝিদের উন্মনা ডাক,
শটিবনে সন্ধ্যার শেষ নির্জনতা নিয়ে ধানদুর্বার বেনেবউ
অথবা ক্রদ্ধ কাঠঠোকরা ক্রমে শান্ত হয়ে আসে—
কিংবা শান্ত হয়ে আসে, অস্থির অয়নচিলের ডানা শেষ ঝাপটা দিয়ে ঘুমিয়ে যায়—
যেখানে জড়িয়ে রাধালতা অপার নির্জনে বুনে যায় ঘনশ্যাম নিদ্রামেঘের গান।