নিকট অথবা দূর
গ্রামের মিষ্টিভক্ত ছোট বালক দরোজা লাগিয়ে
গুড় খায় ঘরে—যাতে দেখে না ফেলে কেউ!
তবু জেনে যায় মা, ‘দুষ্টুটার জ্বালায় আর পারি না!’
অথচ বন্ধ থাকে না হাড়িতে গুড় ভরার কাজ।
তুমি আমাকে ভালোবাসো চুপি চুপি—টেনে রেখে
ভূগোলের অদৃশ্য দরোজা। কেউ দেখে না। শুধু
দুঃখের গোয়েন্দারা সে-খবর দিয়ে যায় আমাকে।
রাজধানীতে রইলেও আমি তো গাঁয়েরই ছেলে!
আকাশকে আড়াল করে
মাঝে মাঝে—
নৈকট্য আর দূরত্ব চুমু খায় পরস্পরের গালে।
চুম্বন নিয়ে লেখা যে-কবিতার সকল চরিত্র কাল্পনিক
এবং সেই তুমি এই আমাকে অবহেলা করারও সাহস পাও। সুযোগও।
ফলে—মাঝে মাঝে কমা, ড্যাশ, সেমিকোলন, ব্রাকেট ইত্যাদি ।
আমি তো উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রেমিক,
আমার ব্যাকরণে কোনো ফুলস্টপ নেই;
কিন্তু হে প্রাচীন পাঠশালা,
দাদির কলম নিয়ে হাতে তুমিও তো বসাতে পারো না দাঁড়ি!
তুমিও বোঝো, এই উদার প্রেমের অকালমৃত্যু শুধু আমাকেই
রাজ্যহীন করবে না, সদ্যস্বাধীন তোমাকেও করে তুলবে—
চলার শুরুতেই বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশ।
নদী চাও অথচ উজান থেকে নেমে আসা বানকে ভাবো
নাজায়েজ জল! তো তুমিই বলো—
হাজিদাদার জার থেকে জমজমের পানি নিয়ে কি
কোনো যমুনা বানানো যায়?
নদীর জলে ঝর্ণা মেশে, বৃষ্টি মেশে;
মেশে ময়লা, মাটি; আরও কত কি!
সব নিয়েই শুদ্ধ স্রাতস্বিনী।
জীবনটা খাঁটি সোনাও নয়, শুধু খাদও নয়,
খাদে ও সোনায় সোনার অলঙ্কার।
চিঠির উত্তর দাও বা না দাও, ভালো তো বাসোই;
মুখে ‘না’ ‘না’ শব্দ নিয়ে গাল পেতে দাও—
আমার তৃষ্ণার্ত ঠোঁটের সামনে;
এবং অর্থমন্ত্রীর মন নিয়ে আমার গালেও বরাদ্দ দাও
চুম্বনের বিশেষ বাজেট; প্রথম কিস্তি ব্যয়ও তাৎক্ষণিক।
তবু কেন যে চুম্বনকে অনুরাগের চাঁদাবাজি বলো!
হে মেয়ে, তুমি তো কবিতা ভালোবাসো; বাসি আমিও।
কিন্তু আজও বোঝোনি, কবির চুম্বন গোপনে
তাজমহল গড়ার যৌথ ফান্ড। আর এই ফান্ডে
বাইরের কন্ট্রিবিউশন গ্রহণীয় নয়,
হোক সে বন্ধুবেশী বিশ্বব্যাংক অথবা
লুটেরা স্থানীয় কোটিপতি।
প্রণয়ের ফান্ডে আমাদেরই দিয়ে যেতে হবে—
ভালোবাসার সিকি, আধুলি, নোট।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী—রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মহোদয়,
দেখুন—
গরিবের ঘামে রোদ লেগে চিকচিক করছে ভ্যাট,
মুক্তবাজার অর্থনীতির দাগটানা পথ ধরে
দিনদিন বেড়ে চলেছে করের পরিসীমা;
বাড়ুক্! শুধু এটুকু মিনতি—
দয়া করে আমাদের চুমুর ওপর ট্যাক্স বসাবেন না!
রাতরঙা ব্যাগহাতে এক্সটার্নাল অডিট যাক্ মেগা প্রজেক্টের বাড়ি!
ও আমার মালিকিন, তোমার সোনার বাংলা
বিদেশ প্রত্যাবৃত্ত প্রধানমন্ত্রীর মন নিয়ে যখন
লাল গালিচার পথ বেয়ে
তুমি এসে বুঝে নাও
ভালোবাসার উল্কি আঁকা সিংহাসন,
চারপাশে চোখগুলো—
এসএসএফ এর সতর্কতায় টানটান
আসমানী চাঁদ হয়ে জ্বলে ওঠে ঝাড়বাতি ,
জোছনায় উদ্ভাসিত
হৃদয়ের সাদা জোন, রেড জোন—
ভেতর দরোজার সামনে
ফোয়ারায় ঝলমল করে
পূর্ণচাঁদের লক্ষ রেপ্লিকা,
পূর্ণিমার পৃথিবীর মতো ধন্য হতে থাকি আমি।
যখন চারপাশে ভিড়, শব্দের সন্ত্রাস,
অথচ আমি একা, তার মানে—
তুমি নেই প্রজ্ঞাপিত প্রাণের প্রাঙ্গণে,
আমার হৃদয় পাহারাহীন আঁধারের এজমালি রাত,
আনারকলিরা এসে রেকি করে,
অস্ত্রে শান দেয় দেবী চৌধুরানীর দল
মোড়ে মোড়ে জেগে থাকে
শয়তান ও সিপাহী;
কিন্তু চিৎকার শোনার থাকে না কেউই,
তাই চিৎকার করি না
সবাই এটাকে মৌনতা—মোড়ানো সম্মতি জ্ঞান করে;
আমি লুট হতে থাকি—
আর সফল পরকীয়ায় হাসে কিউপিডের সুইস ব্যাংক।
কিন্তু কী আশ্চর্য! কোনো কোনো দিন—
লুট হতে ভালো লাগে, যদিও পরক্ষণেই
রাডারে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ছাইরঙা ধোঁয়া!
ও আমার মালিকিন,
আমি যে মাঝে মাঝে খানিকটা লুট হই,
. তুমি কি তা টের পাও?
আরও একটি বিজয় দিবসের জন্য
ভারত কিংবা আমেরিকা জানুক বা না-জানুক,
তুমি তো জানো—
আমার আরও একটি বিজয় দিবস চাই যার জন্য
মুষ্ঠিবদ্ধ হৃদয় নিয়ে সংগ্রাম করে আসছি—
বছরের পর বছর; যার জন্য
সিয়ামের সংযমে ফিরিয়ে দিয়েছি—
বহু রোমান্টিক প্রস্তাব ;
লোভের বাতাসে নুয়ে পড়েও যার জন্য
সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি আবার এবং বদলে দিয়েছি—
কত রঙিন রাতের আলো-আঁধারির সিলেবাস;
যার জন্য তুচ্ছ করেছি—
ঘরের গ্রেনেড হুমকি, বাইরের টমাহক হুঙ্কার!
তুমি চিনতে পারো বা নাই পারো—
আমি আরেক চে গুয়েভারা,
শুধু আমার রণক্ষেত্রটি আলাদা এবং অদ্ভুত।
কিন্তু কবে, বলো কবে—হে সুমনা,
তুমি হবে আমার সেই বিজয় দিবস,
যেদিন গেরিলা প্যারেড গ্রাউন্ডে
তোমার উড়ন্ত আঁচলে স্যালুট জানাবে
আমার হার-না-মানা ভালোবাসা—
সফল যুদ্ধশেষে যেভাবে একদিন
মুক্তিযোদ্ধারা স্যালুট জানিয়েছিলেন—
হাসি আর অশ্রু, কুয়াশা আর বারুদের
গন্ধে ভারী বাংলার বাতাসে ওড়া
প্রথম বিজয় দিবসের রক্ত-পতাকাকে !
তুমি কি বোঝো না—আমার পরাজয় হলে
তুমি হারিয়ে ফেলবে—
ভালোবাসার রোদবৃষ্টিময় সার্বভৌম আকাশ?
তবু তিনি এসেছিলেন! কেন এসেছিলেন?
বহুদিন তারা ছিলেন মনে-প্রাণে অভিন্ন ভূগোল—অখণ্ড বাংলা
অতঃপর ভূগোলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভূগোল ভাগাভাগি; একজন
অনুদার ভারতের অংশ—আরেক জন পোকা-কাটা পাকিস্তানের;
কোনো নেহেরু-জিন্নাহ ছিলো না; নিয়তি হয়েছিল র্যা ডক্লিফ।
আজ একজন মনে-প্রাণে বাংলাদেশ, আরেকজন আগের
মতোই অর্থাৎ অঙ্গীভুত। এই বাংলাদেশ ভালোবাসেন আজও—
পূর্বের মতোই এবং এক হতে চান; ছিন্ন অংশের জন্য তার
দুটি চোখ মেঘনা-যমুনা; কিন্তু উপেক্ষা ও অনাদরে শুষ্কপ্রায় ।
হৃদয়ের উদার করিডোর দিয়ে রেখেছেন; শুল্কটুকুও চান না।
জলবঞ্চনার ব্যথা; তবু ইলিশ পাঠান ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে।
এলোমেলো পথ বেয়ে তিনি আমার কাছে এসেছিলেন; আমি
পৃথিবী হয়ে তাকে বুকে নিতে চেয়েছি; কিন্তু তিনি চান—তার
হারানো ভূগোল। আমি জানি, জাতিসঙ্ঘও ভেঙে ফেলতে
পারবে না কাঁটাতারের বেড়া। আর নিজ নিজ রাজ্যে গণভোটে
জিতবেন না তারা কেউই। হয়তো এর জন্য চাই আরেকটি
বিগব্যাং বিস্ফোরণ! তিনি বিজ্ঞানের ছাত্রী, এটা ভালো করেই
জানেন যে—একজীবনে তা সম্ভব নয়। তবু তিনি আমার কাছে
এসেছিলেন! বুঝি না কেন এসেছিলেন! কোনো সাংসারিক
অথবা পেশাগত প্রয়োজনে? সাধ্যে কুলালে সেটা তো আমি
দূরে থেকেই করে দেই! বহু বছর এক অকৃতজ্ঞ জনপদে
দাঁড়িয়ে আমি প্রান্তরের ফলজ বৃক্ষ—বারবার ক্ষতবিক্ষত;
ফুলফলছায়া দিয়ে হাততালি পাই; ঢিল-কোপও কম জোটে না!
তবু বৃক্ষস্বভাব থেকে সরে আসিনি। একথা তিনিও জানেন।
এতকিছু জেনেও তিনি এসেছিলেন; কিন্তু কেন এসেছিলেন?
তাকে পৌঁছে দেওয়ার পর রাতে আমার বেশ ভালোই ঘুম হয়েছে
কোনো সুস্বপ্ন অথবা দুঃস্বপ্ন দেখিনি—মাঝ কিংবা ভোর রাতে
তো ইউসুফের খোয়াবনামা ঘেঁটে কী হবে? আমি কবি বলেই কি
বিধাতা বারবার উৎকণ্ঠা ঢেলে দেন আমার ভাবনার পেয়ালায়?