লাল রাত্রির কসম
লাল রাত্রির কসম, এই নীল রাত্রির কসম
আমার আকাশজুড়ে একটিই চাঁদ
অনন্ত তৃষ্ণায় আমি পুড়ি, আর পোড়ে
রাগি রোদ্দুরের চৈত্রে গেরুয়া বাউল;
আমাদের রাত্রি তবু সুর তোলে চির বিরহের!
কতনা বরষা গেল, কতনা বাদল
কত প্রজাপতি উড়ে গেল বিরান প্রান্তরে
কত অহঙ্কারে কুসুমেরা
ফিরিয়ে দিয়েছে চিরকাল
ভ্রমরের নিবেদন!
এইসব লিখে রাখে হৃদয়ের নীল ইতিহাস?
আহারে বেকুব কবি আজো তুই হৃদয়ের দাস!
আজো তুই নতজানু তেমনই কমল ঠাকুর?
দ্যাখ, চেয়ে দ্যাখ
তোর হৃদয় রক্তাক্ত—ঝরছে ভীষণ রক্ত আজো
দ্যাখ ঐ রক্তের স্রোতে
ভেসে যায় সবুজ প্রান্তর
কৃষকের ধানীমাঠ—ফসলের গোলা
পোয়াতি লাউয়ের ডগা কেঁপে কেঁপে উঠছে ভীষণ।
তবু দ্যাখ—সেই সুখী ফুলগুলোর কেমন অহম
তোর মৃত্যুর খবরেও বিচলিত হয় না কখনো।
আহারে বেকুব কবি—তবু তুই ভালোবেসে গেলি?
মানুষের কত গল্প থাকে
মানুষের কত রকমের গল্প থাকে
কারও বন্ধুর গল্প—
কারও কারও থাকে পূর্বপূরুষের
বীরত্বের গাথা—সমুদ্রজয়ের কথা!
কারও কারও পূর্বপূরুষ ছিলেন
বাবা আদমের মতো
কারও বা আলেকজান্ডার।
এসবই তারা অতীতের গল্পচ্ছলে
বলে।
আর বর্তমান? আরও নাকি উজ্জ্বল।
কারও বন্ধুরা র্যা বে আছে,
কারও বন্ধু আর্মিতে
কেউ কেউ ম্যাজিস্ট্রেট
কারও কারও বন্ধু আবার সচিব
এমপি-মন্ত্রীর পুত্র।
এই বন্ধুভাগ্যঅলা যুবকেরা ঠিক
সন্ধ্যার আন্ধারে বসে
এইখানে ঝিলপাড়ে
করে গল্প, নিজেদের আর প্রেমিকার
আর করে বন্ধুদের নানা বীরত্বের।
আমি চুপচাপ শুনি।
আমার কোনও বন্ধু নেই
না সচিবালয়ে না পুলিশে-আর্মি-র্র্যাবে
তাই আমার কোনো গল্প থাকে না
এসব আড্ডায়।
আমার থাকে পেছনে
মেঘের কার্নিশ বেয়ে নেমে আসা
মাইল মাইল রাত্রি—গাঢ় অন্ধকার
আর থাকে—
রূঢ় বর্তমান—সূর্যকে কপালে রেখে
উদয়াস্ত হেঁটে চলা গন্তব্যের দিকে।
আর থাকে
নির্বান্ধব পিচ্ছিল রাত্রির দীর্ঘশ্বাস!
কাচারি ঘরের পালা
এই সন্ধ্যার আন্ধারে আজও কাঁপে স্মৃতির কাচারি!
যেন বহুকাল পর ফিরে এলো হারানো সাকিন
রূপোর সিকির মতো ঝনঝনে শৈশব-কৈশোর
এইখানে বসে গেছে পুথির আসর?
তারই প্রগাঢ় সুরে
. চোখের মণির মতো নরম মেঘেরা
ভেসে যাচ্ছে আমাদের দক্ষিণের খোলা বারান্দায়!
তেল চিটচিটে সাদা পাঞ্জাবির কোমল পকেটে
যত্নে রাখা দাদার আঁতর শিশি
. যখন হঠাৎ কথা বলে ওঠে
তখন সমস্ত গাঁয়ে নেমে আসে নীল আসমান থেকে
ঝাঁক ঝাঁক আবাবিল!
আমরা গ্রামের ছেলে—চিরকাল অবুঝ-অবুঝ
বুঝিনি স্বার্থের প্যাচ, শুধু জানি ভালোবাসাবাসি
আমাদের কোনো ক্যালেন্ডার নেই
কোকিলের ডাক শুনে বুঝে যাই বসন্ত এসেছে
ভুলে যাই কবেকার বিষণ্ন সকাল!
ছন্দে-ছন্দে মাঠে নামি
. ঘরে ফিরি মাতাল সন্ধ্যায়!
এই গ্রামে সন্ধ্যা নামে
মাঠে-মাঠে নেমে আসে নীরব আন্ধার
আর এইখানে জেগে ওঠে সহস্র প্রাণের কথা
এইখানে কথা বলে
রূপকথা-লাল কমল-নীল কমল
এইখানে কথা বলে চাঁদ সদাগর—যুবালখিন্দর
কালো অক্ষরে-অক্ষরে কথা বলে
সূর্যসেন—তিতুমীর
. নবাব সিরাজ—
কথা বলে চারুমজুমদার—বজ্রকণ্ঠের শেখ মুজিব।
নাস্তার টেবিল
এই নাস্তার টেবিলে সকালের সূর্য আস্ত রুটি!
আর আমি সেই গনগনে রোদে পিপাসা মেটাই
লোকে ভাবে—
প্রবল তৃষ্ণাকাতর মানুষেরা ক্ষুধা ভুলে যায়
হয়তো এমন কোনো অলৌকিক কারণ রয়েছে
না হলে সূর্যের লালে কেন মেটে জলের পিপাসা!
অথবা শূন্যদুপুর; ক্ষয়ে আসে রাগের গরিমা
শৈশবস্মৃতিরা যেন অ্যাকুরিয়ামের প্রজাপতি
অথবা ঝুলন্ত ছাদে ডানাঅলা পৌরাণিক মাছ
উড়ে যেতে চায়, পুড়ে পুড়ে যায় ঈর্ষার আগুনে!
আহা, নাস্তার টেবিল—
নড়ে ওঠে, আকস্মিক হৃদকম্পে ওড়ে প্রজাপতি
ওড়ে আর মাঝেমাঝে বসে ওইখানে—
হা-করে চেয়ে থাকা কামুক দেয়ালে
যেখানে থমকে আছে ঝুলন্ত দুপুরে!
নাস্তার টেবিল, আহা!
মিহি সকাল গড়ায় সিল্কি সিল্কি দুপুরের দিকে
তবু নাস্তার টেবিলে নিরীহ শীতল সূ্র্য কাঁপে!
ওই লাল-গোল সূর্য প্রচণ্ড ক্ষুধায় গিলে খাবে
পৃথিবীর যাবতীয় প্রেম-ভালোবাসা
হাঁট-বাজার-মন্দির-মসজিদ-প্যাগোড়া-উদ্যান
সাধের বাগান-গীর্জা-পার্ক-রেস্তোরাঁও;
প্রেমিককে দেবে মৃত্যুদণ্ড, প্রেমিকাকে নির্বাসন!
আমাদের গলা দিয়ে গলগল করে নেমে যাবে
গনগনে লালস্রোত—
আমরা প্রেমের নামে ভয় পাব; পালাব নরকে
আর আমাদের প্রেমহীন পৃথিবীতে
স্থির নাস্তার টেবিল পুড়ে যাবে ক্রোধের আগুনে!
লালমাছি জেগে থাকা গ্রামে
আমার কফিন রেডি। তবু কেন অন্ধকারে ঠুকছি পেরেক!
এমন প্রশ্নের তোড়ে—
ভেসে গেছি কত কাল। চাঁদের নোলক পরা কত
রাত্রিকে ডেকেছি বউ। মৃত জোনাকির আগে আগে
ফিরে গেছি কত লাল রাত্রির আন্ধারে—
লাল মাছি জেগে থাকা গ্রামে।
আমাদের দৃষ্টি তবু ভালোবাসে গলে পড়া রাতের শরীর!
মানুষেরা মরে গেলে মাছিগুলো আগে টের পায়?
তারা কেন উড়ে-উড়ে ঘুরে আসে কফিনের কাছে
তারা জেনে যায়—
অন্তহীন শূন্যতায় ভেসে যায় নির্বান্ধব কবি!
আমিও মৃত্যুর সখা—ভালোবাসি তারার কফিন
তাই—
আমি তো রাত জাগি না, রাত্রি জেগে জেগে
আমাকে পাহারা দেয়!
আর আমি চিৎ হয়ে—
. শুয়ে থাকি।
অপমানে-অসম্মানে—একা একা যুদ্ধ করি বাতাসের লগে!