এক.
ইউক্রেনের এই পিকাচারাস্ক শহরটির নাম নিপ্রো। কাছেপিটে একটি নদীও আছে—স্রোতজলে তেজদীপ্ত। হ্যান্ডহেল্ড ডিভাইসের স্ক্রিনে চোখ রেখে আস্তে-ধীরে হাঁটছি। দেখি, বিস্ফোরণে তোড়েফুঁড়ে গেছে বিরাট ব্রিজটি। ধ্বস্ত কাঠামো জুড়ে পাতা হয়েছে হিলহিলে তক্তা। দু-দুটি লাঠিতে ভর দিয়ে পাড়ি দিচ্ছেন বৃদ্ধা, সঙ্গে স্যুটকেস হাতে পুত্র, নাতি-নাতনি, ছোট্ট ছেলের কাঁধ নুয়ে পড়ছে ল্যাপটপের ভারে, মেয়েটির হাতে পুতুল, তার চোখমুখ বেয়ে ঝরছে শোনিত। মিসাইল ছুড়ে একে ঘায়েল করা খুব জরুরি ছিলো কী? এসে পড়েছি পার্কে, জল উপচানো চৌবাচ্চায়—পায়ে শ্যাওলা জড়িয়ে পানিতে ঠোঁট ভেজায়—নাগরিক উদ্যানের আধপোষা এক পাখি।
দুই.
ব্যাকপ্যাকে এবার জিওলমাছটির মতো ভাইব্রেশনে উছলে ওঠে ভিন্ন একটি ডিভাইস। স্কন্ধে পাহারায় মোতায়েন দেবদূতের মতো এরা যেন আমার ভাবনা-চিন্তা, প্রাপ্তি ও দোলাচল—তাবৎ কিছুর করে যাচ্ছে সার্বক্ষণিক নজরদারি, কখনো অন্তরের অন্তর্গত মহলেরও পেয়ে যায় ব্যাপক তালাশ, প্রদাহে কখনো-বা ছড়ায় লবণমিশ্রিত কারণবারি। কখনো ভাবি, আছে কী টেকসই কোনো উপায়, খুব খারাপ হয় না, যদি-বা যুগলপ্রহরীর হাত থেকে খনিক সময়ের জন্য পাওয়া যায় নিস্তার, ইউক্রেনে চলছে আগ্রাসন, স্ক্রিন জুড়ে ফুটে ওঠে যুদ্ধের সমাচার।
তিন.
শতবর্ষী ঔক বিরিক্ষের ছায়া-শোভিত সরণী ছেড়ে আমি পা রাখি, অযুতনিযুত দূর্বা-তৃণের সমাহারে সমৃদ্ধ সবুজ মাঠে। দার্জিলিং চা-এর সোনালু উদ্দীপন ছড়িয়ে আছে মোলায়েম রোদ্দুরে। এসে পড়েছেন সূর্য-উপাসক পুরুষ-নারী, বস্ত্রের বাহুল্য পরিহার করে শুয়ে পড়েছেন ঘাসে। শোনা যাচ্ছে, দুই কিংবা তিনটি ভাষায় তাদের সুর-ভাজা কণ্ঠস্বর, কারো কারো প্রায়-নিরাবরণ দেহে আঁকা বর্ণিল উল্কিতে চিত্রল হয়ে আছে পরিসর। একটি জুটি শৃঙ্গারের প্রয়াশে এসেছে অতি কাছে, ফুটছে শরীরের যুগলবন্দীতে সৈকতে অন্তরঙ্গ মুদ্রায় জোড়া-শামুখের স্থাপত্য, নিউজফিডে দেখি, কিয়েভের পথে—রাতভর আটকা পড়েছে ত্রাণ-বাহী কনভয়, ত্রিপল চুঁইয়ে তুষারে স্নাত হচ্ছে রুগ্ণশিশুর পথ্য।
চার.
এক পেয়ালা কফি পেলে অবসন্ন দেহটি চাঙ্গা হবে নির্ঘাৎ, তাই অতিক্রম করে জলঝরা প্রপাত, এসে পড়ি গার্ডেন-ক্যাফের প্রাঙ্গণে। কেন জানি আজ গেট বন্ধ, ট্রেলাসে জড়িয়ে আছে লতানো জেসমিন, দখিনা হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে পুষ্পগন্ধ। বাহারে সাঁকোটি পাড়ি দিয়ে বসে পড়ি বেঞ্চে। প্যাকেট ছিড়ে—খোসা ছড়িয়ে খুটখাট মুখে ফেলি খাদ্যপ্রাণে ভরপুর পেস্তা, সামান্য দূরে দুটি গাছে দড়ি বাঁধা হ্যামকে শুয়ে একটি মানুষ—আধোঘুমের দোলাচলে জমে উঠেছে তার সিয়াস্তা। আমাকে ঘিরে ধরে তিন-তিনটি কাঠবিড়ালী—প্রবল প্রত্যাশায় উৎসুক, ছুড়ে দেই তিনটি বাদাম, বদান্যতায় নিমিষে বনের মার্জারও হয় জাত ভিক্ষুক। নিউজফিডে বাজে সংকেত, দেখি, মারিওপুলের থিয়েটার ও আর্টস্কুলে পড়েছে বোমা, পুড়ে অঙ্গার হয়েছে কতিপয় মানুষ। এদের প্রেষণা, সৌন্দর্যপ্রিয়তা কিংবা ছবি আঁকার দক্ষতা—তাবৎ কিছু নিমেষে হয়েছে স্মৃতিময় অতীত, কিয়েভের বোম্বশেল্টার থেকে বেঁচে যাওয়া একটি শিশু—শরণার্থী শিবিরের আঙিনায় দাঁড়িয়ে গাইছে ইউক্রেনের জাতীয় সংগীত।
পাঁচ.
ব্যয়াম প্রলুব্ধ জনা কয়েক নারি-পুরুষ মেতেছে ইয়োগার ইহলৌকিক কসরতে। তাদের বাম পাশে রেখে আমি চলে আসি, যুদ্ধ-জেতা অশ্বারূঢ় তেজস্বী মূ্র্তিটির শিথানে। শানবাঁধা গোড়ালিতে আজ জমেনি ছবির হাট তেমন। কেবলমাত্র একজন আধচেনা চিত্রকর বাইসাইকেলে ইজেল ঠেকিয়ে ফাইনালটাচে ফুটাচ্ছেন পাইনবন। মানুষটি মনে হয় গৃহহীন, ক্যরিয়ারে হালকা তাঁবু এবং কম্বল, হ্যান্ডোলেও কর্ড দিয়ে প্যাচিয়ে রেখেছেন খান কতক বইপুস্তক, সামান্য সম্পদটুকু যেন আসামান্য যখের ধন, ভারি খিন্ন দেখায় তাঁকে, বোধ করি বিক্রি হয়নি আজ তাঁর সৃজিত কোনো উপকরণ।
ছয়.
ডিভাইসে নিউজফিড সচল হয় ফের। খরসান নগরীতে ভোররাতে নিহত হয়েছেন একজন বর্ষিয়ান চিত্রকর। মানুষটি খেচরের ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন, আর প্রতিটি চিত্রপটে প্রতীকের ভঙ্গিতে জুড়ে দিতেন পিঞ্জিরার মতো ছোট ছোট ঘর। পুড়েছে তাঁর যথাসর্বস্ব, দগ্ধ হয়েছে খাঁচায় পোষা বুলবুলি, ছাইভষ্ম হয়েছে কিছু চিত্রকর্মও তবে পুরোপুরি পোড়েনি রঙতুলি। দগ্ধ দেহের পাশে অলৌকিকভাবে অক্ষত সেলফোন, তড়পানো ভাইব্রেশনে থেকে গেছে যোগাযোগপ্রবণ। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছোট্ট ডিভাইসটি ধারণ করেছে যুদ্ধের জ্বলাপোড়া দৃশ্য, প্রতিবেশীরাও তাঁর খুইয়েছে বাস্তুভিটা, স্বজন হারিয়ে হয়েছে অহেতুক নিঃস্ব।
সাত.
এদিকে মোরাম বিছানো পায়ে-চলা ট্রেইলের কারসিভ হরফরাজি হয়ে আছে আঁকাবাঁকা, বোতলেপোরা বোলতার মতো অস্থির হয়ে ওঠে যোগাযোগের যন্ত্রর, ফুটে ওঠে ডানিপারের জলচিত্রে আর্দ্র একটি দেশের পতাকা, স্ক্রিনজুড়ে ছড়িয়ে যায় সোনালিগমের খেতে নুয়েপড়া নীলাকাশ, ফুটে ওঠে সীমান্ত অতিক্রম করে শরণার্থীদের পথচলা—সাইরেনের আয়ূধে রুদ্ধশ্বাস। খারসানের রাজপথে ট্যাংকের অগ্রযাত্রা, রুশ সৈনিকদের কুচকাওয়াজ, উপেক্ষা করে আর্টিলারির তুমুল আওয়াজ, জনা কয়েক নাগরিক দাঁড়িয়েছে পথ আলগে, হাতে স্বর্ণনীল পতাকা, মনে হয় হারিয়েছে এঁরা যথাসর্বস্ব, অবশিষ্ট থেকে গেছে কেবলমাত্র একটি প্রিয় সম্বল, চার্চের জানালায় বর্ণিল কাঁচ আসমানি ফ্লেয়ারে হয়ে ওঠে সমুজ্জ্বল।
আট.
শতরঞ্জের ছকটি ঘিরে, কুরছি-কেদারায়…আয়েশি আমেজে জমেছে দাবাড়ুদের মজলিশ, হোল্লড়ের হররা ছাপিয়ে মৃদুকণ্ঠে ওঠে শীস, বড়ের রণকৌশলে মাত হয় বুঝি-বা চাল, মার্কিন মুলুকের নাগরিক উদ্যানে মনে হয় না তেমন বরবাদ দিনকাল। আমার ডিভাইসেও আসে চলমান দৃশ্যকল্পের জোয়ার, সহসা ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের মফস্বল, যাদুময় ফরাশ চেপে উড়ি, তথ্যের তর্পণ হয়ে ওঠে প্রবল।
নয়.
দৃশ্যমান হয় খারকিভের সমস্কা স্ট্রিট, বোমারু বিমানের তোলপাড়ে অস্থির হয়ে ওঠে নিধুয়া সমীর, স্পষ্ট দেখতে পাই, গোর্কি পার্কে দেবি ডায়ানার দগ্ধ মন্দির। ভাবি, সের্গেই বরথকেভিচের কথা, ফিরে এসেছিলেন সংগীতকলাকার জন্মভূমি খারকিভে, থিতু হতে পারেননি, তবে নির্মিত হয়েছিল ধ্রুপদী সুর-নকশা তাঁর কলমের নীবে। বেজে ওঠে সুরতালছন্দে ‘ফ্রম মাই হোমল্যান্ড..,’ কলাকার হয়তো জানবেন না, আজ তাঁর কম্পোজিশন বাজাচ্ছে সাতটি ভিন্ন দেশের ধ্রুপদি ব্যান্ড।
দশ.
ফোয়ারার গোল চত্তরে ফের দেখা হয় বাইসাইকেলওয়ালা চিত্রকরের সঙ্গে। সিমেন্টের চাতালে উবু হয়ে বসে মানুষটি আঁকছেন কিছু একটা হরেক রঙে। ক্লারিওনেট, হারমোনিকার টুং-টাং-এ ক্রমশ জমছে আউটডোর কনসার্ট, বাঁশরীর বিধূর ফুলচন্দনে সুরভীত হয়ে উঠছে জমায়েতের রাজ্যপাট। ইউক্রেনের বয়োবৃদ্ধ এক অভিবাসী পেতেছেন টেবিল, বিলিয়ে দিচ্ছেন তাঁর স্বদেশের পিনগাঁথা ছোট্ট ছোট্ট পতাকা, নিয়ে এসেছেন ডালাভর্তি বাগিচার বোধ করি তাবৎ সূর্যমুখী, করজোড়ে অনুরোধ করেন, ‘বোদ লাসকা ভিজমিত সোনিয়াশনিক’, বা ‘অনুগ্রহ করে তুলে নিন একটি সূর্যমুখী’, হাততালি দিয়ে কেন জানি খুশি হয়ে ওঠে ব্যালেরিনার সজ্জায় যমজ দুটি খুকি। চাতালে ফুটে ওঠা চিত্রে এবার ছড়াচ্ছে নীলবর্ণের অঞ্জন, বাদনের সম্মোহনে শ্রবণের রন্দ্রে রন্দ্রে ছড়িয়ে যায় লীলুয়া ঝংকারের অহিফেন, নীলাভ জমিন চিরে সোনালি হরফে লেখা হতে থাকে ‘নো টু ওয়ার ইন ইউক্রেন’।