বিচ্ছিন্নতা
প্রস্ফুটিত বসন্ত; কুহু কুহু—গাইছে কোকিল
হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের নবায়িত সবুজে;
সে জানে না—তার গানে আজ কান নেই—
ডাক্তার, নার্স কিংবা রোগীর! সে জানে না—
আজ মানুষের অদ্ভুত আষাঢ় মাস—
‘ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।’
তো আমরা বাইরে যাইনি; শাহাবাগ থেকে
দোয়েল চত্বর, বোটানিক্যাল গার্ডেন হতে
চন্দ্রিমা উদ্যান—সবখানেই আজ হাই তোলে
আমাদের অনুপস্থিতি! সবখানেই—‘যায় কেঁদে
দক্ষিণ হওয়া!’ ঘরেই আছি; একই ঘরে
রয়েছ তুমিও; কিন্তু এখানেও বিচ্ছিন্নতা;
অভ্যস্ত ঠোঁট রাখতে পারছি না হালাল
পিপাসার ঠোঁটে; ক্ষুধিত রক্তে থেকে থেকে
জেগে ওঠে উথালপাথাল ঢেউ! ধাক্কায় ধাক্কায়
ভেঙে পড়তে চায় পুরনো বেড়িবাঁধ! কিন্তু
আমরা স্রোতের মুখে পরিয়ে রেখেছি লাগাম!
মাঝে মাঝে—কখনো দুপুরে, কখনো-বা রাতে
পাশের ফ্ল্যাটে, যেখানে বসবাস—পরকীয়া
একজন প্রেমিকের, যাকে আমি চিনি রুনুভাবী,
চেন তুমিও, বেজে ওঠে বাঁধভাঙা নজরুল—
‘নিজগৃহে বনবাস সয় না, প্রিয়া মোর…!’
কিন্তু সেখানেও আজ ঘর হয়েছে পৃথিবী; কোনো
অজুহাতেই তার পা সরে না বাইরে; মনে হয়,
এ আমাদের সকলের নতুন সিয়াম সাধনা!
অথচ আজীবন বিদ্রোহী আমরা; যেখানেই
নিষোধাজ্ঞা, সেখানেই আমাদের মুষ্টিবদ্ধ হাত!
নিশ্চয়ই মনে আছে তোমার, একদিন প্রভুর
নিষেধ লংঘন করে আমরা খেয়েছিলাম
প্রতীকের রঙে রাঙা যৌবনের ফল; স্বর্গচ্যুতির
ভয়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলেছিলাম,
‘আমরা যখন ভালোবাসতে শিখেছি—
তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না!’
বয়স যতই হোক, নিশ্চয়ই ভোলোনি তুমি—
মাথার ওপর সর্বজয়ী মোগলে আজমের
অসি, সেই উদ্যত অসিকে উপেক্ষা করে
আমরা মিলেছিলাম ফতেপুর সিক্রির মোগল
গার্ডেনে; পূর্ণিমা চাঁদ তার ডিএসএলআর
ক্যামেরায় তুলে রেখেছিল এক সিরিজ
স্টিল ফটোগ্রাফি; সেই ছবি দেখে আজও নেচে
ওঠো তুমি—‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া…’
তোমার সেই নাচ দেখে আজকের লুবনা—
নদীরাও একবেলা আনারকলি হয়ে উঠতে চায়!
আর এই তো সেদিনের কথা, পেছন ফিরে
তাকালেই—স্মৃতির বিলবোর্ড ঝলসে দেয় চোখ—
একাত্তরের ঝাঁঝালো বসন্ত; চারপাশে গ্রেনেড,
বোমা, গুলি, ভাত খাওয়ারও সময় নেই হাতে!
তবু সম্মুখ যুদ্ধে নামার আগে এসএলআর এর
নল একপাশে সরিয়ে তোমার উৎকণ্ঠিত মুখে
চুমু দিয়েছিলাম; ‘যাও, আল্লার হাতে সঁপে
দিলাম তোমাকে’—বলে আমার হাতে গ্রেনেডের
ব্যাগ তুলে দিয়ে আঁচলে বেঁধেছিলে যৌবন!
যুদ্ধশেষে লালসুবজে ভরে উঠেছিল গন্দম বাগান।
কিন্তু আজ আমরা মেনে নিয়েছি যৌথ দূরত্ব;
আজ আমরা বেছে নিয়েছি আত্ম-একাকিত্ব;
কারণ রঙিন পায়ে আমাদের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে
যে, দেরিতে হলেও তাকে চিনে ফেলেছি আমি,
সে কিউপিডের লোক নয়; তার হাতে প্রণয়ের
যে বিজ্ঞাপন, তা আসলে প্রেমবৈরী ভাইরাস;
প্রেম ও প্রাণ নিয়ে খেলায় তাকে ধূর্ত এক বেনিয়া;
প্রতিরোধে-প্রতিকারে তাকে তাড়াতে হবে আগে;
তারপর আবার আমরা নতুন আষাঢ়ের পদ্মা-যমুনা।
ততদিন পর্যন্ত সম্মিলিত অপেক্ষা আমাদের!
ততদিন পর্যন্ত আমাদের স্বেচ্ছা-একাকিত্ব।
খেলা
হে ক্যাপ্টেন, ম্যাচ ফিক্সিংয়ের লোভ,
স্বজনপ্রীতির অন্ধ-অনুরাগ আর প্রতিপক্ষের
দুর্ধর্ষ ফর্মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে
মূলত তুমিই গড়ে তুলেছিলে দল;
প্রথম জয় দেখে সচকিত হয়ে উঠেছিল
টেস্ট প্লেয়িং প্রতিটি ক্রিকেট কান্ট্রি;
আর তুমি নিজেই ছিলে অলরাউন্ডার
কাপ জেতার পর তোমার নামেই
স্লোগান হয়ে উঠেছিল সারা গ্যালারি
যদিও আহত হওয়ার কারণে তুমি
খেলতে পারোনি ফাইনালে ম্যাচে।
অথচ তোমার অনুপস্থিতিতে দুর্ধর্ষ প্রতিপক্ষের
বিপক্ষে খেলে যে ফাস্ট বোলার
সবচেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছিল,
আর যে ব্যাটসম্যান বিপর্যয়ের মোড়ে
রান করেছিল সবচেয়ে বেশি,
এবং অভাবনীয় নাটকীয়তায় জিতেছিল দল,
ঈর্ষায় নাকি আশঙ্কায়,
নাকি বিভ্রান্ত হয়ে কানকথায়,
তুমি তাদের দুজনকেই বাদ দিলে দল থেকে!
তারপর থেকে আজ অবধি আমরা আর
সমবেত হাততালি হয়ে উঠতে পারিনি।
বিদেশি কোচ এনেও লাভ হয় না আর লাভের সমান।
বৈশ্বিক ডানার দিনে বেড়াহীন আকাশ মিডিয়া,
খুচরো জয়ের দৃশ্যে মেটে না
কোনো অবাধ চোখের পিপাসা,
হয়তো বা তাই মদের গন্ধমাখা অন্ধকারে
ক্লাবগুলো হয়ে পড়েছে ভ্রান্তির ঠিকানা।
সময় গেছে। তুমিও আজ দলে নেই।
তবু জানতে ইচ্ছা করে,
হে ক্যাপ্টেন, হে প্রিয় সারথী,
কেন তুমি এমনটি করেছিলে কেন!
অথচ তোমাকে ক্লাইভ লয়েড এবং
ইমরান খানের চেয়েও
বড় অধিনায়ক জেনেছিলাম আমরা!
নদী
ভুলের ভূগোলে আমি ভুল করে মাঝে মাঝে
চাররঙা পাল তুলে—
নদীমাতৃক প্রবাদের কানাকড়ি হই—
ইছামতী, ধলেশ্বরী, মহানন্দা…
ঢেউ চুমি, স্রোত চুমি–চুক চুক
কিন্তু হায়, কে মেটায় গভীর তিয়াস!
এদিকে দুনিয়াসেরা মিঠাপানি নিয়ে
তৃষ্ণার ভূগোলে তুমি—
বয়ে যাও কুলকুল পুরোনো যমুনা।
কত কথা ওঠে তবু এ কথাও জানো তুমি
যাকে বলে ভালোবাসা,
সেও সবখানি শুধু যমুনাপুরাণ।
আর তাই মহামতি মাইকেল মধুসূদনের পায়ে
চুপি চুপি ফিরে আসি আমি
চোখে কালি, পায়ে কাদা,
পাঁচমিশালী আঁশটে গন্ধ সকল অজুহাতে;
ও নদী, এই মিনতি, মরতে চাই না,
তবু যদি ভুলের করোনা-ঠোঁটে
চুমু দিয়ে মরে যাই এই আমি
কূলে কিংবা অকূলে কোথাও,
ঢেউয়ে ঢেউয়ে তোমার জলে ধুয়ে দিও মরণ।