বীরাঙ্গনাদের ঠিকানা
‘এই কে আছিস!’
‘লিখে দে ওদের বাবার নাম শেখ মুজিবুর রহমান’
‘আর তাদের ঠিকানা ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বর!’
তাঁর গর্জনে কেঁপে ওঠে কচি ঘাসের ডগা। গোলাপগুলো
এগিয়ে এসে জানায় প্রণতি, আর মধ্যদুপুরের সূর্য
ক্রমশ নুয়ে এসে ধীরে দাঁড়ায় তার পদযুগলের কাছে।
কে তিনি! কে এমন পিতা, যিনি তাঁর বীরাঙ্গনা কন্যাদের
মাথায় হাত বুলিয়ে বলছেন, ‘ভয় নেই! এই বাংলাদেশ
তোমাদের! এই নীল আকাশের চাঁদ তোমাদের!’
‘মুক্তিযুদ্ধে আমার মেয়েরা যা দিয়েছে সেই ঋণ আমি
কীভাবে শোধ করবো!’
বলতে বলতে চোখ মোছেন পিতা।
ডুকরে কেঁদে ওঠেন তাঁর পাশে দাঁড়ানো ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী।
তেরো বছর বয়সী কাকন বনিক,
. ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন আকাশের দিকে। যাকে
পরিত্যক্ত বাঙ্কার থেকে উদ্ধার করেছিলেন গ্রামবাসী।
হায়েনা ক্যাম্পে দুই মাস আটক থাকা মনোয়ারা বেগম
বর্ণনা করেন সেই দুর্বিষহ স্মৃতি!
ধর্ষণ শেষে কীভাবে বেয়নেটের আঘাতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন
করা হয়েছে বাংলার নারীদেহ! কীভাবে কেটে ফেলা
হয়েছে যোড়শীর স্তন!
আঁতকে ওঠেন দীপালী রায়। বাকরুদ্ধ তিনি। কিছুই
বলার নেই—পিতা!
পিতা তাদের কথা মনযোগ দিয়ে শোনেন। আবারও হাত
বুলিয়ে দেন সখিনা বেগমের মাথায়।
‘তোদের আমি দেখবো, কেউ কিছুই করতে পারবে না’
‘শুধু একটু সময় চাই।’
আবারও হুঙ্কার ছাড়েন পিতা। কন্যারা সাহস খোঁজেন
তাঁর তর্জনির ছায়ায়।
তারপর,
. তারপর, এই বাংলায় একদিন নেমে আসে
পনেরোই আগস্টের কালোরাত!
বত্রিশ নম্বরের সিঁড়িতে পড়ে থাকা বাংলাদেশের বিশাল দেহ
কেউ উত্তোলনের সাহস দেখাতে পারে না।
তছনছ হয়ে যায় বীরাঙ্গনাদের ঠিকানা। ঠিক এর চারদিন পর
ভিখারিনীর বেশে বীরাঙ্গনা সখিনা বেগম কয়েকটি জবাফুল
রেখে যান বত্রিশ নম্বরের গুলিবিদ্ধ গেটে।
নির্বাচিত নক্ষত্র থেকে
আপনি যে বয়সে চলে গিয়েছিলেন, আমি সেই বয়স
পার করেছি পিতা। পাড়ি দিচ্ছি, আপনার রেখে যাওয়া
মেঘ, স্রোত, মোহনা। নির্বাচিত নক্ষত্র থেকে কিছু আলো
এই মাটিতে ছিটিয়ে দিয়ে বলছি—
আজকের সবগুলো চাঁদ, উৎসর্গিত হোক মুজিবের নামে…
দেখছি, বত্রিশ নম্বরের সামনে ফোটে থাকা প্রতিটি
গোলাপ, দর্শনার্থীদের কীভাবে দেখাচ্ছে নিজস্ব জাদুবিদ্যা
কীভাবে, মায়ের হাত ধরে একটি শিশু কাটপেন্সিল দিয়ে
আঁকছে সাতই মার্চের সেই উদ্যত তর্জনি।
এই বাংলায় প্রতিটি ভোরে, মানুষেরও আগে
যে পাখিগুলো উচ্চকণ্ঠ হয়—দেখছি তাদের চাহনি,
এক টুকরো দমকা হাওয়া ফিরছে ঘরে,
আপনার রেখে যাওয়া এই—
. মানচিত্রকেই তার স্বদেশ জানি।
আত্মমগ্ন ভোরের ঈশানে
ওরা ভেবেছিল, খুন দিয়ে আদর্শ ঢেকে দেওয়া যায়। ওরা ভেবেছিল,
মৃত্যুই মুছে দেয় চেতনার বজ্র-ইতিহাস!
গুলির পর গুলি করে যারা বিদ্ধ করেছিল বত্রিশ নম্বরের ফটক—
না, ভুল বললাম!
. যারা বিদ্ধ করেছিল বাংলাদেশের পাঁজর, ওরা জানতো না
একদিন তাদেরও কাটগড়ায় দাঁড়াতে হবে।বাংলার মানুষ গোটা বিশ্বে
তালাশ করবে তাদের পলায়নপর প্রেতাত্মা।
‘মুজিব হত্যার বিচার চাই’—বলে পনেরোই আগস্টের বিকেলটি
ভারী করেছিল যে পাখি; কান্না-কাতরতায়
আমি তার উড়াল দৃশ্য দেখেছি।
যে নবপরিণীতা জল আনতে নদীর ঘাটে গিয়ে,
কলসী ছুড়ে মেরেছিল ভর যমুনায়—
. আমি দেখেছি তার প্রতিবাদ।
একাত্তরে জমা না দেওয়া জংধরা স্টেনগানটা পুনরায়
গর্ত থেকে তুলে গর্জে উঠেছিলেন যে প্রৌঢ় মুক্তিযোদ্ধা,
আমি তাকিয়েছি তাঁর চোখের দিকে। সুনসান নীরবতা ছিল
সেদিন। গোটা বাংলাদেশ ছিল শোকার্ত।
আত্মমগ্ন সেই ভোরের ঈশানে—
আমি সেদিন বারবার শোকের পঙ্ক্তিমালা লিখতে চেয়েও
লিখতে পারিনি। আমার নির্বাক দৃষ্টির ভার বহন করেছিল
যে আদিম বর্ষার ঢেউ,
. তার মাঝেই আমি বিলীন করে দিয়েছিলাম
আমার সকল দীর্ঘশ্বাস। কারণ আমি জানতাম, পিতা একদিন
ফিরবেনই প্রজন্মের প্রশ্বাসে প্রশ্বাসে।
একজন সবুজবিপ্লবীর প্রতি
অনেক জনহিস্যার কথাই আমরা ভুলে গিয়েছি আজ। অনেক খনিজ
সম্পদের ঘনত্ব ভুলে গিয়ে আমরা হয়ে উঠেছি, তরলতম অমানবিক
জলকণা। ভুলে গিয়েছি, এদেশে একদিন মানুষেরা তাদের অধিকার পাবে
বলে শির উঁচু করেছিলেন একজন সবুজবিপ্লবী।
বলেছিলেন, বাংলায় খাসভূমি থাকবে না। কৃষক থাকবে না ভূমিহীন।
জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘এই যে আপনি অমুক সাব-তমুক সাব
কার টাকায় আপনারা লেখাপড়া করে ‘সাব’ হয়েছেন!’’
এই প্রশ্নগুলো করতে এখন আর আমরা সাহস দেখাতে পারি না।
আমরা বলতে পারি না, এই দেশ মেহনতি জনতার।
যে জনতা প্রতারণা করে না, প্রতারণা করতে জানে না।
আমি আমার কাব্যভুবনে একজন বিপ্লবীর কথা লিখে যাচ্ছি।
আমি প্রজন্মকে বলে যেতে চাইছি, সেই মহাপুরুষের গল্প।
যিনি কারাগারের প্রকোষ্ঠে থেকেও শুধুই ভেবেছিলেন গণমুক্তির
কথা। শুধুই ভেবেছিলেন, বাঙালি জাতির একটি স্বদেশ হবে—
একটি পতাকা হবে।
আর মুক্ত স্বভূমে ফিরে কেবলই বলেছিলেন—
‘আমি আপনাদের কী-ই বা দিতে পারি!’
অনল অথবা ভূগোলের অগ্নিশিখা
জাতিসংঘ চত্বরে উড়ন্ত লাল-সবুজ পতাকার নিচে
গিয়েই সমাপ্ত হয় আমার ভ্রমণ। দাঁড়াই—
দাঁড়িয়ে থাকি অনেকক্ষণ। এখানে, ঠিক এখানেই
একদিন পড়েছিল জনকের পদছাপ, তাঁর আঙুলের ছায়া।
কিংবা বলতে পারো, তাঁর ছায়াধন্য হয়েছিল যে
ভবনের দেয়াল, সেই জাতিসংঘ ভবনে আমি আজও
খুঁজি তাঁর কন্ঠের প্রতিধ্বনি।
কার কার সাথে তিনি করমর্দন করেছিলেন সেদিন!
কাকে শুনিয়েছিলেন তিনি একটি জাতির জন্মগাথা!
কিংবা কোন কোন বিশ্বনেতার মুখে সেদিন উচ্চারিত
হয়েছিল সেই ধ্বনি—’শেখ মুজিব, দ্য লিডার!’
‘মুজিব আসছেন’ বলে যে মার্কিন মুলুক একদিন
সেজেছিল দীপ্ত গরিমায়,
আমি এখনো সেই মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনের
দেয়ালে দেয়ালে শুনি: ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’
এর সুরঝংকার।
জর্জ হ্যারিসন কিংবা পণ্ডিত রবিশংকরের রেখে যাওয়া
সেতারের দ্যোতনা আমাকে নিয়ে যায় সেই একাত্তরে।
পুরো টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ উল্টিয়ে পুনরায় পড়ি—
‘দ্য ব্লাডি বার্থ অব বাংলাদেশ’
মার্কিনি আর্কাইভে শুনি, জাতিসংঘে দেওয়া বাংলায়
তাঁর ভাষণ,
আবারও প্রজ্জ্বলিত হই—
. অনল কিংবা ভূগোলের অগ্নিশিখায়।
ধানমণ্ডির ধ্বনিপুত্র
ফকির ইলিয়াস
প্রকাশক: য়ারোয়া বুক কর্ণার
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
মূল্য-১৬০টাকাবইমেলায় স্টল
য়ারোয়া বুক কর্ণার, স্টল নম্বর-২৪৩
পদক্ষেপ, স্টল নম্বর-৭৬৪