জঙ্গলে
জঙ্গলের তৃণপথে হেঁটে যাই বিকেলের শেষ রোদে। পুরনো ছাতিম গাছে নিকেল ঘণ্টির সাইকেল খানিক হেলান দিয়ে রেখে আমি হেঁটে যাই জেগে ওঠা ঘাসের জঙ্গলে। কোত্থেকে যেনবা ভেসে আসে শুধু ময়ূরীর মনোলগ—তার মৃদু পাখসাটে মৃদঙ্গ বাজে ধীর লয়ে! কোথাওবা সুর ওঠে দরবার-ই-কানাড়ার; কান পেতে আমি শুনে যাই বাগ্দেবীর কড়া নাড়া! জঙ্গলের কিছুটা ভেতরে গিয়ে দেখি এক ঘুমঘোর সরোবর—যার ছেঁড়া ছেঁড়া পদ্মের কোরকে বেজে ওঠে দূরের সরোদ! টোপাজ পাথর জ্বলে চকমকি রোদে—ফুঁসে ওঠা সাপের ফণার নিচে; তার জ্যোতির দ্যুতিতে আমি মিশে যেতে থাকি হাওয়া ও হরিদ্রায়! এ জঙ্গলেই আমি লিখে যাচ্ছি দ্যাখো ধূলিতে মোড়ানো প্রেমগাথা, রক্তের হরফে লেখা ভাঁজপত্র আর ছড়ানো পথের নোটবুক!
নাবিক ও গণিকা
যে নাবিকেরা নতুন নতুন গণিকার খোঁজে নেমে যেত গন্তব্যে পৌঁছার আগেই কোনো আলোআঁধারিময় বন্দরে—দ্যাখো তারা আজ লাল পেনশন বই আর খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে জবুথবু হেঁটে যাচ্ছে এক শস্তা সরাইখানার পাশ ঘেঁষে!
শহরের যেকোনো প্রাচীন কয়েদীঘরেও ঠাঁই হতে পারত তাদের—অথচ তাদের মাথাভর্তি সমুদ্রের শব্দ আর তেল চিটচিটে অন্তর্বাসের ঘ্রাণ!
মাঝরাতে কতিপয় কয়েদী নাবিক হেঁটে যায়—জাহাজের সাইরেনে চাপা পড়ে যায় পাপ ও পতনের দাগ!
শারদ
শরতের ডাকবাক্স খুলে উড়ে আসে ভবঘুরে মেঘ—বিকেলের ছায়ারোদ চিরে ডেকে ওঠে বনঘুঘু’র শিস—আর আমি এ শরতে সাইকেলে করে ছুটে যাই ধরলা নদীর তীরে!
খুচরো টিকিট হাতে দূর থেকে চেয়ে দেখি টিনশেড শেফালি অপেরা!
দূরের ছড়ানো ভাঁটফুলে জেগে ওঠে ভাটির ঘুঙুর—কীর্তন পয়ার সুরে নর্তকের ক্যাশবাক্সে ভরে ওঠে জ্যোতির মোহর!
এ শরতে রাধার শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে শোনো আজ অপেরার গান— জরির কাঁচুলি ফুঁড়ে দ্যাখো জেগে ওঠে কামিনীর ঘ্রাণ—দূরের মাদল সুরে নেচে ওঠে গহিন পরান!
লবঙ্গ
মাঝরাতে ঘন জঙ্গলের গহিন ভিতরে লবঙ্গের ঘ্রাণ ভেসে আসে—অন্ধকার জঙ্গলের পথে মৃদু আলোরেখা দেখা যায়—ভেসে ওঠে টুকরো টুকরো সতেজতা—হাওয়া হরিৎ ক্লোরোফিল ঘ্রাণ!
খড়ের গাদার নিচে শাদা ঘোড়াগুলো ঘাস খায় ঈষৎ ঠিক্রে পড়া চাঁদের আলোয়! এ রাতে তাঁবুতেই থাকব—মৃদু লবঙ্গের ঘ্রাণে—পাতাঘেরা কুহক কুটিরে—ঘুমঘোর সুরের ডেরায়!
বনমোরগের ছেঁড়া ছেঁড়া ডাক উঠে আসার আগেই আমি আবারো ডুবে যাব এই জঙ্গলের ছড়ানো তাঁবুতে!
সমুদ্র ও সরাইখানা
মাঝরাতে সমুদ্র আর সরাইখানাকে আমার কাছে একই বলে মনে হয়—একই রকম কলরব, একই রকম গান ও ঘ্রাণ, একই রকম ঢেউ! সমুদ্রের উপচানো ফেনাকে মনে হয় গেলাসে গেলাসে জমা তরল আরক!
এক সমুদ্রসারস ধীর লয়ে ডানা মেলে উড়ে যায় মাস্তুলের ফুঁসে ওঠা গ্রীবা চিরে—নীল জলরাশি ছুঁয়ে তার শঙ্খঘ্রাণ যেনবা আছ্ড়ে পড়ে মর্চে পড়া ডকইয়ার্ডের তীরে!
বাইরে সৈকত থেকে কিছুটা দূরেই এক সহিস আমার জন্যে অপেক্ষা করছে তার রোমশ শ্বেতাভ ঘোড়া নিয়ে—সে আমাকে পৌঁছে দিবে লণ্ঠন জ্বালানো এক পানশালায়—যেখানে ক্রিস্টাল লবণের ঘ্রাণে আর স্ফটিক নারীর শাদা অন্তর্বাসে মাঝরাতে ভেসে বেড়ায় শুধু সমুদ্রের স্রোতকান্না!