বেগম রোকেয়া
আমাদের দগ্ধকালের অগ্নিউত্তাপে
কোনো স্বপ্ন, কোনো সাধ-সাধ্য ছিল না নারীর!
কী আড়ালবেড়ি তার পায়ে, কী দাসত্ব খেলে তাকে নিয়ে,
কী অক্ষম প্রণোদনায় সংসার সন্তান স্বামীময়
পৃথিবী তাহার—
এসব মাপজোক ফাঁক ও ফোঁকর বোকা নারীনক্ষত্রগণ—
কখনো বোঝেনি।
১৯০২ সাল। সমযোগ্যতায় অধিকারে
চেতনার সয়ম্ভুসভায় তোমার তীব্র উত্থান!
তারপর—
মতিচুর, অবরোধবাসিনী, পদ্মরাগের আভা ও আলোয় দৃপ্ত বঙ্গজ-নারী!
সেই থেকে তুমি আজও খুলে খুলে রাখো পথ!
নারীর চিন্তাবৈভব—তোমাকেই ধারণ করে
নেতৃত্বসভায়!
তুমি আজও স্বপ্ন বুননের শ্রেষ্ঠ কারিগর—
তোমাকে মুক্তি মানি, যুক্তিও তোমারই চিন্তনে—
তুমি আছ, তুমি রবে অন্তহীন প্রজন্মে প্রজন্মে!
আবার এসো পিতা
নক্ষত্রমুকুরে মুখ দেখতে গিয়ে
তোমাকে মনে পড়ে যায়—
শিশুর প্রাণের দোলায় প্রাণ হতে গিয়ে
তোমাকে মনে পড়ে যায়!
কে না জানে—
এই জলমুকুরে, রোদের বৃন্তে, সবুজ জারক রসে
তোমার অধিক কেউ সিক্ত হয় নাই।
এই পোড়া ভূখণ্ডে, দাহকাণ্ডের উপাখ্যানে
আভূমি পদাতিক সৈনিক তুমি!
ঘাঁই মেতে উঠে দাঁড়ালে—মানচিত্রের মঞ্চে
মহাকুরুক্ষেত্রের রণোন্মাদ বাণীতে—
‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’
আমাদের দুর্গের ভেতর ভাষা-সংস্কৃতির বন্ধনে
ধর্মের কোনো বিভাজন অঙ্কিত ছিল না।
আজ বহু বছর পরে—
এই ধর্ম বিভাজিত দেশে—
হে পৌরাণিক বীর আদিগন্ত চিন্তক
আমারা তোমার দুর্গ যোদ্ধাগণ
তোমার পাঠ না নিতে না নিতে
সংঘের যুক্তিকে ফিরিয়ে দিতে দিতে—
না মানুষ, না বাঙালি হয়ে উঠেছি!
আমাদের হাতের ভেতর থেকে নখ
মুখের ভেতর থেকে দাঁত
চোখের ভেতর থেকে ঘৃণা
বেরিয়ে এসে তছনছ করে দিচ্ছে
তোমার সোনার বাংলা!
তাই আজ তোমার দিক-নির্দেশিত তর্জনিকে
মনে পড়ে যায়।
যে দেশ ভস্মীভূত আজ ধর্মসভায়
তাকে মনে পড়ে যায়—
এই দাহখণ্ড অগ্নিচিহ্নপত্রে
পৌরাণিক বীরের মতোন আরও একবার
দাঁড়াও পিতা
পাতাল ফুঁড়ে নেমে যাক তোমার পদযুগল
আকাশ ছুঁয়ে তোমার মস্তক
একটি ছাতার নিচে ‘বঙ্গের সঙ্গীতে’ হোক
আমাদের একত্রিত বাস।
তবু প্রাত্যহিকী
কখনো বলিনি, আসলে, বুঝতেই পারিনি—স্বপ্নগুলো নেই!
নদীর পাড়ের হাওয়া, বন্ধুদের হাসি,
ঝালমুড়ি অথবা বাদামের খোসা ভাঙা আঙুল,
শীতার্ত সন্ধ্যায় কাঁথামুড়ির যুগলউষ্ণতা—
মাথাভর্তি চুলে আঙুল—নেই!
ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলা খাতার পাতা ফের সাদা হয়ে ওঠে না।
নিজেকে ঝুলিয়ে দিয়েছি ফ্রেমে
দেয়ালে
তবু প্রাত্যহিকী! ফ্রেম খুলে বেরিয়ে পড়ি
মনোটোনাস!
দগ্ধপাত ঘটে! প্রাত্যহিকীর হিসাব, জীবিকা ও জীবনের অযুত সংহার!
বিভ্রান্ত নিউরনগুলো ডিসঅর্ডারে ভোগে।
বেঁচে আছি, কেননা
আজও শ্বাসের ভেতর নুনের মতোন
সমুদ্র ভেসে আসে!