১.
সেগুন কাঠের ঘ্রাণ এলো, আমার বাসর ঘরে
বয়ে গেল ঝড়, দ্রুত ঢুকে গেল পাঁচটি জোনাকি।
দীর্ঘ হতে হতে দুই খণ্ড মেঘ মিশেছে সমুদ্রে—
এখান থেকেই শুরু হতে পারে গল্প মেয়েটির,
যার হাতে আমি তুলে দিয়েছি সকল হৃৎপিণ্ড,
দিয়েছি উজ্জ্বল শিরস্ত্রাণ আর জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়।
পৃথিবীর প্রথম জ্যোৎস্না যারা দেখেছিল, প্রস্তরিত
তাদের করোটি ও অক্ষিগোলক তোমার হাতেই
আমি তুলে দেব। তুমি আজ গোত্রপ্রধান তাদের।
কে ছিল প্রথম নারী খোঁপায় যে গুঁজেছিল ফুল?
তার কথা আজও বলে গেঁয়োভূত, দেবদূত, আর
নৈশভ্রমরেরা— সে-আগুনে আজো বন পুড়ে যায়।
পাঁচ পাঁচটি চন্দ্রিমা গুঁজে দেব তোমার খোঁপায়—
বাউরি বাতাস বয় হৃৎপিণ্ডে, আর বয় ছুরি।
২.
জল খাবো, ওগো তুমি ঠোঁটে করে নিয়ে আসো জল।
অন্তিমের নীল থেকে, অসমাপ্ত ভালোবাসা থেকে,
নিয়ে আসো জল। একেকটি কবিতার পর মৃত্যু
হয় একেকজন কবির। তারপর আসে এক
অচেনা ভ্রমর, ফুঁকে দেয় প্রাণ, বেঁচে ওঠে কবি।
আবার সে পিষ্ট হয় চাঁদের চাকায়। রাতভর,
সুরম্য চন্দ্রিমা-ক্রোকারিজ দেখে বেঁচে থাকে কবি।
মূলত স্বপ্নের শুরু সেই উপত্যকায়, যেখানে
বাঘ ও হরিণ একই ঘাটে জল খায়। আজ তবে
বাঘ আর হরিণের অসমাপ্ত প্ররোচনা থেকে
ঠোঁটে করে নিয়ে আসো জল। প্রথম চুম্বনে আহা
কী করে যে ঢুকে গেল শেফালির ঘ্রাণ, জেনেছ কি?
বেদনালুপ্তির পথে বিছিয়ে দিল কে আফিমের ফুল?
প্রার্থিত গোলাপে মৃত্যু থাকে, হায়! জানে না প্রেমিক।
৩.
দ্রাক্ষাবনের সবুজ রক্ত যদি গায়ে মাখা যেত!
শোনো, স্বর্ণ-নিদ্রা থেকে জেগে, তোমার শরীর থেকে
গড়িয়ে গড়িয়ে নামা আঙুর খেয়েছি আজ রাতে।
জেনেছি শিকারকালে কোন এক অজ্ঞাত রহস্যে
শিকার ও শিকারী জড়িয়ে পড়ে। ঘুমন্ত নারীর পাশে
গন্ধপ্রদীপ জ্বেলে, বিষাদের দাঁত নিয়ে জেগে আছে
যে পুরুষ, দ্রাক্ষারসে দেখ ডুবে আছে তার নখ।
সকল চোখের জলে শ্রাবন খোঁজে সে, রোদেশ্বরী,
চন্দ্রিমা-ট্রামের নিচে পিষ্ট হতে আজ চলো যাই
রজনীগন্ধার বনে। সে পানশালায় যাই চলো,
কখনো যেখান থেকে ফিরে আসতে পারে না কোনো
চন্দ্রালোক। আজ জেগেছে গতি ও প্রকৃতির আলো।
রোদেশ্বরী, করতলে মুখ গুঁজে পড়ে আছে দেখ
দুরন্ত-পায়রা, তাকে নখ দিয়ে অনন্তে জাগাও।
৪.
এ জীবন-দল যদি ফিরে ফিরে আসে সন্ধ্যাতীরে,
বৃষ্টিবনে আমি একা, যখন তোমার পক্ষে যাচ্ছে
চলে সমুদ্রের ঢেউ, সারস পাখির প্রেম, আর যদি
দেখা যায় পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে বের হয়ে
উড়ছে ভ্রমর! স্পর্শের চাদর দিয়ে ঢেকে দেবে
কি তখন বিজন দেহের ক্ষত? ঝিনুকের জ্বালা?
তখনো কি শোনা যাবে গণিকা-পাড়ার কলরোল?
সন্ধ্যাতীরে হে জীবনদল, ফিরে ফিরে আসো যদি
পৃথিবীর সেই অবিশ্বাস্য প্রথম বৃক্ষের তলে,
যার ঝিরিঝিরি বাঁকা পত্রপল্লবের ফাঁক দিয়ে
পৃথিবীর প্রথম মানব দেখেছিল পূর্ণিমার চাঁদ,
তাহলে শুনতে পাবে আজও, কেউ যেন বলছে হে
মনুষ্যমণ্ডলী, সকল ব্যথাই চন্দ্রালোকে বৃদ্ধি পায়,
আর সকল চোখের জলে কভু খোঁজো না শ্রাবণ।
৫.
একদিন গোপন কান্নার ঘর থেকে দেখা গেল চাঁদ।
দেখা গেল নাসরিন বসে আছে জ্যোৎস্নার কুঞ্জের
ভেতর। স্বপ্নের মধ্যে যত পথ খোলা আছে ফিরে
আসবার, তত ছুটোছুটি, ততটাই ঝিঁঝিঁগান
বুকে নিয়ে সন্ধ্যাগুলো ছুঁতে চায় নিখিল আকাশ।
সেই স্বপ্নচূড়া তবে কতদূর! মৃগনারী ওগো,
তোমার চোখের অস্তসূর্যগুলি কতদূর! আর কতদূর!!
গোপন কান্নার ঘরে ফুল ফোটে লোহিত গোলাপ।
মধ্য-নীশিথের হাহাকার নিদ্রাপাহাড়ের নিচে
চূর্ণ হয়ে যায়, প্রিয়তম, এ জটিল পূর্ণিমায়
অন্ধ পিপিলীকা তুমি হে, তোমার নিদ্রাহরণের
অধিকার চাই। থাকব পৃথিবী ছেড়ে যদি পাই
জলজ প্রবেশ, ঝিনুক-প্রদাহ থেকে মুক্তো এনে,
তুমি কুহকিনী, জ্যোৎস্না কুঞ্জে পরাব তোমার গলায়।
৬.
অদ্ভুত এ সমাপ্তির পর, প্রিয় কবুতর, আজ
অনন্ত নখের দাগে পৃষ্ঠা ভরে গেছে। আর দেখ
অনাদি প্রেমের নথি ছিঁড়ে নিয়ে নৈশভ্রমরেরা
অস্পষ্ট সংকেতে ডাকে, এসো বন্ধু, এসো গুরু তবে,
আরেক হেমন্তে জাগি ছায়াময় ছাইগাছ তলে।
অনন্ত নখের দাগ বাঘিনীর এলোচুলে ঢাকা
পড়ে থাকে। প্রিয় পারাবত, এ শীতার্ত রজনীতে
ব্রম্মান্ডের নির্জন ক্যামেরা যদি ক্লিক করে! যদি
কারো নিতম্ভের উজ্জ্বল অক্ষরগুলো ঝরে পড়ে!
আহা, জলপার্শ্বের তোমাকে তো চেয়েছি এই নীল
সমুদ্রসংসারে। ঢেউয়ে ঢেউয়ে প্রদোষের কালে
যৌন আস্ফালনের মতন নিভে যায় গোল চাঁদ,
একটি কামার্ত তারা শুধু জেগে থাকে অপলক—
আরেক বসন্তে এসো তুমি অখ্যাত প্রেমিকা হয়ে।
৭.
সমুদ্রে ছিলাম, এখন ভূমিতে এসে, গোত্রমাতা,
তোমার উঠোনে দেখি চাঁদ, ফড়িংয়ের অন্তর্বাস
পড়ে আছে। একটি পাতায় যতখানি দুঃখ ধরে
এরচে’ও অবিশ্বাস্য সব বাক্যালাপ করি চলো—
তোমারই জন্য আকাশের চাঁদ সমুদ্রের চাঁদ
একত্রে এনেছি। রাত্রি ছাড়া অন্য কোনও অনুষঙ্গে
বিশ্বাস জাগে না, শৈলহরিণেরা বিষাদ কুড়াক,
তুমি শুধু অন্তিমের পৃথক ভাষায় কথা বলো;
বৃথা-প্রজাপতিদের তোমার ছায়ায় টেনে নাও
জলজ কামনা ছেড়ে ওরা আজ উঠেছে ডাঙায়।
বালিকার হৃৎপিণ্ডে লুকানো বাতাস বয়ে গেলে
পৃথিবীতে বসন্ত আসে হে, তবু ফাল্গুনে নিঃসঙ্গ
হয় দুরন্ত বালক। দিগন্ত-ধনুকে যে কাঁপাতো
শস্যের প্রান্তর, তাকে, বিপর্যয়ে, সমুদ্রে জাগাও।
৮.
আমাদের নিঃশ্বাসের তাবু ছিঁড়ে চন্দ্রিমা-পেরেকে।
যারা রাত জেগে জোনাকীর কুচকাওয়াজ দেখে
ভোর হলে মিশে যায় জনসমুদ্রের জলে, যারা
মৃত্যুর পরেও কফিনের ছিদ্র দিয়ে প্রেমিকার
মুখ খুঁজে ফেরে, তারাই আমার নিজ সম্প্রদায়।
বিপর্যয়ে, যে কোন অন্তিম ডাক চিনে নেবে তারা,
তমসা পেরিয়ে আসা পাখিদের সম্ভ্রম বাঁচাতে
তারাই আমার শিঁরদাড়া, যে কোন সৃষ্টির ত্রাতা।
চন্দ্রাহত জলের ওপর ভাসে কৃষ্ণচূড়া-সেতু।
ঝিনুকের গোপন পৃষ্ঠায় ভ্রমণের অবসরে
তোমাকে নিয়েই ভাবি, তুমি গোত্রমাতা, বুদ্ধিমতী,
হরিণের ছাল দিয়ে ঢেকে রাখো আমার প্রণয়।
ঘুমন্ত ঠোঁটের কাছাকাছি এসে স্বপ্ন থামে, সখা,
আমাদের নিঃশ্বাসের তাবু ছিঁড়ে চন্দ্রিমা-পেরেকে।
৯.
সুহাসিনী চলে গেলেও তার গন্ধ থাকে, দিনভর
বাঁশির ভেতরে আমি যে বাতাস হয়ে বসে থাকি,
জানে না সে। ফিরে এলে নিতম্বে¦ বিজুরি চমকাবে
সংগোপনে, ময়ূরের আর্তরব লুটাবে শরীরে।
বনমোরগের নীলাভ থাবায় দেখি আসমান
এত নীল, ফিরে আসো যদি লাজ-কঙ্করের পথ
ধরে, হে উদাস, শীতলপাটিতে ঢেকে দেব আজ
তোমার হৃদয়। তুমি ছাড়া সাংগ্রাই হবে কি প্রিয়,
বিজু ও বৈসাবি? বোতল-নৃত্যের তালে সংক্রমিত
হলো ব্যাধি, পাহাড়িয়া দু’চুয়ানি সারাবে সে-ব্যাধি।
জ্যোৎস্নার রূপালী তীর ছুটে যাচ্ছে খেক শেয়ালের
দিকে, নিচু সে-পাহাড় আমাকে ডাকছে অভ্যন্তরে।
তুমি ফিরে আসো এমন জটিল ঘোরলাগা রাতে—
ডাহুক বসেছে ভাঙা ডালে মহুয়ার জল খেয়ে।
১০.
আলেকজান্ডার থামো, এখানে বাংলার শুরু। নই
আরব বনিক, প্রেমিক পুরুষ আমি কৌম-জীবনের—
সংগ্রামে, নিভৃতে, আজো যারা পক্ষীর ভাষায় কথা
বলে, যারা নারকেল পাতায় পিছলে পড়া জ্যোৎস্নায়
ধোয় এলোচুল। আমি সেই আদি তামাটে রক্তের
উত্তরাধিকার যারা শিকার ও সংগ্রহের দিনে
গড়ে তোলে অভিসার। পোড়ানো মাটির অলঙ্কারে
চূড়া করে খোঁপা বেঁধে, অমিয় ভান্ডার খুলে দেয়
দ্রাবিড় রমনী। দাঁড়াও হে আলেকজান্ডার, শোনো,
এখানে বাংলার শুরু, এ সীমান্তরেখা অতিক্রম
করো না, ভেতরে লড়াকু পুরুষ, পাশে বসে আছে
চন্দ্রমুখী শ্যামলা রমণী। পোষা পাখি উড়ে গেলে,
এ নারী ঘরের কোনে খোঁজে পায় হারানো আকাশ,
খোঁজে পায় হেমনদী, বাহ্যজ্ঞান, হেমন্ত-বাগান।
১১.
বালাম গ্রন্থের ছেঁড়া পাতায় পাতায় খুঁজি তাকে,
মৃৎপাত্রে, মুদ্রায় খোদিত লিপি আর ধূসর সংকেতে।
একদিন যাকে ভালোবেসে এক অনার্য যুবক
বেতস লতার ঘ্রাণে ভরে দিয়েছিল কোমল নিঃশ্বাস,
তাকে খুঁজি আজো এই চোরাগোপ্তা নিঝুম জ্যোৎস্নায়।
গোত্রমাতা, তোকে ভালোবেসে যারা ক্ষয়ে গেছে দূর
নীলিমায়, রাতের ঝিনুকে পোড়া তাদের করোটি
দিয়ে উৎসব করি চল্ মহাজনপদে, আজ
চাঁদে-পাওয়া হাড়ের স্পর্শে জাগুক স্বদেশ। প্রতিক্ষণ
তোমাকে ভাবনা করি, গঙারিডি, মা আমার! দেখ
উপকূলে বিদেশি জাহাজ, প্রতিরোধ করো তাকে
আজ, চোরাগোপ্তা বন্য জ্যোৎস্নায়। সমুদ্র প্রবালের
মতো সংঘবদ্ধ করো তোমার সন্তানদের, গড়ে
তোল প্রতিরক্ষা, গড়ে তোল আজ পানির দেয়াল।
১২.
জীবিকার বাঁকা পথে হেঁটো না তনুশ্রী, চলো যাই
মাছের পেটের নীল জ্যেৎস্নায়, ইউনূছ নবী
যেখানে ঘুমায় সেই চন্দ্রিমা-গহ্বরে, অনন্তের
ফাঁদ পাতা আছে কি না দেখে আসি। সবুজ আত্মার
তলে এতগুলি বাদামি চুম্বন রেখে গেল যারা,
আমাদের প্রণয়ের পথে পথে তাদের নিবিঢ়
সজীব প্রার্থনা আর পরিভাষা পড়ে থাকে আজও।
নিঃস্তব্ধ এ রাতে, জীবিকার বক্র-পথে যেও না তনুশ্রী।
জোনাকি পোকার পায়ে ঘুঙুর পরিয়ে ছেড়ে দাও
হাওয়ায় হাওয়ায়, মিথ্যে-কিরণের ফাঁদে পা জড়াবে
একাকী ঈশ্বরও। কে আমাকে প্রশ্ন করে আজ এই
ঘোর নীশিতে, নিঃসঙ্গতার তীরে বসে? কে তোমাকে
ধ্বংসের কিনারে বসে নিবেদন করে রবীন্দ্রসঙ্গীত?
১৩.
বর্বর ছুরির নিচে রঙিন মানুষ, তবু হাসে,
আর প্রতীক্ষায় থাকে কখন পায়ের কাছে
উড়ে এসে পড়বে সবুজ পাতা, সে-পাতার প্রতি
কোষে কোষে সে লড়াইয়ের বীজ রুয়ে যেতে চায়।
আমাদের চোখে আজ সমুদ্রের বিষণ্ন লবণ
আমরা চাইনি যুদ্ধ, করতলে গোলাপ চেয়েছি।
মাটি ফুড়ে জেগে ওঠা হায়েনারা হৃৎপিণ্ড খুলে
খেতে চায়। গোত্রমাতা, তুমি তো জেনেছ আবহমান
এই মাটি, জ্যোৎস্নাধোয়া বেদনার জল আর এই
প্রহেলিকাময় চাঁদ কোনও পাষণ্ডের জন্য নয়।
মহাকাশ থেকে পৃথিবীকে দেখলে কী মায়া লাগে!
কিন্তু মাটিতে দাঁড়িয়ে চারপাশে চোখ রেখে দেখো;
এমনকি নিজেকেও বিশ্বাস করা কঠিন—আমি কি
মানুষ? না ঘাতকের অবিকল প্রতিরূপ আমি?
১৪.
দাউদ, তোমার এ সুরের ইন্দ্রজালে, জল থেকে
মাছ উঠে এসেছে ডাঙায়, ক্ষুধার্ত সিংহের পিঠে
চড়ে ভেসে আসে হরিণ শাবক, মায়াবী বিভ্রম-জালে
ফেসে যায় আরও কত পাখ-পাখালির প্রাণ।
হে দাউদ, চন্দ্র-মৃত্তিকার খাদে পড়ে গেল দেখো—
প্রেমিকার রস খেয়ে মাতাল হওয়া লোহিত মানুষ।
সে-কোন গানের তোড়ে ডাল থেকে খসে পড়েছিল
পাতা? কিংবা বৃন্ত থেকে থোকা থোকা শেফালি কুসুম?
এই চন্দ্র-দীপালিতে পাঠ করো দেখি বনলতা সেন,
শেষের কবিতা কিংবা সোনালি কাবিন। আর এই
ছায়া ছায়া স্তব্ধতার মধ্য থেকে বেড়ে ওঠা ভুল,
গন্ধরাজ মানব জীবন পাঠ করো, পাঠ করো
প্রেমিকার জামায় লুকানো নীল চিঠি, হৃৎপিণ্ডে
অঙ্কিত পতাকা তুমি পাঠ করো শঙ্খলাগা রাতে।