ভয়ের বরফ যুগ
কতকাল কেটে যাচ্ছে ভয়ের বরফ যুগে
রক্তে ও বাহিরে শঙ্কা তুষারপাতের মতো ছেয়ে যাচ্ছে কতকাল
শিকারির লোভে সাদা ভালুকের পদছাপ রক্তের অক্ষরে আঁকে পথ
স্বজনের শোকে অশ্রু জমে জমে পর্বত উঠেছে আকাশ সমান
কোথাও উত্তাপ নেই
সাহসের অগ্নিগিরি প্রত্নইতিহাসে ছাগলের ঘাসে দীর্ঘশ্বাসে ঢাকা
কোথাও মানুষ নেই
সবুজ অঙ্কুর
খোলা বাতাসের গান
. নদীর পরান
. মুখরিত গাঁও
বিরল সুখের মতো রাতের স্বপ্নের মতো উধাও উধাও।
লৌহযুগ পার হয়ে তাই ভদ্র পেঙ্গুইন হয়ে হেলে দুলে চলি ফিরি
রাগের বারুদ নেই
. আবেগের মেঘেরা নিখোঁজ
. চোখের সামনে ঈগলের নখঠোঁট ছিঁড়ে খায়
. সন্তানের দেহপ্রাণ
. আমরা ভয়ের শীতে কুয়াশায় থরথর কাঁপি অফুরান।
ভয়ের ভূগোলে আমাদের বসবাস
পুত্রহারা বোবা বঙ্গ জননীর কান্নাভেজা হাহুতাশ
. রক্তের স্পন্দনে বয়ে আনে সর্বনাশ!
কোথায় মানুষ আছে জানা নেই কারো
যদি কোনো সাড়া থাকে
ভয়ের বরফ ভেঙে আগুন জ্বালতে পারো
সহসা মানুষ যুগ ফিরে আসবে জগতে
চেরাগ আলীর শোণিতের পথে।
কালের দেয়াল
আজকাল দেয়ালই মুখ্য হয়ে সামনে দাঁড়ায়
জীবনের প্রাণপাখি রক্তমুখে ডানা ঝাপটায়
ওড়াউড়ি দিন যেন ঝরা পালকের ক্ষতস্মৃতি
বাতাসে বিলীন আজ কর্ষিত অর্জিত সব কৃতি
কালের দেয়ালে তাই দুই প্রান্তে আমরা দুজন
যাপিত জীবন মনে হয় রক্ত লাভার ভুবন
দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে কোটি মানুষের দীর্ঘশ্বাসে
প্রতিটি ইটের মনে গায়ে খুনের কাহিনি ভাসে
দেয়াল ভাঙার চিন্তা আজকাল উধাও পবনে
তাই লুটের আনন্দ প্রাণ পায় ভোগের ভবনে
জিয়ে রেখে আর কিবা হবে মানুষের পরিচয়
যখন আহত মন মেনেছে আসন্ন পরাজয়
হয় মরি নয় ভাঙি আজ দেয়ালের শিরদাঁড়া
ভাঙনের পর আসে জানি সব জীবনের সাড়া।
বসন্তের উতল বাতাসে
এই রমনা উদ্যান বসন্তের উতল বাতাসে
প্রাণজ উচ্ছ্বাসে সবুজাভ সাজে ও সজ্জায় পরিপূর্ণ
তুমিও সবুজে লালে শিহরিত বাতাসের তালে উৎফুল্ল
সকালের বৃষ্টির আমেজ এখনো মাটিতে হাওয়ায় দিচ্ছে দোল
আহ্ নিশ্বাস নিলাম তৃষ্ণাতুর নাগরিক প্রাণ ভরে
সবুজের মায়াময় শান্তির ছায়ায় আমরা যতোই হেঁটে গেলাম গহীনে
মুগ্ধতায় আনন্দে খুশিতে স্ফূর্তিতে হলাম আত্মহারা।
এই যে বকুল—গন্ধে ডুবে ভরপুর হয়ে আছে সুবাস ছড়িয়ে
এই যে মহুয়া—আমাদের মাতোয়ারা করতে করতে নিয়ে যায়
. অতীতের জোছনা রাঙানো মাতাল উঠোনে
গন্ধরাজ, নাগেশ্বর, পলাশ, কনকচাঁপা, মাধবী, নাগলিঙ্গম কতশত
নাম না জানা ফুলের বন্যায় ভাসতে থাকলাম ঘাসের সবুজে—
অলৌকিক সজীবতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে।
আমি একটা একটা করে সমস্ত ফুলের গাথা
তোমার পবিত্র হাতে তুলে দিতেই
উজ্জ্বল হাসিতে মুগ্ধতায়
ঘ্রাণ নিতে নিতে তুমি হয়ে গেলে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি নারী
উদ্যানের বাইরে অথচ সমস্ত অসুন্দরের তুফান বয়ে যাচ্ছে
তাই নাগরিক তাড়া খেয়ে আমাদের ভালোলাগা-ভালোবাসা
. এখানে আশ্রয় নিল।
আমাদের অপার্থিব আনন্দ উচ্ছ্বাসে
পাখিদের মুখরিত গুঞ্জরিত প্রশান্তিতে
আজ নাগরিক এই স্বর্গীয় উদ্যান হয়ে গেলো তপোবন
তুমি শকুন্তলা—নয়া জীববনের উজ্জীবনে প্রাণবন্ত তোমার অরণ্য মন
আমি দুষ্মন্তের মতো রেখে গেলাম শুধুই ফুলের স্মারক শিহরণ।
কালের কাছিম
দিনের বেলায় তেড়ে বেড়ায় ভীষণ কামড়ায়
সারাক্ষণ করে শুধু ঘেউঘেউ
রাতের বেলায় শুঁকে শুঁকে খুঁজে বেড়ায় শিকার
সারাক্ষণ করে শুধু হুক্কাহুয়া।
প্রস্থানের পথ নেই
কালের কুকুর আর কালের শেয়াল
আমাদের চারপাশে তৈরি করেছে দেয়াল
শিয়রে ভয়ের হিমালয়
পায়ের পাতায় বঙ্গোপসাগর
ডানে বামে মৃত্যুফাঁদ পেতে আছে বিদ্যুতের কাঁটাতার।
এই মাটির সন্তান আমি
এই মাটিতে আমার উত্তরাধিকার
এই মাঠনদী প্রাণজ প্রান্তর জনপদ ছেড়ে
চলে যাব আমি কোথায়, আশ্চর্য।
বাঁচার তাগিদে তাই হয়েছি এখন কালের কাছিম
সুদৃশ্য কঠিন এক খোলসে নিজেকে আড়ালে রেখেছি
অথচ আমার চোখমুখ সমুদ্রের দিকে তৃষ্ণাতুর
ধীরে ধীরে প্রতিটি কদমে দৃঢ়তা জড়িয়ে যেতে হবে বহুদূর।
মাকড়সা-জাল
ঘুটঘুটে রাতে জোনাকির মতো জ্বলতে জ্বলতে
মাকড়সা-জালে আটকা পড়েছি চলতে চলতে
এই রাত যেন শত বছরের বেদনায় ভরা
জোছনার দীপ নেই প্রাণ নেই আছে শুধু জরা
ঈগলে শেয়ালে ভালুকে সিংহে ছাড়ে হুঙ্কার
এই ফাঁদে বাঁচি ওই ফাঁদে পড়ি নেই পারাপার
ধুঁকপুক হতে হতে যেই আমি ফেলি নিঃশ্বাস
তখনই এক মরণের জাল পরিয়েছে ফাঁস
ছটফট করি চিৎকার ধরি ত্রাতা নেই কেউ
কোথাও তোলে না কোথাও ওঠে না প্রতিবাদী ঢেউ
যতই ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা ততই ক্ষরণ
সমাধান বুঝি প্রতিরোধহীন কেবল মরণ
প্রকৃতির ধারা এভাবে এখানে এসে থেমে যাবে
অরণ্য জুড়ে রোদনের সুরে সব গান গাবে!
বহুদূরে শুনি ভেসে ভেসে আসে ওই পারুলের ডাক
ওই ‘’সাতভাই চম্পা জাগবে’ বলে দেয় হাঁক
আমি একা নই হাজার মানুষ মাকড়সা-জালে
একবার সাড়া দিলে শত রবি উঠবে সকালে।
জোনাকি
আপন আগুনে জ্বলে জ্বলে পুড়ে পুড়ে উড়ে উড়ে যাই ঠিকানায়
কোলাহল ভুলে নিজের মতন নির্জনে থেকে যেতে চাই
হুতুম প্যাঁচার সাথে বাদুড়ের সাথে সাক্ষাৎ না হোক কখনো
ডাহুকের সাথে হোক, সারারাত ডেকে ডেকে জেগে থাকবে মনও
দিনের বেলায় ঘাসের শরীরে ঝোপের আড়ালে ঢেকে রাখি মুখ
দহনবেলায় কাকের মিছিল বড্ড জ্বালায় প্রাণ খোলে দুখ
ঈগলের নখ চোখ ঠোঁট ডানা আমাকে তালাশ করে সারাক্ষণ
রাতের খোঁড়লে তাই বাঁচি মরি রজনি করেছি আবাস আপন
সাতটি তারার সাথী হয়ে জ্বলি আর নিভি রোজ সকাল অবধি
আমার আগুন মেঠোপথ প্রান্তরে এঁকে দিলো জোয়ারের নদী
সেই নদী ঢেউ ঢেউ চেরাগের আলো জ্বালে, ঝিঁঝিঁ তোলে কলরব
রাতের হৃদয়ে হীম আঁধারের শেয়াল কুকুর করে উৎসব
তবুও জগতে নিজের দহনে নিশির গোপনে জ্বালবো আগুন
হাজার বছর পর যদি আসে আসুক মাটিতে প্রাণের ফাগুন।
দীর্ঘ দুপুরের দাগ
এখনো আমার বুকে লোমের মতন জেগে আছে
সেইসব রোদপোড়া দীর্ঘ দুপুরের দাগ
তরমুজ ফালি হয়ে তাই হয়েছি দুভাগ
সবুজের আবরণ চিরে বের হয়ে গেছে রক্তিম হৃদয়
চারপাশে হল্লা করে হননের মাছি
আগ্রাসী গোঁফের মুখে দগদগে লোভ করে নাচানাচি।
সেইসব সূর্যপোড়া বৃষ্টিহীন দীর্ঘ দুপুরের দাগ
জীবন জমিনে জেগে আছে ইটের ভাটার মতো
শান্তিমাটি জ্বলতে জ্বলতে টেরাকোটা লাল
স্বপ্নমাটি ক্ষয়ে ক্ষয়ে মহাস্থানগড়ের দেয়াল
সুখ মাটি পুড়তে পুড়তে নাগাসাকি
এই দগ্ধ বুক দগ্ধ মন আমি এখন কোথায় রাখি?
শিশিরের ভোর জোছনার রাত আজ সমস্ত নির্বাক
শুধু দীর্ঘশ্বাসে দগ্ধ দীর্ঘ দুপুরের দাগ অহর্নিশ অতন্দ্র সজাগ।