ইঞ্জিনঘরে সঙ্গম
ট্রলার উঠছে—বৈঠাহীন নাবিক—পেছনে ইঞ্জিনঘর
মাথা ডুবে যাচ্ছে—সমস্বরে চেঁচাচ্ছে একদল প্রাণী
নদীতে ঘোলাজল—স্বপ্নের মতো শুয়ে আছে শৈশবস্মৃতি,
এখন আর পাটক্ষেতে নেই সোনালি আঁশের বাংলাদেশ
প্রিয় স্বদেশ, তোমাকে খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে ফেলি শ্রেষ্ঠ সময়;
জল বাড়ছে-কমছে, শব্দ জোরে-আস্তে, স্রোত আসছে-যাচ্ছে;
যারা গিয়েছে তারা আর আসবে না; গভীর নীরবতা—
যারা এখন আছে তারা আগে ছিল না; শূন্যতায় হইচই—
এই কণ্ঠস্বর-মুখ-চোখ একদিন হারাবে; গহীনে শব্দ—
নদী শুকাবে—জমি গ্রাস হবে—উড়ে যাবে গাছের মাথা
আকাশ ফেটে ঝরে পড়বে অলৌকিক বিশ্বাস; শুধুই অন্ধ চোখ—
কেউ-কেউ আড়ালে বসে থাকে গোসলখানায় খুব গোপনে
ইঞ্জিনঘরে তেল-মবিলের সঙ্গম, পাটক্ষেতে টাকিমাছের উৎসব;
ট্রলার কি নামছে—জল কি কমে যাচ্ছে—বাতাসে শব্দের ঢেউ!
একে-একে সবগুলো কণ্ঠস্বর বিলীন হবে কর্কশ ইঞ্জিনের চিৎকারে।
একটি লুঙ্গি ও রাতের হাওয়া
মাছি ধরার কৌশল আমি শিখিনি
জানি না কিভাবে পাখি ধরার ফাঁদ পাততে হয়
যারা বাতাস ধরতে চায় তারা আলোহীন চোখ
জোনাকির পাখায় যারা খুঁজে শাদা মেঘের পাহাড়
তারা বুঝে না শস্যবতী মাটি আর ছাইয়ের তফাৎ…
রাতের হঠাৎ হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে শহুরে সরল লুঙ্গি
গাছের গোড়ায় শুয়ে আছে শিয়াল ও কুকুর
বাতাসের ঠোঁটে চুমু খায় বহুগামী নির্লজ্জ ধূর্ত জননী
পুকুরে গড়াচ্ছে বেদনার্ত ক্লান্ত পাতিহাঁস—স্তনে নীল ব্যথা
সোনার ডিম হারিয়ে গেছে গহীন জলের স্রোতে;
লুঙ্গিটি পড়ে আছে মৃত ঘোড়ার মতো হঠাৎ বৃষ্টির
কাদাজলে, কেশর দুলছে নারিকেলের শাখায়-শাখায়
অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে তৃষ্ণার্ত কামুক চাঁদের বুড়ি
‘মধুর-মধুর কথা কইয়া চিত্তে দাগা দিলো’—এই গানটি
শুনতে-শুনতে আমিও খুঁজছি কফিনের চিরন্তন গন্ধ।
জলের গান
বটবৃক্ষের আড়াল থেকে উঠে আসে
মাতৃঢেউ—হে নদীর কোলাহল
তোমরা এখন কোথায় ঘুমাও!
রোদের নীরবতার ভেতর ঘুঘুর ডাক জলের ছায়া
মেঘের নিমগ্নতায় গর্ভবতী গাভীর বেদনার গান,
হে জননী তোমার মর্মরিত হৃদয় থেকে—
আমি এনেছি আগামী পৃথিবীর সম্ভাবনার স্বপ্ন;
হে আমার প্রিয় নারী—তুলতুলে তলপেটে জ্বালিয়ে দিয়েছি
জ্বলজ্বলে মাটির প্রদীপ, কচি-কোমল মাথায় বেড়ে উঠছে
আলোর পুতুল—আগামী স্বপ্নের দীর্ঘতর সাঁকোর মিলন;
একদিন পাখিদের ডায়েরি লিখে তোমার কাছে রেখে যাবো,
হে শান্তির ছায়ারানি বটবৃক্ষ—তুমি আমার পাখিদের ছায়া দিয়ো।
কালোছায়া সন্ধ্যা
মেঘ-বৃষ্টি-জল-মধু-মোম-মা আর নিঃসঙ্গতা
একই প্রচ্ছদে মোড়া বিমূর্ত ভাবনা, কল্পচিত্র ও হলুদ
দাগ, সাঁকোর তলপেটে আঁকা অনাহারী ভূগোল;
মমতার ঘ্রাণে ভরে উঠুক খাবারের শূন্য টেবিল,
বুক শেল্ফ, বিষণ্ণ বিছানা, ভোরের বালিশ…
স্নানঘরে ঝরে পড়ুক আনন্দ অশ্রুবিন্দু;
মা’র স্পর্শে ইচ্ছেময় হয়ে উঠুক বারান্দার শরীর
সবখানে ইচ্ছেময় হয়ে উঠুক নোলক দৃষ্টি,
কামের বাসনায় ঝরুক রান্নাঘরের ক্ষুধার্ত শিখা;
সবকিছু একদিন হয়ে যাবে ‘তুমি-আমি’
যেদিন আমরা ‘তুমি’ হবো সমুদ্র-স্নানে; আমি
একজন কালোছায়া সন্ধ্যা তোমার মঙ্গলঘাটে।
টিশার্ট ও জলস্তম্ভে ইঁদুরছানা
উড়ছে চুল যেনো শব্দরা শিস দিয়ে যায়…
চোখের পিছনে যে-কোটর তা রহস্যপথ, রক্তের ধনুক
চোখে ভাঙছে আগুনের মোকাম, মাংসপিণ্ডের তীর
সানগ্লাসে তরঙ্গের অমীমাংসিত গতি, ত্রিভুজের দুঃখ
মুখ ফিরালেই দেখতে পাবে ভাঙা গাছের হাসি;
চুল উড়ছে মাথা ঘুরছে ঠোঁট কাঁপছে, আঙুলহীন ছায়া…
কপাল নেই চিবুক নেই, করতলে শাদা-কালো ঘ্রাণ
নাকের ডগায় নাচে মৃদুল সন্ধ্যা, পাথরের বুকে জলফুল!
চুল বেয়ে নামে ইঁদুরছানা—হাতঘড়ি হারিয়ে গেলো জলে
টিশার্টের খোলা বোতাম উত্তরাধুনিক আহত থিওরির ঘুম;
চুলের কোনো হাত নেই যেমন চোখের দৃষ্টির…
আমরা প্রতিদিন সীমানা মাপি সীমাহীন বিশ্বাসের গালে
প্রতিনিয়ত আমাদের পাঁজর বেয়ে নামছে বিষের ঝরনা;
মুখ ও মুখোশের আড়ালে বাতাসের ডানায় জলের ছায়া
জলস্তম্ভের সাঁকো পেরুতে পারলেই মমতাময়ী আশ্রয়।