সূর্যের বিপরীতে দুই সূর্যমুখী ফুল
তোমার জলে আমার পূর্বাধিকারীর রক্ত
স্বতঃসিদ্ধ সত্য পরিমল দ্রং আর আরেং রিছিল।
নদের তীর ধরে হেঁটে যেতে
যেতে আগন্তুকেরা দেশাত্মবোধক গান গায় আবেস্তা ভাষায়।
তোমাদের মায়েরা কিছুই খুঁজে পায় না সেই সব
মরচে ধরা স্মৃতির ভেতর।
নিরাশ দুঃখমোড়া তাদের আত্মা কতটুকুই বা ছুঁতে পারে
স্বাধীন আকাশ?
কিংবা, পলতে পাতার হাওয়া কতটুকুই বা
উড়িয়ে নিতে পারে তাদের দুচোখের বিষাদমাখা রঙ!
তাদের ভেতর কেবল গুলির আওয়াজ, পতনের নাগলা ব্রীজ।
অতপর নরকদৃশ্যের ভেতর সুবিশাল নরক—
আগুন, মর্টারের শব্দ—আর্তনাদ।
হঠাৎ কমান্ডারের নির্দেশ—পিছু হটো।
বাড়ির পোষা বিড়ালটার কথা কি খুব মনে পড়েছিল
পিছু হটার সময়?
কিংবা দুধমাখা হাত—হয় তো মনে পড়েছিল!
কিন্তু কুয়াশায় জড়িয়ে গেলো পা।
মুহূর্তেই জলপাই রঙের ছুড়িতে ক্ষত-বিক্ষত তোমাদের আর্তনাদ!
আহ্ পরিমল দ্রং!
আহ্ আরেং রিছিল!
সূর্যের বিপরীতে দুই সূর্যমুখী ফুল কংস নদের জলে অস্ত গেলো!
আর সেই থেকে তাোমাদের আত্মারা ঘুরে বেড়ায় প্রস্ফুটিত সূর্যমুখী ক্ষেতে,
সেই থেকে কংস নদ, ছাই রঙ হাড্ডিসার মাথা।
চিঠি ও জননী
মা, কতদিন কুচিলাপাতায় তিতপুটির ঝোল খাই না
ট্রেনিং শেষ হলেই আসবো।
তুমি তো একটুকরো সবুজ ঘাস!
তোমার আঁচলের চৌহদ্দি পেরোনোর সাহস আমার নেই।
আমি এই তো আসছি!
দুই নং ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে সদ্য জয়েন করেছে ছেলে।
মায়ের বুকের ওম নেয় চিঠিখানা।
সেই থেকে মায়ের চিন্তা আচ্ছন্ন করে রাখে কুচিলার ঝোপ
মা আঙুলের কড় গোনেন, শনি যায় রবিবার ফুরোয় না
দুঃখের প্রলম্বিত ছায়া এসে পড়ে মায়ের উঠোনে
দীর্ঘশ্বাসের ডালপালা ভেঙে পড়ে মাথায়,
মগজটা থেৎঁলে যায়।
রাঙামাটিয়ায় যে সড়কটার নামকরণ করা হয়েছে শহীদ ফ্রান্সিস রবি সড়ক—
সেই সড়কে হাঁটতে থাকেন আর কাগজ কুড়ান—
দৈনিক পত্রিকার টুকরো, পরীক্ষার খাতা ছেঁড়া কাগজ।
পরিত্যক্ত কাগজের ধুলো ঝেড়ে হাইস্কুলের শিক্ষক ডরোথি মিসকে বলেন:
‘পড়ো তো দেখি, আমার রবি কী লিখেছে?’
দিদির চোখ ভিজে ওঠে জলে, তিনি চিঠি পড়েন,
বলেন—রবি আসবে…ট্রেনিং শেষ হলেই আসবে।’
একঝাঁক মিথ্যে রঙের সত্য কবুতর উড়ে যায় আকাশে।
চিঠি কুড়াতে কুড়াতে মা হেঁটে যান কুয়াশার পলেস্তারা দেওয়া স্বাধীনতার পথে।
যে হৃদয় বোধের অতীত
নিজের হাতে শুইয়ে দেবেন বলে ছেলের লাশ চান মা। তাই শূন্য কফিনটা নিয়ে আসা হয়েছিল উঠোনে। যত্ন করে কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল লাশহীন কফিন। মা কফিন ধরে থাকেন একহাতে আর হাতে আগলে রাখেন ছেলের খেলনার বাক্স। প্রলাপে তাঁর কঠিন প্রার্থনা। বুকের গভীরে তলিয়ে যেতে যেতে কপালের এলানো চুল ছিঁড়তে থাকেন। হঠাৎ শীতলক্ষ্যার জলে জেগে ওঠে অসংখ্য খোকনের লাশ। কফিন ফেলে তিনি ছুটতে থাকেন, চারদিকে ধূসর দেয়াল, নিজের আর্তনাদের প্রতিধ্বনি। কোনো ইতিহাস খোকনের মায়ের আর্তনাদ লিখে রাখেনি; কোনো শিল্পী আঁকেনি তাঁর আত্মমগ্ন বিষণ্ন মুখ। তাঁর হৃদয়ে যা ঘটেছিল, তা রয়ে যাবে চিরকাল বোধের অতীত। আমরা কেবল তাঁর গল্প শুনি!