ঘুমের পোশাকে ওড়ে পাখি
আজ কেন দেরিতে আমার এই রৌদ্রযাত্রা!
যে কবরে আমি প্রতি রাতে ঢুকি তার মধ্যে যদি
এক তিল পরিমাণ মাটি পেতাম, তাহলে তাতে
একটা স্বপ্নের গাছ লাগাতাম; কিন্তু সে আশায়
গুঁড়েবালি; আমার কবরে কোনও গাছ-মাটি নেই
ঘাস নেই আছে শুধু এক দীর্ঘ জলশূন্য নদী।
সে এক অচেনা নদী—ঢেউ নেই তবু ভাঙে তীর:
ঘড়ির ডায়ালে দিন দ্রুত যায় রাত্রির খাঁচায়।
এ এক এমন নদী! যে নদীর ভাঙা তীরে পাখি
কী আশায় গাছে গাছে স্বপ্নের খয়েরি রঙ দিয়ে
বসতি বানায়! বুকে তৃষ্ণা চোখে জল, আছে শুধু
ঢেউ; জল ছাড়া এক নদী নিয়ে গত রাতে আমি
একটা পাখির জন্য কবরের মধ্যে নেমে পড়ি:
কবরে মৃতের চোখে পাখি ওড়ে ঘুমের পোশাকে।
বসন্তের বাঘ কিংবা বাঘের বসন্ত
মেয়েটা অস্থির হয়ে ছুটছে কেন হলুদ উৎসবে—
বসন্ত বাঘের মতো হামলে পড়ে ইটের বাগানে!
পাতার আড়ালে চিতা বসে আছে বহুদিন ধরে
রাত কাটে চন্দ্রহীন দিন গেলো মেঘের ডেরায়
শরীরে উত্তাপ নিয়ে বাসন্তিরা হাওয়ায় উড়ছে
ও ফালগুন! এ কেমন উন্মাদনা তোর! কুমারীর
চোখের আগুন থেকে বের হচ্ছে লকলকে ক্ষুধা
কে আছে রঙিন মাঝি ওকে নেবে তোমার নৌকায়
বাদাম উড়িয়ে নাচে তার বাঁকা কোমর জড়িয়ে!
আমি ভীতু চোখ বুঁজে পড়ে আছি নগরজঙ্গলে,
যে জঙ্গলে বাঘ নেই, আছে বাঘের থাবার মতো
হরিণশিকারি দল—তারা কিন্তু হরিণ না-দেখে
বসন্তে শিকারে নামে ডোরা কাটা হলুদ বাঘিনী
বাঘিনী বাঘের পিঠে বসন্তের আগুন জ্বালায়।
পতাকার লালবৃত্তে বধ্যভূমি
[চৌধুরী শহীদ কাদের, তপন পালিত, মামুন সিদ্দিকী,
আহম্মেদ শরীফ, মিঠুন সাহা, সুস্মিতা বৃষ্টি,
রেহানা পারভীন এ প্রজন্মের প্রমুখ সাহসী
যোদ্ধাকে মনে রেখে]
এক.
গণহত্যা বধ্যভূমি ও গণকবর—এ তিনটি শব্দে
গতকাল সকাল থেকেই আমি প্রবল আক্রান্ত
হয়ে আছি। আমি আকাশের দিকে আনমনে
যখনই তাকাই আমার কাছে ঐ আকাশটাকে
কেন জানি একটা গণকবর বলে মনে হয়;
লক্ষ কোটি নক্ষত্র যেমন এই দিনের আলোয়
একাকার হয়ে মিশে থাকে—মিশে আছে,
বহু মানুষের মরা মুখ তেমনি আমার অস্তিত্বে
মিশে আছে—যাদের রক্তেই পলাশ হয়েছে লাল,
প্রতিদিন সূর্য তার রঙ মেখে পোশাক পাল্টায়।
দুই.
অথচ ওরাই ছিলে আমাদের সব—প্রিয়জন:
কেউ পিতা কেউ মাতা কারও ভাই কারও বোন
কেউ ছিল একান্ত কাছের জন—আত্মার কুটুম।
গ্রামে গঞ্জে বাসরে বস্তিতে চলে মৃত্যুর মিছিল—
লাশের ওপরে লাশ, লাশ হয়ে পড়ে থাকে দিন;
সুন্দর নিরস্ত্র হাতে হায়েনার মুখোমুখি হয়—
সভ্যতা নিজের শব কাঁধে নিয়ে জঙ্গলে পালায়।
‘স্বাধীনতা’-এ শব্দটি অভিধানে খুঁজতে গিয়ে দেখি
তার পাশে বসে আছে গণহত্যা বধ্যভূমি; আর
অদূরে গণকবর পাহারায় শকুন শিয়াল;
বিবস্ত্র সতীর রক্তে গুমরে কাঁদে হাজার যমুনা।
তিন.
গণহত্যা-বধ্যভূমি গণগোর জরিপ বিষয়ে
একটা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী সেমিনারে গতকাল
একসঙ্গে কাটালাম সারাদিন আমরা বহুজন;
বেদনার্ত মন নিয়ে শুনেছি সে-সব মানুষের
জীবন দানের কথা—যারা ছিল অতি সাধারণ,
এতটা গরিব আর খেটে খাওয়া হতশ্রী এসব
মানুষের মতো দীনহীন জরাজীর্ণ জনগোষ্ঠী
পৃথিবীর অন্য দেশে অন্যখানে খুব বেশি নেই;
অথচ হায়েনাগুলো আমাদের একান্ত নিরীহ
সেই পূর্বপুরুষদের নির্বিচারে হত্যা করে—
বেয়নেটে বিদ্ধ লাশ ফেলে রাখে খালে, নর্দমায়।
অই সেমিনারে প্রজন্মের এক ঝাঁক গবেষক
কী দারুণ উদ্দীপনা বুকে নিয়ে সারা দিনমান
স্মৃতির কোদালে কত হাজার হাজার বধ্যভূমি
এবং গণকবর খুঁড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের
হাড় ও কঙ্কাল আমাদের সামনে তুলে ধরে!
হৃদয় বিদীর্ণ করা সেই সব কাহিনীতে দেখি:
শিয়ালে-কুকুরে মিলে অভিন্ন ক্ষুধায় মাকে খায়,
পিতার কঙ্কালে বাসা বাঁধে তেলাপোকা, আরশোলা
নাম না-জানা আরও কত কীট! এখানে ওখানে
ডোবায় হাত-পা বাঁধা গুলিবিদ্ধ মস্তকবিহীন
লাওয়ারিশ কত লাশ! কত কত লাশ পড়ে থাকে!
কেউ তার প্রকৃত হিসাব কোনোদিন রাখে নাই,
কেউ কি এখনো জানে কত লোক শহীদ হয়েছে
একটি পতাকা পেতে এ বাংলায়? কত মা ও বোন
বিসর্জন দিয়েছিল নিজের ইজ্জত! তা জানার
প্রয়োজন আছে, কেউ তা কখনো আগে ভাবে নাই।
কী করে ভাববে ওরা! না-চাওয়ার আগে সব পেয়ে
সবাই বিজয়ানন্দে এতকাল ধরে এত বেশি
মগ্ন আছে, পরাজিত দস্যুদের চতুর দোসর
ঘাতক দালাল খুনি কী নিপুণ দক্ষতায় খায়
মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির গৌরবের সমূহ ফসল!
ওরা তো বলেই যাবে ,লাভ নেই পেছনে তাকিয়ে—
বরং সামনে হাঁটো, খাও-দাও মজা লুটে নাও
সাগর কলার মতো স্বাধীনতা যত পারো খাও।
চার.
কালের পাথরে চাপা বেদনার গাথা ও কাহিনী
যখন তরুণ প্রজন্মের অই সাহসী যোদ্ধারা
একে একে সেমিনারে গভীর আবেগে তুলে ধরে
তখন অনেককে দেখি: বিষণ্ণ বদন, চোখে জল
টলমল; অশ্রুঝরা প্রহরের দীর্ঘশ্বাসগুলো
আকাশের মর্মে ঢুকে ভেদ করে বাতাসের বাহু;
বেদনার বিষে নীল আকাশটাও স্থির হয়ে যায়;
এক ধরনের ভয় আর আতঙ্কের ছায়া মনে
কেবলই লতিয়ে ওঠে পাঁজরের শিরদাঁড়া বেয়ে।
প্রিয় সঙ্গিনীকে শিকারীর হাতে ফেলে গিয়ে
হরিণী যেভাবে কাঁদে সেইরূপ কান্নার ভাষায়
সতত গোপনে কাঁদে বাংলাদেশ; সন্তানের শোকে
মা যেমন সারাক্ষণ বেদনায় আকীর্ণ থাকেন
তেমন যন্ত্রণা বুকে দেখি তিনি একা একজন
বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক ডক্টর মুনতাসীর মামুন
নিয়ত অস্থির চিত্তে ভালোবেসে এই মা-মাটিকে
সারা দেশ ঘুরে ঘুরে একটা বিষয় জানালেন,
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের ইতিহাস আছে
আছে তার জয়গাথা—খানসেনা আমীর আবদুল্লা
নিয়াজীর পরাজয়ে যদিও আমরা লাভ করি
স্বাধীনতা, চারিদিকে উড়ছে বিজয় পতাকা; কিন্তু
সবাই কেন এ সত্যটাকে বেমালুম ভুলে গেছে:
পতাকার লালবৃত্ত জুড়ে আছে লক্ষ বধ্যভূমি!
পাঁচ.
সেমিনারে মুনতাসীর মামুনের কথাগুলো শুনছি—
তাঁর কথা শুনতে শুনতে আমি ফিরে যাই একাত্তরে—
বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধতার অতলেই ডুবে থাকি;
যখন সম্বিত ফিরে পাই তখন আমার দম
প্রায় বন্ধ হয়ে যায়—ওই সেমিনার কক্ষ ছেড়ে
আমি বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে চাই। দু’ কদম হেঁটে
সামনে তাকিয়ে দেখি অদূরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান,
এ উদ্যানে প্রতি বিন্দু ধূলি কণা, গৌরবের স্মৃতি—
চিহ্নগুলো আমাকে অবাক হয়ে দ্যাখে, আর
দ্যাখে অই গর্বিত সুউচ্চ টাওয়ার—টাওয়ারে
কী সুন্দর একজোড়া শাদা কবুতর বসে আছে:
এই দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে দেখতে আমি অবচেতনে
বাংলা একাডেমির শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে
আবার প্রবেশ করি; আমি একা—ক্লান্ত অবসন্ন;
মনে মনে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়লাম। আচানক
ঘুমে বোধ হয় আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখি, দেখছি—
আমাকে অনেকগুলো বধ্যভূমি জড়িয়ে ধরেছে,
এবং একই সঙ্গে চারিদিক থেকে ভেসে আসে
লক্ষ গণকবরের ভীতিকর কান্না; সে কান্নার
মর্মঘাতী ধ্বনির ভেতরে সারি সারি কঙ্কালের
ভৌতিক বিলাপ শুনে ভয়ে আমি বধির হলাম—
অজ্ঞান অবশ হয়ে থাকি মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে।
যখন আমার জ্ঞান ফিরে আসে তখন হঠাৎ
কেন যে আমার মনে হলো, গণহত্যা-বধ্যভূমি
এবং গণকবর এ তিনটি শব্দ আজ আর
কোনো শব্দ নয়—আমার চেতনাযুদ্ধে মূল অস্ত্র,
যে অস্ত্র পাহারা দিচ্ছে সারাক্ষণ আমার ‘আমি’কে—
এ অস্ত্র পাহারা দেবে চিরকাল সোনার বাংলাকে।