গোপন মেঘধনু
পাথরের যতিচিহ্নগুলো সংরক্ষিত থাকে মানুষের পায়ে পায়ে,
যারা হেঁটে যায়, কিংবা যারা হাঁটতে পারে না, উভয় পক্ষই এক
গোপন মেঘধনু বুকে জমিয়ে লিখে নিজেদের যাপিত সংসারতন্ত্র,
লিখে সমুদ্রের জন্ম উৎসবের রোজনামচা, আঁকে পরখের নিয়ম।
কেউ কেউ আছে, জীবনে কিছুই লিখতে পারে না। লেখা তাদের
তপস্যা নয় ভেবেই তারা তাকিয়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ হাওয়ার দিকে,
হত্যাকাণ্ডের দিকে, হরণের দিকে। সড়ক পার হতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ
হয় যে হরিণ-শাবক; তার জন্য শোকহাওয়া বইয়ে দিয়ে আকাশ
ভারমুক্ত হতে চায়।মানুষ দায়মুক্তির ধার না ধেরে মৎস্য শিকারে
মনোযোগ দেয়। ঢেউয়ের বিপরীতে মুদ্রাঢেউ তুলে, কিনে বন-বাদাড়,
বালুমাটি, বিলাসিতার বন্ধ্যাত্ব। প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে যে চাঁদ একদিন
মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছিল; সেই চাঁদের আলোও সরিয়ে নেয় তার
রেখা পুনরায়। গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু শেষ হয় না।
দ্বাদশতম দর্শক হিসেবে সকল দৃশ্য ডানায় ধারণ করে একটি পাখি
উড়ে যেতে যেতে বলে;
. দেশান্তরের মতো নির্মম অভিনয় জগতে আর কিছু নেই।
এন্টিবডি
আমরা যেদিন এন্টি-এস্টাবলিশম্যান্টের বিরুদ্ধে দুহাত
তুলেছিলাম; সেদিনই আকাশ আমাদের মাথার ওপর
ছাদ হয়ে এগিয়ে এসেছিল। গোলপাতার ছাউনি দেওয়া
ঘর থেকে বেরিয়ে আমরা খুঁজেছিলাম বিপ্লব, প্রতিবিপ্লব
অথবা অতিবিপ্লবের সংজ্ঞা। চে গুয়েভারার ছবি সংবলিত
টি-শার্ট পরে রমনায় পোহিয়েছিলাম রোদ।
রোদ আমাদের সালোকসংশ্লেষণ দিয়েছিল। মানববৃক্ষের
আদলে দাঁড়িয়ে আমরা শিখেছিলাম বন্ধন-প্রক্রিয়া,
অথবা হাত ধরাধরি, জেনেছিলাম রসায়নের ভবিষ্যৎ।
আমাদের অনেক বিদ্যাই এখন বিগত প্রায়। লুপ্তপ্রায়
বৃক্ষের মতো আমরা এখন মরুবাসী। চারদিকে বিবিধ
রঙে যে ভয়গুলো তাড়া করছে, তাদের সাথেই নির্মিত
হচ্ছে আমাদের এন্টিবডি। নানা বর্ণের রেসপিরেটর মুখে
জড়িয়ে যে সময় আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে, তার দিকে
তাকাতেই আর আমাদের সাহস হচ্ছে না!
গেটের বাইরে যারা দাঁড়িয়ে আছে
এরা অপরিচিত কেউ নয়। অপরিচিত নয় এই গেটটিও।
কারাগারের ফটক কিংবা সুউচ্চ প্রাসাদের বাইরে রোদের
ঝিলিক ঠিকই মানুষকে উদ্বেলিত করে। ঠিকই পাতাবাহারের
ছায়া এসে মুখে পড়ে শিশুর। যে শিশু কয়েকটি জবাফুল
হাতে দাঁড়িয়ে আছে গেটের বাইরে। অথবা পলিথিনের ব্যাগে
হাওর থেকে তুলে আনা একগুচ্ছ কচুরি লতা হাতে দাঁড়িয়ে
আছেন যে পিতা, একনজর দেখা পাবার আশায়!
মানুষের ভালোবাসা সবসময় অর্থের নিরিখে বিবেচিত হয় না!
হয় কি? ঠিক জানি না আমি। অথচ এটা জানি যে পত্রিকা
হকার আমাকে বলেছিল,‘মামা, ঠিকানা দিয়েন পত্রিকা পাঠায়া
দিমু বিদেশে! টাকা দিতে হবে না, মামা!’
আমি তাদের জন্য একটি গেট খোলা রেখেই প্রতিরাতে ঘুমাই।
যারা বৃষ্টিতে ভিজে, বজ্রকে উপেক্ষা করে আমার প্রিয় সবুজ মাঠে
নিড়ানি দেয়। যারা প্রকৃত অর্থেই কার্তিকের ফসলের মাঠে লিখে
একটি কবিতা।
পেরেক বৃত্তান্ত
লোকটি টিন দিয়ে বানানো সাইবোর্ডটি লাগিয়ে দিলো
বটবৃক্ষের বুকে! দুটি লোহার পেরেকবিদ্ধ সাইনবোর্ডে
লেখা আছে ‘গাছে পেরেক মারবেন না!’
আমি অবাক না হয়েই খোলা আকাশের দিকে তাকালাম।
এই আকাশেও কয়েকটি পেরেক ঝুলিয়ে দেওয়ার পর অন্য
একটি লোক আমাকে বলেছিল, ‘বিদ্ধ করতে শিখেছি!’
আমি এখন প্রতিদিন গুলিবিদ্ধ পাখি দেখি
আমি এখন প্রতিদিন বুলেটবিদ্ধ শিশু দেখি
আমি এখন প্রতিদিন তীরবিদ্ধ নক্ষত্র দেখি
. আমার প্রতিরাত কেটে যায় পাথরবিদ্ধ
. মরুবাসী মানুষের খুলি দেখতে দেখতে।
আচ্ছা ফিলিস্তিন, ইয়ামেন কিংবা কাশ্মিরে কতটা
গোপন গোলা বিদ্ধ হয়, এর পরিসংখ্যান কি
কেউ আমাকে জানাতে পারেন!
যাপিত জ্যোৎস্নার জনম
জলে পা ভিজাতে গিয়েই আমি জেনেছি হিমাংকের দ্রাঘিমা
আগুনে হাত রাখতে রাখতেই আমি রপ্ত করেছি
. পুড়ে যাওয়ার বসন্ত-বৈভব।
এখানে পাঁজর ছিল, এখানে পতঙ্গেরা একদিন বিচরণ করেই
নিত মৃত্তিকার ঘ্রাণ। আর যে প্রেমের গল্প তুমি লিখে রেখেছ
কলাপাতার সবুজে; তার দিকে তাকাতে তাকাতেই
. আমি পেয়েছি সবুজের বিনয়ী আভা।
প্রেম সবসময়ই পৃথিবীর সমান্তরালে বসতি গড়া একটি
গ্রহের নাম। যাবতীয় আয়োজনের শাস্ত্র ভেদ করে মানুষ
যখন পরস্পরের কাছাকাছি যায়; তখনই জানতে পারে
. এর আগে কেমন ছিল যাপিত জ্যোৎস্নার জনম।
ঢেউ ফিরে আসে। জীবন ফেরে না।
নক্ষত্র স্থির থাকে। আয়ু থাকে না।
তারপরও একটি অলিখিত আয়ুবৃত্তে যে সময় ছন্দময়
তাকে ঘিরেই একটি গোলাপ অপেক্ষায় থাকে,
. বুকে রেখে আদি পরিচয়।
গুহাপাঠের সপ্তমপর্ব
চূড়ার দিকে তাকাবার সাহস সকলের থাকে না।
অথবা গুহার দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করতে পারে না
নিজের নাম, সাকিন, জন্মসাল।বলতে পারে না এই গুহায়
এর আগে আলো ছিল! এখন অন্ধকার দেখে যারা
অভ্যস্ত—তারা জানে না তারার প্রকৃত জন্মবিধান।
আমি পাঠের ভেতরেই নিজেকে আবিষ্কার করেছি
গুহাজীবনের পূর্বজীবনে। আর সন্ধি করেছি উড়ে যাওয়া
নবীন মেঘের সাথে। কুমারী কুসুমের চেয়ে আর কে
বেশি চেনে এই বরণের কাহিনি, এই উড়ন্ত মেঘের ঘূর্ণন!
দাঁড়াও, রোদেশ্বর
অধ্যাদেশ বার বার’ই জারি হয় প্রাণের কল্যাণে
যারা সংবিধান রচয়িতা; তারা বরাবরই এমন কিছু
অধ্যায় লুকিয়ে রেখেই নির্মাণ করেন একবিংশ পরিচ্ছেদ;
যাতে মানুষ মানুষের প্রতিপক্ষ হয়! অন্যায়গুলো যাতে
জমে থাকতে পারে বড় বড় দালানের ছাদে। আর ভূমিহীন
কৃষকের সন্তান আঁধারকেই মনে করতে পারে তার ভবিষ্যৎ!
আমি এর আগেও এই পৃথিবীর বহু মানুষকে থামতে বলেছি।
এই প্রজন্মকে শিখিয়েছি—থামিয়ে দেওয়ার কৌশল।
শরত যেমন বর্ষাকে থামতে বলে,
বসন্ত যেমন বন্ধ করে দেয় শীতের দরজা—
ঠিক সেভাবেই, সকল বৈরি-বিষাদকে খণ্ডন করে খুব
জোর গলায় বলেছি—দাঁড়াও রোদেশ্বর
যারা খুব ক্লান্তি বুকে নিয়ে বসে পড়েছে,
. তাদেরও হাত ধরে তুলো।
প্রাচীন পৃথিবীর দিকে মুখ ফিরিয়ে
অনেকগুলো একক বৃক্ষের পাশে নিজের ছায়া জমা
রাখতে রাখতে দেখি, একটি চিতাবাঘ হা করে আছে
সূর্যটাকে গিলবে বলে! একটি অন্ধকার কবর খুব
সাবধানে এগিয়ে আসছে বড় পরিচিত সমুদ্রের দিকে।
আর একটি টিকটিকি পাহারা দিচ্ছে চাঁদের ঘরবাড়ি,
কেউ যাতে লুটে নিতে না পারে এইসব আলোর বৈভব!
আমি আজীবন নিজেকে পাহারাদারই ভেবেছি একটি আয়ুর।
ভেবেছি, এর আগেও এই সেতু পার হয়েছে যারা তারা
কেউ অন্ধ ছিল, কেউ পঙ্গু ছিল, কেউ ছিল মহামারী পার
হওয়া অনাথ অশ্রমের বাসিন্দা। তাদের পাঁজরে ছিল প্রাণ
মূলত এই প্রাপ্তিতে অনায়াসে তারা ছিল সমান এবং সারথি।
সাম্যবাদ এই পৃথিবীতে কোনোদিনই উজ্জ্বল কোনো অধ্যায়
ছিল না। যা ছিল; তা সমাজবিজ্ঞানের লিখিত ধারা,মানুষকে
বোকা বানানোর অলিখিত অস্ত্র। যা দিয়ে বানোয়াট গল্প
বলা যায়। যা দিয়ে আবেগি কবিতা লেখা যায়। অভিনয়
করা যায় সিনেমাতেও, সাদা-কালো ধুতি কিংবা পাঞ্জাবি পরে।
প্রাচীন পৃথিবীর দিকে মুখ ফিরিয়ে আমি আর যা যা দেখেছি,
তার লিখিত বিবরণ রেখে গেলে মূলত মাটিই লজ্জিত হবে
আমার কাছে! আর আদিম শ্মশানগুলোও ভেসে যাবে নদীতে!
কৃষ্ণচন্দ্রের দ্রোহ
বৃক্ষ যেদিন মানুষের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল,
জেনেছি, সেদিনই প্রকৃতিতে নেমে এসেছিল বনেদি দুর্যোগ!
কিছু মানুষ হরণ করেছিল পাখিদের প্রশ্বাস;
কিছু নদী ভুলে গিয়েছিল ঢেউতন্ত্রের প্রকার;
কিছু পর্বত সকল অনিয়মের প্রতিবাদ করতে করতে
ভেঙে পড়েছিল মানুষের মাথার ওপর!
তারপরও মানুষ জমাট হতে ভুলে গেলো,
. হাত তুলতে ভুলে গিয়ে হলো ফেরারি !
দেশ না ছেড়েও মানুষ নির্বাসিত হতে পারে!
ভূমি না ছেড়েও মানুষ হয়ে যেতে পারে সর্বহারা!
আমি তোমাকে যে কৃষ্ণচন্দ্র সেন-এর গল্প বলছি,
অথবা যে কৃষ্ণ বরণ চাঁদ একদিন গ্রহণ করেছিল
তাবৎ মানুষের সকল বেদনা,
জানি, সমস্বরে সকল প্রাণ জেগে উঠলেই,
. জগতে আলোর আর কোনো অভাব থাকে না ।
মাঠপ্রদর্শকের ডায়েরি
‘এখানে একটি গভীর নদী ছিল’ বলতে বলতে
আমার হাত চেপে ধরলে তুমি!
অথচ আমি দেখলাম এখানে সবুজ ধানক্ষেত,
এর ওপারে দাঁড়িয়ে আছে
. সবজি সমেত হলুদ ঝিঙ্গেফুল;
না না পদের শাক,ডোবায় কলমিলতার ডগা!
দুইপাশে বয়ে যাওয়া দু’টি কালোরেখা
. দেখাতে দেখাতে মাঠপ্রদর্শক তাকে অনুসরণ
করতে বললেন। আমরা আরেকটু পথ এগিয়ে
যাওয়ার পর দেখলাম লাল পোড়ামাটির খাদ
‘এখানে একদিন একটি ছোট্ট জাহাজ ডুবে গিয়েছিল;
খোদাই করার কালে পাওয়া গিয়েছিল তার মাস্তুল!’
আমরা মাঠপ্রদর্শকের চোখ দিয়ে যেন
দে খতে থাকলাম
. আজ থেকে পাঁচশত বছর আগের নদী,
সেই নদীতে ভাসন্ত নৌকো, আর এর সওয়ারি
দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা,
যারা নিরুদ্দেশ হবে বলে একদিন ঘর ছেড়েছিল!
বৃষ্টিবাদী কার্তিকের হাত
নোঙর ফেলেনি কেউ,
তবু দেখি দাগ লেগে আছে বন্দরের হাড়ে
. উড়ছে বাষ্প- সাগরমাতৃক প্রেমার্দ্র সকালে
সবকিছু ভুলে, দাঁড়িয়ে আছে যারা
অথবা নাড়ছে হাত বিদায়ের
ফিরে আসবে বলে যারা কথা দিচ্ছে
. তাদের উদ্দেশে।
যারা ফিরবে না, তাদের বিরুদ্ধে কোনো
. অভিযোগ নেই আর
বরং যারা বৃষ্টিবাদী কার্তিকের হাত ছুঁয়ে
ভালোবাসার কথা বলেছিল,
. সমূহ হিসাব-নিকাশ আজ
তাদের সাথে। যারা বেঁচে আছে
এবং থাকবে যারা
তাদের জন্যেই বছরের নতুন দিন।
. নতুন অন্নের ভাপ
নতুন বিরহবিতর্ক, প্রেম-উৎসব
. সবকিছু
. সবকিছু ।
প্রান্তিক পক্ষশক্তি
আমিও অনেকটা টিপসই জানা মানুষ। বৃদ্ধাঙুলের রেখায় যে কালো কালি
লেগে থাকে তার দিকে তাকিয়ে চিনি আঁধারের পরিচয়। জানি, নিরক্ষর
নদীদের জন্মঠিকানা। পাহাড়ের আত্মদানের ইতিহাস। চূড়ার অতীত জীবনী।
যারা কিছুই জানে না বলে দাবি করে, তারা কিছুটা হলেও জানে গৃহপ্রবেশের
কৌশল। আমি এ বিশ্বাস স্থাপন করেছি পাতাদের হাতে হাত রেখে। দক্ষিণের
মৃদুহাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে নিতে তাকিয়েছি দূরের সমুদ্রপাথরের দিকে। অবেলায়।
আমি কি কখনো বেলাচিহ্নের পূজারি ছিলাম! কখনো কি চেয়েছি একহাতে
খুলে দেখতে তোমার দেওয়া ঘামেভেজা প্রেমপত্র! অথবা রুমালের ছায়া
পাচার করে আমি কি চেয়েছি, গড়ে তুলতে ভোগের লাল-নীল দালান!
কেউ আমার পক্ষে দাঁড়াক, তা আমার কাম্য ছিল না। আমার কণ্ঠে—
কণ্ঠ মিলিয়ে সুর তুলে উড়ে যাক কোনো হলদে পাখি, তা-ও চাইনি
আমি। তারপরও আমার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল চাঁদ আর তার প্রতিবেশীরা।
নিকষিত বৃক্ষের ভ্রূণে
পাঠের আনন্দ নিয়ে ভাসে নদী। ছানিপড়া চোখের ভেতর
যে ঘুম জমে আছে, তা আমাকে দেখতে দেয় না অনেক
কিছুই। তবু তাকাই, বৃষ্টির আলো এসে ঝাপটা দেয়
শিমুল শাখায়। আবার বসন্ত এলে যে পাখি ফিরবে ঘরে,
আমি তার অপেক্ষায় থাকি।
প্রেম, প্রতীক্ষার অণুসূত্র জানে। ভ্রূণ জানে জন্মের গন্তব্য।
আমার দেখার প্রান্তে সেই গন্তব্যের মায়াজাল ছড়িয়ে
থাকে, আমি তাকে বলি সংসার, আমি তাকে বলি ছায়া।
তুমি ছায়াবীথি হও।
নিকষিত টলটলে জলের মতো ভাসাও আমাকেও,
এখানে সমুদ্র ছিল,সেকথা সবাই জানুক
এই আকাশ দেখুক নবায়নের হলুদ কঙ্কাল।
বীজ আর বীক্ষণের শিয়রে
মাঝে মাঝে খুব বেশি ভুল করে ফেলি। অভিমানী পৃথিবীর
দিকে তাকিয়ে দেখি ক্ষয়িষ্ণু বোধের বিকেল, আমাকে গ্রাস
করতে এগিয়ে আসছে। যারা আমার সাথী ছিল, তারা সবাই
বেছে নিয়েছে অকাল অবকাশ। পেরিয়ে মধ্যবয়স তারা আর
কোনো নদীতেই কাটতে পারছে না সাঁতার। অথচ আমরা বার
বার ভাসবো, ডুববো, তারপর কৌশলী ডুবুরীর মতো ভিড়ে
যাবো রৌদ্র উপকূলে, এমন একটা প্রত্যয় ছিল খুব গোপনে।
সব গোপন, সকল সময় আর লুকানো থাকে না। রহিত রাত
এসে আলিঙ্গন করলে একান্ত বিরহও হয়ে যায় মায়াবী বুনন।
বীজ আর বীক্ষণের শিয়রে বসে শুধু হাত নাড়ে ভুলের রুমাল।
সেও ধারণ করে রেখেছে কিছুস্মৃতি, বৈশাখে আমাকে দেবে বলে।
লিখিত প্রবন্ধের পাতায়
একদিন আমরা সগর্বে ভাড়া দিতে চাইবো বৃষ্টিকুসুম ঘুম। যারা অনাদি কাল
অনিদ্রায় আছে, তাদের কাছে গিয়ে দিতে চাইবো রাতের ঘনিষ্ট বিবরণ।কতটা
হাতে নিলে পরখ করা যায় শিশির, কতটা পা ভিজে গেলে দেওয়া যায় অর্ধমৃত
নদীর সংজ্ঞা; সব কিছুই খোলাশা করতে চাইবো, লিখিত প্রবন্ধের পাতায়। আর
যারা দলিল লেখক, তাদেরও ‘লেখক’ অভিধা দিয়ে সেরে নিতে চাইবো স্থগিত
উপনির্বাচন। যারা কখনো ভোটের রাজনীতি শিখেনি, তারা আমাদের এই সহজ
বন্দোবস্ত দেখে নোয়াবে মাথা। যাদের চুল আছে, কিংবা যারা টাকমাথায়
ব্যবহার করেছে দীর্ঘ চুলের জন্য বনজ মহৌষধি, তারা সকলেই এসে দাঁড়াবে
আমাদের পেছনে। অতঃপর ‘স্পেস ফর রেন্ট’ লেখা ব্যানার হতে শিশুরা জমাবে
কুচকাওয়াজ। অনাবাদী নক্ষত্রগুলোর পালক ঝরতে দেখে কাঁদতে থাকবে একটি
বুড়ো জারুলবৃক্ষ।
সেলফের সফটনোটস
১
ছায়াগুচ্ছ পড়ে থাকে ‘প্রিন্ট অন ডিমান্ড’-এর ফাইলে। দাফতরিক
কাজ শেষে যে দুপুর বিরতিতে গিয়েছিল—শেষ হয়ে আসে তারও
সময়। নতুন নিরীক্ষণে জোতদারেরা পড়ে নদীভাঙনের নামতা।
সবুজের চৌহদ্দি পেরিয়ে ধূসর হতে থাকে ঘরহারা মানুষের স্বপ্নবসতি।
ডুবে যাওয়া ছবিগুলো ক্রমশ ভেসে উঠে। নামে সন্ধ্যা। এতকাল
বাতি ও বিত্তের যৌবন ধ্যানে মগ্ন ছিল যে রাত—দ্রোহ পরম্পরায়
সে-ও, পাল্টে ফেলতে থাকে তার মতামত। বীক্ষণের সংসারে
জমা হয় প্রান্তরের পলি।
সিলিকনভ্যালির সেলফে যে সফটনোটসগুলো পড়ে আছে, সেগুলো
আবারও উঁকি দিতে থাকে খুব বিনয়ে। হাড়মাংস নেই—
অথচ একহাজার বছর পরের কল্পনা ছুঁয়ে দেখার জন্য
দু’জন প্রেমিক-প্রেমিকার গ্রীবায় বার বার উদগ্রীব হতে থাকে
একজোড়া মার্কিনি চাঁদ।
২
রাফখাতার লেখাই একদিন মূল পাণ্ডুলিপি হয়ে ওঠে। বেড়ে ওঠা
পেশী, ধারণ করে ঝলকের সৌন্দর্য। আর পূজারী তার প্রাণের
সকল আরাধনা দিয়ে কাছে পেতে চায় শান্তির সমুদ্র, প্রেমের গ্রহমন।
সেলফে এখন শীতের যে শিহরণ জমে আছে, একদিন তার গদ্যবৃত্তান্ত
লিখা হয়েছিল প্রেমিকার কালো খোঁপায়। স্নানের প্রয়োজন ছিল না জেনেও,
প্রেমিক ঝাঁপ দিয়েছিল বেণীর কাজলে। দূরাগত মেঘ গেয়েছিল গান।
গানের স্বরলিপি এখনো বেজে যাচ্ছে ল্যাটিনো অর্কেস্ট্রার সুরে। পালকের
ভাঁজে যে বিরহচূর্ণ—তা ও তবে ধারাবাহিক বিচ্ছেদি সঙ্গীত!
যে চাঁদ গীটার বাজাতে জানে
এখানে একটি নদী ছিল। সেই নদীর তীরে বসে কাঁদতো একটি চাঁদ। চাঁদটি
ভিটেহীন ছিল একশ দশক।
গল্পটা এভাবেই শুরু হয়। আমরা জেনে যাই গৃহহীন প্রতিপত্তিবানদের অতীত
ইতিহাস। তারপর হাঁটি। হেঁটে যাই ঘাট পর্যন্ত। যে ঘাটে একদিন ভিড়তো
ভাঙা নৌকো। নৌকোর তলানি থেকে পানি সেচে এই এই নদীতেই ফেলে
দিতো প্রাজ্ঞ মাঝি। আমরা মাঝির হাতের কারুকাজ দেখতাম। আর দেখতাম
শেষরাতেও নদীপাড়ে থামে না মানুষের কোলাহল। নদী পারাপার।
এখানে একটি ঝড় ছিল। সেই ঝড় এখন হারিয়ে গিয়েছে অন্য কোনো দেশে।
তাই এদেশের মানুষ ভুলে গেছে কিভাবে ঝড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সাজাতে
হয় জীবন। অথবা ঝড়ের মতোই মাঝে মাঝে কিভাবে সবকিছু তছনছ করে
দিতে হয়। যে ভাবে হায়েনা শত্রুশিবির এই মানুষেরাই ভেঙে দিয়েছিল একাত্তরে।
নির্বাসিত ঝড় আর ভিটেহীন চাঁদ এখন একটি দ্বীপে অবরুদ্ধ জীবন কাটায়।
ঝড়-দুঃখ সহ্য করতে পারলেও, চাঁদ তা পারে না।
আমরা সেই কান্নার ধ্বনি প্রতিরাতে শুনি চাঁদের গিটারে।
ছুঁয়ে দেখো পঞ্চম পরাগ
বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখো। ছুঁয়ে দেখো বিকেলকে খোঁজার নিয়ম।
স্পর্শ করো এমন কোনো বসন্ত—
যে ঋতুতে চৈত্র নেই। ফালগুনের আয়ু যে বছর
ষাটদিন হবে, তার সাথে সেরে নাও বাৎসরিক আলাপ।
যে নদী সংগোপনে ছন্দবদ্ধ করে রেখেছিল প্রেমের
কথোপকথন, সখ্য গড়ে তোলো তার সাথে। এবং বাজিয়ে যাও
জলপদ্ম বাঁশি। সুর তুলে খরাচিত্রের মায়ায়।
চৌচির জীবনকে কাছে ডাকো। যে গোলাপ এতকাল
ঘুমিয়েছিল অনন্ত আদরে—জাগিয়ে তোলো তাকেও।
বন্দনা করো প্রান্তপর্বতের।
আঙুলে প্রহর গোণে গোণে—এই যে এগিয়ে যাওয়া ছায়া,
তার নামই তপস্যার তীর্থ। তার নামই প্রেমনগরের সাঁকো।
পার হতে পারলেই দেখবে, ওপারে দাঁড়িয়ে আছি
আমি—হাতে নিয়ে পঞ্চম পরাগ ।
বর্ণবুনটের রাতে
যে মদ পুড়িয়েছে মেদ—তা তুমি পান করতে চাওনি
জানি। যে গানে তুমি দিয়েছিলে সুর, পূর্বাধুনিক
. চাঁদের আদলে—সেই জ্যোতিও গ্রহণ করেনি
তোমার শিষ্যত্ব। বরং একাই ছুটে গেছ দুরন্ত
দুপুরকে সাক্ষী রেখে, একাই খুঁজেছ বাষ্পঘেরা
. আকাশের ছায়া।
অনেক ধারাবাহিক ইতিহাস তুমি পাল্টে
দিতে চেয়েছিলে কী-না, তা আমার জানা নেই।
তবে এটুকু জানি, সেই বর্ণবুনটের রাত আমাকেও
তোমার পাশাপাশি হেঁটে যাওয়ার পথ করে দিয়েছিল।
নীলান্তের হাওয়াকক্ষ
উড়ে যাচ্ছ—না কি জুড়ে থাকছো হৃদয়
তা দেখার জন্য উঁকি মারি আকাশের জানালায়।
হাওয়াকক্ষগুলো বন্ধ করে তুমি নিচ্ছ
. সান্ধ্যকালীন মেকআপ।
ডিনারের আগে যে চিত্রকর্মগুলো প্রদর্শিত হবে—
সেগুলোর ফর্দ দেখে আমি আগেই জেনে গেছি
. সেখানে থাকবে না কোনো নীলান্তের ছাপ।
আমি রঙের গহীনে আমার সবটুকু প্রেম
সমর্পণ করেছি আরও আগে।
‘বিজলী’, ‘বিজলী’ বলে পুরোরাত গেয়েছি
. আলোর বন্দনা। লোডশেডিং হবে না জেনেও,
তর্পণ করেছি বিগত অন্ধকারের স্মৃতি।
এই হাওয়াকক্ষে নীলসুবাস ছড়াবে বলে
যে পাখি দীর্ঘপথ উড়েছিল—
. তাকে বলে দিয়েছি, গভীর আকাশে
. নীল বলে প্রকৃত কোনও রঙ নেই।
আরও পড়ুন: বুদ্ধদেব বসুর কবিতা: আজন্ম যন্ত্রণার আকর ॥ কাজী মহম্মদ আশরাফ