মা: ধ্যানপর্ব ০১
স্রোতের প্রতিকূলে কলার ভেলায় একটি লাশ ভেসে এলো। লাশটি দেখতে বাতাসের মাতো নগ্ন, আগুনের মতো অন্ধকার আর রঙের মতো অসীম; তবু সসীম তার দেহের ভাঁজ।
এক এক করে গ্রামের সকলে লাশটি দেখতে এলো—লাশটি দেখে প্রথমে আমার মা বললো: এ তো আমার লাশ। আমিও চাঁদ চোখে তাকিয়ে দেখি—সত্যিই আমার মায়ের লাশ, আমার বাবা এসেও দাবি করলো—এ তার প্রিয়তমার লাশ। এই অবাক কাণ্ড গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। অবশেষে আমার মা তার নিজের লাশটি, স্রোতের প্রতিকূলে আবার ভাসিয়ে দিলো। এভাবে পৃথিবীতে শুরু হলো ভাসানযাত্রা। সেই লাশ ভাসানোর পর থেকে আমার জীবিত মাকে আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। আমরা চোখের জলে নদীর কূলে কূলে খুঁজেছি, এখনো খুঁজে যাচ্ছি…
কিছুদিন পর আবার একটি লাশ ভেসে এলো, এবার লাশটি দেখতে কেউ এলো না। যদিও লাশটি ছিল আমাদের গ্রামের অন্য আরো এক জীবিত মায়ের,তারাও এলো না। শুধু আমার সাথে লাশটি দেখতে এলো পাঁচ বছরের শিশু নবীন চন্দ্র। নবীন আমার কাকাতো ভাই, যে জন্মের সময়ই তার মাকে হারিয়েছে। আমি নবীনকে দেখেছি-সে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি নদীর ঘাটে বসে থাকে, এই ভেবে যদি তার মায়ের লাশটি ভেসে আসে। অথচ কোনো দিন নবীনের মায়ের লাশটি ভেসে এলো না।
এখনো নবীন বসে থাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে সকাল। এমনি করে নবীনের চোখের সামনে স্রোতস্বিনী নদীটি একদিন লাশ হয়ে গেল।
মা: ধ্যানপর্ব ০২
জন্মসূত্রে মানব শিশুর কালোচুল কোনো একদিন সাদা হবে
অথচ জন্মসূত্রে সাদাচুল কোনো দিন কালো হবে না।
এই বাক্য দু’টি কবিতায় লেখে—আমার মা ঘুমিয়ে পড়ল
তারপর ঘুম থেকে জেগে দ্যাখে
তার সমস্ত সাদাচুল কালো হয়ে গেছে।
আর তার শরীরের শিরায় শিরায় যৌবনের ঢেউ খেলছে।
তার এই অমায়িক পরিবর্তন—আমাকে দেখাতে এসে দ্যাখে
আমি তার পিতার মতো বৃদ্ধ হয়ে—মৃত্যুর সাথে লড়ছি।
আসলে—জন্মের সাথে মৃত্যুর এই খেলা
সাদা কালো রঙ ছাড়া আর কিছুই নয়।
গোধূলি
শূন্যঘরে একটি সাপ ও একটি বেজি পাশাপাশি বসবাস করে
তাদের মাঝে বিভেদের হাই তুলে—দাঁড়িয়ে কাচের দেয়াল।
সাপটি যখন আগুনের ফণা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে—
তখন বেজিটি রণকৌশল বদলে হিংস্র হয়ে ওঠে।
তাদের এই দ্বন্দ্ব-কাচের দেয়ালে প্রতিদিন প্রতিভাত হয়।
মানুষের ক্ষুধার মাঠ ফসলের জলে ডুবে গেলে—
সাপ ও বেজিদ্বয় সেই জলে তাদের দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখে।
রাতের শেষে চাঁদ ডুবে গেলে কখনো তারা দ্বন্দ্ব ভুলে
জীবন থেকে জীবাশ্মের গান গায় আর নিরবে কাঁদে।
কাচের দেয়ালের মাঝে আলো আর অন্ধকার খেলা করে
অন্ধকারের সাথে আলোর মিলন ঘটলেই—
অন্ধকার কেঁদে কেঁদে আলোকিত হয়ে যায়।
এভাবে আলোর সাথে অন্ধকারের যে দ্বন্দ্ব—
সেই দ্বন্দ্ব সাপ ও বেজির রক্তে কথা কয়।
তাই সাপের রক্ত যতটা শীতল, বেজির রক্ত ততটাই উত্তপ্ত।
এভাবে তুমি আর আমি সাপ ও বেজি হয়ে খেলা করি—
পৃথিবীর আলোকিত অন্ধকারে—বিভেদের দেয়াল জুড়ে।
নোমান্স ল্যান্ড
চৌধুরী বাড়ির ছায়া আমাদের বাড়ি বেড়াতে আসে
আমাদের বাড়ির ছায়া কখনো চৌধুরী বাড়ির দিকে তাকায়ও না
কেননা আমাদের ছোট্ট জন্মান্ধবাড়িটি-অন্ধকারের জাতভাই।
চৌধুরী বাড়ির কুকুর আমাদের বাড়ি আসে
আমাদের বাড়ির কুত্তা চৌধুরী বাড়ি যায়।
এভাবে চৌধুরী বাড়ির অনেক কিছু আমাদের বাড়ি আসে
অথচ-চৌধুরী বাড়ির মেয়েটি আমাদের বাড়ি আসতে পারে না,
আমার মতো ছোটলোকও যেতে পারে না চৌধুরী বাড়ির দুয়ারে।
হায়! সময়ের অন্ধ জাঁতাকল—
আমি কেন মানুষ না হয়ে কুত্তা হলাম না?
বৈশাখী চোখ
তোমাকে মনে করার মতো
আর কোনো মন অবশিষ্ট নেই
এ যেন তুমি বাংলা স্বরবর্ণের লি-ই কার
কোনো ধ্বনি বা শব্দে যার ব্যবহার শূন্য থেকে শূন্যতম
কিংবা বৈশাখী আঁধারে হেঁটে চলা তোমার পায়ের ছাপ
ডিম থেকে বাচ্চা পেতে হলে বুকের উত্তাপ প্রয়োজন
অথচ তুমি বরফ ভালোবেসে ঘুমিয়ে রাখলে শিশুপৃথিবী
আর আমার মনের মাঝে ঢুকিয়ে দিলে খনি গর্ভের অন্ধকার
ভগ্নাংশে আমি ইঁদুর দাঁতে খনন করে চলেছি তোমার মনোখনি
তবুও তোমার মুগ্ধতায় মুখ ধুয়ে দেখেছি
শ্যাওলার সবুজ গন্ধে ভরে গ্যাছে আমার ঋগ্বেদের ছোট্ট দিঘি
অবশেষে ডান হাতের বুড়ো আঙুল হারিয়ে ভেবেছি
একটি অঙুলের মৃত্যু মানে—একটি হাতের মৃত্যু নয়