মাধবী
মাধবীকে দেখেছি সেই কবে,
ভোরের মৃদু বাতাসে, মৃত্তিকার হালকা দুলুনি
সবুজের রেইনকোট পরা সেই বিস্তৃত মাঠে
পাতার ফাঁকে আবছা তোমার ঝরাকেশ
ঝরাকেশের গাঢ় অন্ধকারে নক্ষত্রগুলো নিভে গিয়েছিল
সেদিন বন্দনারাত্রীর ত্রিপ্রহরে
মন্দিরে ঘণ্টা বাজার ঠিক আগে
মাধবীকে দেখেছি সেই কবে।
মাধবীকে দেখেছি সেই কবে,
অগ্রাহনের রুপালি আলোয়
কার্তিকের ভরা জোৎস্নায়
নবান্নের রাতে কৃষকের মহার্ঘ্য বাউলমেলায়,
নাগোরদোলায়, খৈ ছড়ানো মাঠে
শিউলি আর মল্লিকার ঘ্রাণে ভেজা রাতে
ঈশ্বরের এক কোটি চোখের ভিড়ে
মাধবীকে দেখেছি সেই কবে।
মাধবীকে দেখেছি সেই কবে,
পৌষের রোদমাখা শিশিরের ভোরে
কুয়াশার জলমাখা দুর্বাঘাসের মাঠে
গধূলিমাখা শান্ত জলের খেয়াঘাটে
লাল পদ্মের বিলে, পরিযায়ী পাখিদের দলে
যমুনার ঘোলা জলে
মাধবীর মুখ—রেশমি চুড়ি—কানের দুল—নাকফুল
কালো চোখ—কালো কাজল—কালো টিপ
কালো চিকন হাত, কালো মেয়ে,
বোয়ালমারীর চরে; মাধবীকে দেখেছি সেই কবে!
গন্তব্য ছেড়ে বহুদূর
হাঁটতে হাঁটতে আরও পথ বাকি—
ফের বৃষ্টি এলো আইলে—বাতরে ধানক্ষেতে
শিশির জমা দুর্বা ভাদাইল ঘাসে
হাওরে বাওড়ে, নদী নালা বিলে
পুরোনো শৈশবে, হারানো কৈশোরে;
এলো বৃষ্টি—রূপসী যমুনার কালো জলে
দুইধারে খেসারি ক্ষেত মাঝখানে উটের পিঠের মতো
আঁকাবাকা রাস্তা, একলা কাকভেজা;
হাঁটছি আমি, অতিদূরে গন্তব্য, আরও পথ বাকি
কাঁচা ফসলের তরুণ প্রাণ আর ইঁদুরের গুঁড়ামাটির ঘ্রাণ
চরের নরম নিস্তেজ বালুতে একপশলা বৃষ্টি পেয়ে
মেঘমালার গানে তাল মিলিয়ে ঝিঝিপোকার দল
একস্বরে একশো একটি ছন্দ গাইছে।
এই দিগন্তবিস্তৃত সবুজের সমারহ ভেদে
চরাক্ষেতের ঘোনা ডিঙিয়ে গাঁয়ে ঢুকলাম।
দু’ধারে সারি সারি টিন আর ছনের ঘর
মাঝখানে চওড়া সোজা রাস্তা গিয়ে মিলেছে ভূতের বিলে
ভেজা গোবর আর পঁচা খরের গন্ধ
মাঝে মাঝে অদূরে গরুর ডাক
নিস্তব্ধতার এক সুগভীর তন্দ্রায় যেন আচ্ছন্ন সবাই
গ্রিস পৌরাণিকে আঁকা নৃত্যের দেবীর নুপূরের ছন্দে
টিনের চালে বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা যে সুধা গায়
আমি আবার জেগে উঠি হোমার হয়ে, এই চরে;
গভীর ঘুমে নিস্তব্ধ এই বৃষ্টিসিক্ত গোধূলি যেন
হিমশীতল পৌশের রাত্রির সুরা হয়ে ঝরে
হাঁটতে হাঁটতে ভূতের বিলের ধারে—
একফালি মসৃণ কোমল বাকা চাঁদের মতো এই বিল
একপাশে কিছু ধান, ডাহুকের মতো গলা উঁচু করে;
দাঁড়িয়ে আছে কলমির ঝোপ,
কাঁচা কাঁচা বোরো ধান
গলাপানি ভেঙে নতুন পথ, পুনর্বার যাত্রা
গাঢ অন্ধকার ঢেলে মেঘমালা আর গাইলো না
হিজলবনের সারি, সরু কাঁচামাটির রাস্তায়
বৃষ্টি থেমে গেছে একমুঠো রূপালি চাঁদের আলো মেখে
বকের ঝাপটানো ডানার গন্ধ লেগে আছে ডালে-পাতায়
বিস্তর এই পথ আর দিগন্তজুড়ে ঈশ্বরের মহাকারুকার্য—
নক্ষত্রগুলো খসে ছড়িয়ে পড়েছে পতিত প্রান্তরের শেষে
বাতাসে মেশা ঘুগরার ডাক, জোনাকির ঘ্রাণ
এমন আশ্চর্য এই রাতে:
দিগন্ত-প্লাবিত বিস্তর তরুণ প্রাণের উচ্ছাসে
পৃথিবীর এই পথে শিশিরের শরীর ছুঁয়ে
হেঁটে যাই অনন্ত অন্তিম প্রভাতের দিকে
কুয়াশার মাঠে সোনালি চিল ডানা ঝাপটে
পাতার আড়ালে ডালের আড়ালে
লাউয়ের ডগার পাতলা তিনখানি গোফের ফাঁকে
ঠাণ্ডা রৌদ্রের তিনফালি স্নিগ্ধ হাত এসে
নির্জন চরের ঘুম ভাঙায়ে দেয়
দুর্বাশিশিরে ফোটা নিটোল আলোয় তন্দ্রাভঙ্গ হয়;
স্পষ্টই মনে হলো, গন্তব্য ছেড়ে এসেছি বহুদূর!
আমিও খুব একা
সবকিছুই হারিয়েছে,
শুধু দীর্ঘ নিস্তব্ধ কিছু রাত বাদে।
সবুজ বনের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে
একটি পথ হয়েছিল বন্ধু
ঠিকানাবিহীন কত চলা
রঙিন কত গল্প বলা
অবশেষে জেনেছি সেই পথও নাকি একা।
তারপর নির্জন কোন দ্বীপে
একটি পাখির সাথে হয়েছিল সখ্য
মিষ্টি সুরে সুরে গান গাইতে গাইতে
কবে যে হৃদয়ে বিষের দাগ লেগেছে,
শেষে আর গান গাওয়াই হলো না
পাখিটা আমাকে অভিশাপ দিলো
এতই বিষের যন্ত্রণা,
সে-ও পরে একা হয়ে গেলো।
এরপর…নিষিদ্ধ নগরীর অলিগলি ঘুরে
জনারণ্যে ভরা কোনো শহরের ধারে
ইচ্ছে হলে বুড়িগঙ্গার তীরে
অনির্মল খসখসে আকাশটাকে ঘিরে
একরাশ ঘৃণার বোঝা মাথা থেকে ঝেড়ে
ট্রলারে বসে সিগারেট টানি।
আর দীর্ঘ নিঃশ্বাসের খাচা ভাঙে
আত্মবিক্রিত বেহায়া ক্রন্দনে
স্বঘোষিত বেকার মন বলে,
স্বরচিত নির্জনতায় আমিও খুব একা!
আরও পড়ুন: নির্বাচিত নবীনের কবিতা