আমি কবিতার দাস হয়ে থাকি
কবিতা কখন—কিভাবে লিখিত হয়, তা ঠিক করে বলা মুশকিল। কখনো আনন্দ-বেদনা লিখি। কখনো ভাবনার চরকিতে ঘুরে ঘুরে খেই হারিয়ে মিশে যাই গভীর কোনো গ্রামের কুয়াশায়। আবার সময়ের ছাকনিতে উঠে আসে—প্রেম, বিরহ, দেশ, বঞ্চনা বা সুখ। বিষয়ের নানান জট ও জটলা পেরিয়ে একটা কবিতা লিখিত হবে। হৃদ-উঠোনে মিলেমিশে একাকার হবার ছটপটানির সিম্ফনি কখন একটা ভাষার আধার অধীনে নেবে আর সেইসব অলিখিত-অমিলিত শব্দব্যঞ্জনের মিলন হবে অধিগত স্বরগ্রামে। সেই আনন্দ-বেদনার মুহূর্তের অপেক্ষায় সময় গিয়ে মেশে নদীর মোহনায়। মনে হয়, অধরা হে—কেন তুমি দূরে দূরে থাকো?
আমি বরাবরই ভ্রমণপিপাসু। পর্যবেক্ষণবাদী। অনুভবে নিয়ে রাখি ছড়ানো-ছিটানো নানা দৃশ্য। পাহাড় দেখে যখন স্বদেশ দেখেছি—অন্যরকম অনুভব হয়েছে। মাধবকুণ্ডের পাহাড় থেকে দূর কুয়াশা ভেদ করে আবছা সবুজ, আমাকে আলোড়িত করে। সেই মনোরম ছায়াদৃশ্য আমার চোখে গেথে যায়। অনুভব করি অবারিত সবুজ শামিয়ানার। চোখ বন্ধ করে দেখি চার দিক ও দিগন্ত। প্রেমিকার কুসুমিত প্রেম যেন মনের ভেতর ছুঁয়ে যায়। রক্তের মধ্যে যেন অন্য এক প্রেরণা কাজ করে।
কবিতার ব্যাখ্যা দেওয়ার চাইতে মনে হয় পাঠ করাই শ্রেয়। কোনো ঘুরন্ত শানপাথরে ছুরি ধার দেওয়ার সময় যেমন আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে যায়, কবিতা তেমনই এক শিল্প। তাকে ব্যাখ্যার চেয়ে ভালো হয় অনুভবে রাখা। সে নিজেই নিজেকে মেলে ধরুক আপন স্বরূপে, সৌন্দর্যে, কামনায়। সুপ্ত এক লীলার কারবারে বরং আমি তার দাস হয়ে থাকি।
কৃষ্ণ বুকের চাতালে
কুয়াশার শাড়ি পরে বসে আছে দূরের সবুজ
কে এসে খুলে নেবে ঘোমটার ভাঁজ
ভেতরে অঢেল জোনাকি স্রোতের ইশকুল
নামতার মতো ফোটে মহুয়ার ফুল।
হাতের রেখার মতো জেগে আছে ঘাসপত্র
আর রেখাচিত্র আঁকা দেখো পাথরের গুহায়
প্রযত্নে সবুজ রেখে বিলি করো পাতাঝরা দিন
কৃষ্ণ বুকের চাতালে জমছে প্রণয়ের বীজ…
কে তাকে পরাবে নিষেধের বেড়ি?
শেকলে বাঁধবে তার প্রাণের তাবিজ!
রোজ এসে ফিরে যায় পাখিডাকা বিকেলের রোদ
মরাবৃক্ষে লেগে থাকে সবুজের ওম—
দোয়েলের ঠোঁটে ভাসে অবিনাশী শিস
তাক করে আছে কোন শিকারির তীর?
কুয়াশার শাড়ি পরে বসে আছে দূরের সবুজ
কপালে দিয়েছে এক ছোট লাল টিপ।
গ্রহণ
কত ডাক আসে ঘরে কত ডাক ফিরে যায়
চাঁদকে উল্টো করে হাতে ধরি রুপালি কয়েন
আমার ভেজার বাসনা আকাশের গায়ে যখন
লাগে দেখি মেঘের গ্রহণ—
খুব বেশি কচুপাতায় স্বপ্ন দেখি না।
যখন উঠেছে ফুটে দাদিমার নকশিকাঁথায়
এক নার্সের চোখের মতো বেড়ালের চোখ
কুয়াশার জ্যাকেটে মোড়া দাদার কবর;
তখন জেনেছি আমি—
কত ডাক আসে ঘরে কত ডাক ফিরে যায়
আকাশের গায়ে কেন লাগে না গ্রহণ!
পারিবারিক
আমার মামার খুব ঘোড়া পোষার শখ ছিল
তাই ঘোড়া দেখলেই এগিয়ে যেতেন…
আর নানার ছিল মাছের—
এক বিরাট চিতলের কানে পরিয়ে ছিলেন দুল।
আর নানি আমার চুলে বিলি কেটে শোনাতেন—
পেঁপে গাছে বসা এক শাদা পরির গল্প।
আর খালারা ছিলেন পাঁচ বোন
এখন পাঁচ জায়গায় থাকেন।
একথা সত্য যে, আমার মা খুব ভালো রান্না করেন!
হাসপাতালে শাদা দিদি
ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়ায় শাদা দিদি
বেডে বেডে সৌরভ ছড়ায়—
লিখে দেয় বকুল ফুলের ঠিকানা।
আমিও নিকটে যাই—দিদির নিকটে
দেখি ঘাম জমে আছে শ্যামলা ঠোঁটে!
অসুখের কথা তাকে জানাই ইশারায়
হাসপাতালে দিদি দেখলেই—
অসুখ বেড়ে যায়…
নর্তন
আপনিই যদি মাথা হোন
আমি হবো পা
পা দিয়ে হেঁটে হেঁটে মাথার নিকটে যাবো—
মাথা খাবো
খুলি নিয়ে দরজায় ঝোলাবো।
মাথাহীন আপনি নাচবেন
পা দিয়ে আমিই নাচাবো।