মাছ ও কাজলাক্ষী
বসে আছি চর্যাপদের আলোয়, সম্মুখে আধো চেনা, আধো অচেনা দৃশ্য। মনে পড়ে মনে পড়ে-না এমন জায়গা। বৃষ্টি হয়েছে মূর্ছিত মাছের মতো। আকাশে মেঘ-মেদুর দৃশ্যের মাঝে বৃষ্টির করতালি। দূর আকাশে শৈশবের হারানো আধুলি ডাকে। আমি দেখি আমার পাশে তিলোত্তমা বৃষ্টির মতোই শাদা পোশাকে বসে আছে। চোখে তার রাহস্যিক ছায়া। আমি দেখি চারিদিকে স্থির জল। জলের ভেতর স্বচ্ছ শাদা মাছ। ছোট মাছ। ছোট মাছ বড় হচ্ছে… বড় মাছ ছোট হচ্ছে… । এমত মিথ্যাময় পরিবেশে বড় হতে হতে একটি মাছ অনেক বড় হয়ে যায়। কাজলাক্ষী তার শান্ত অনুভবের চোখ দিয়ে ঘণ ইশারা করে। আমি বুঝে ফেলি মাছটিকে ধরতে হবে। বুঝে ফেলি এই ঘূর্ণিতে নিজেকে জড়ানো মানে অসুস্থ হয়ে যাওয়া। বুঝে ফেলি সে-এক অদ্ভুত অসুখ।
মাছটা জলের ভেতর চক্কর খেতে থাকে আর বড় হতে হতে জল ভেদ করে উপরে উঠতে থাকে তার পিঠ। আমি দাঁড়িয়ে গেছি ততক্ষণে। মাছটাকে ধরতেই হবে এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে দাঁড়ানো আমি হঠাৎ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে চাই। না, মাছটাকে ধরব না। কারণ এই মাছ পানিপ্লাবী হয়ে বাতাসচারী হয়ে দৃষ্টির প্রখর ভঙ্গিকে অতিক্রম করে মাছ হয়ে উঠছে…
কাজলাক্ষী ক্ষুব্ধ-অভিমানে দাঁড়িয়ে যায়, অন্যরকম এক বন্য অথচ শান্ত চোখে তাকায় আমার দিকে। আশ্চর্য! সে-তো এমন নেশালু কিংবা পাহাড়ী গানের মতো চোখে তাকায় না কখনো! আমি বুঝি ফেলি ওই চোখের সান্ধ্য-ব্যকরণ। কালবিলম্ব না করে মাছটার দিকে তাকাতেই দেখা যায় শাদা জল ভেদ করে উচ্চে ওঠা তার পিঠের মিনার। অর্ধেক জল অর্ধেক বাতাসে দৃশ্যমান সেই মাছ খানিক দূরে চলে গেছে। এক দৌড়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়তেই মনে হলো—আমি কতদিন ঘুমাই না! ক্লান্ত হাত আমার মাছটির পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে ধরবে কি ধরবে-না এমন ভাবনায় মেতে থাকে। কিন্তু মাছটি শার্পটার্ন নিয়ে ঘুরে চলে যায় কাজলাক্ষীর দিকে। কাজলাক্ষীর চোখ তখন জানান দিচ্ছে কেন মানুষ ঠোঁটকে সুহাসিনী বলে!
আমি ফিরে তাকাই। দেখি মাছটির পিঠ উপরে উঠতে উঠতে ক্রমশই চিতাবাঘ হয়ে গেল। আর পেছনে তিলোত্তমা হয়ে হেল ভার্সাই নগরীর ঢেউ। বাঘটির কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে কমপক্ষে দৌড় দিতে হয়…
কিন্তু, কে জানে না—স্বপ্নে কখনো দৌড়ানো যায় না! আমিও জেনে গেলাম, ‘শস্য কাটা হয়ে গেলে পড়ে থাকে হাহাকার’…
জলেশ্বরী
আবার এসেছে ওই অচেনা বিকেল। বহুদিন আগে শৈবালের পিঠে দাঁড়িয়ে যা দেখেছিলাম আমি, আজ মুহূর্তের ঘোরে, রোদের কোমল তীরে বিকশিত হতে হতে, পুনরায়, দেখলাম আমি আকাশের এক ফাঁকে জলেশ্বরীর জল-গণিত
যেমন ধরো, ছাপচিত্রের কোলাহল পেরিয়ে হঠাৎ চলে গেলাম অরণ্যে, ফিরে এসে দেখি ছাপচিত্র আর ছাপচিত্রের জায়গায় নেই। সেখানে দেখা যাচ্ছে ছোট কাটরার বিশাল দরোজা। যেমন ধরো, ঘাসদানি থেকে নেমে আসছে আলো-অন্ধকার-আয়ু, বাতাসে তাহার তীব্র আলোড়ন। আমি চোখ থেকে যেই চশমা খুলেছি, দেখি চারিধারে রমণীর নাভীর মতো সুগভীর নির্জনতা। আমি যেন ভাগশেষ কিংবা কল্পিত ভগ্নাংশের মতো দাঁড়িয়ে আছি
প্রশ্ন হচ্ছে, এসবের মধ্যে বিকেল কোথায়! আছে। আমি যখন ছাপচিত্র থেকে অরণ্যে গেলাম, তখন সেই সুতীব্র আলোর ভেতরে সূর্য হেলে পড়েছিল তাহার দিকে। কেউ তা দেখেনি। আমি যখন ঘাসদানির সামনে দাঁড়িয়ে, তখন আলো আর আয়ুর মাঝখানে কেটে গেছে কয়েকশ মুহূর্ত
এই সব কলরব যখন চারিদিকে, তখন মুহূর্তের চোখে চোখ রেখে ভাবছিলাম শৈশবে দেখা সমুদ্রের হাহাকারের কথা। ভাবছিলাম তুমুল গর্জনের মতো এই আমাকে টেনে নিয়ে যাওয়া প্রাচীন পুকুরের কথা
আবারো শৈবালিনী! আবারো ছায়া ঘেরা প্রাচীন রোদ! আবারো স্বচ্ছ-অস্বচ্ছ ধারার মাঝে বকুল-সাধনা! তাহার ভেতরে আরেক আকাশের কথা! তাহার ভেতরে জেগে ওঠা জল-গণিতের কথা! তাহার ভেতরে আরেক সমীকরণের কথা!
পুকুর এবং আকাশ, কে নিকটে? এই প্রশ্ন রেখে যাই শৈবাল আর শৈবালের পিঠে দাঁড়ানো সংশয়ী জলেশ্বরীকে
শহর
আলোর স্কুল থেকে বের হতেই দেখা হয়ে গেল পথের সঙ্গে, তার সাথে রথের সহযোগী। যাত্রা থেমে গেছে যাবতীয় মাছ ও ধুলোর। কিংবা মুছে গেছে বৃষ্টির মিথ্যা শাদা রং । রথের চাকা বলে—বড় ক্লান্ত ক্লান্ত লাগে এ শহরে…
এ শহর মানে কলকাতা নগরীর শব্দ-দূষণ। রিকশার টুংটাং, বাতাসের ঝাপটা, রথের চাকায় পিষ্ট হওয়া ধুলো, মাছ আর বৃষ্টির শাদা রং। আরো দেখো আমার ফতুয়ার পকেট—কী অবলীলায় একাকার হয়ে যায় তারা!
একাকার হয়ে যাওয়া মানে সাত বীরশ্রেষ্ঠের মাঝে পড়ে থাকা পাথরের ভগ্নাংশ। সে-ও ধুলোর বন্ধু—ঝড়বন্ধু। তার সামনে কত আলোর খেলা! তার সামনে সাতমাথার সাত নিদ্রা, তার সামনে ম্যান্ডোলিনের ঘোড়ার হ্রেষা, তার সামনে সপ্তপদীর সপ্তর্ষী, তার সামনে এ শহরের সে-শহরের কিংবা পৃথিবীর যে-কোনো শহরের সূর্যাস্ত শাদা ফারুক সিদ্দিকী কিংবা আন্ওয়ার ভাইয়ের দীর্ঘশ্বাস…
দীর্ঘশ্বাস মানে কাজী নজরুল ইসলাম সড়ক। কিংবা সেই সড়কের সোডিয়াম বাল্ব। না, ওই দীর্ঘশ্বাস মানে এক নিরুদ্দেশ ঘোড়ার গাড়ি…
পথ
মোহন আত্মহনন বলে পৃথিবীতে যদি কিছু থাকে, কী বলা যেতে পারে তাকে? এই প্রশ্ন কতদিন কতবার বহুবার রক্তাক্ত করেছে আমাকে। ক্ষত বিক্ষত হতে হতে এও জেনেছি যে—এর অনেক অনেক উত্তর। মনে হয়েছে ওই মোহন আত্মহনন মানে পথে পথে হাঁটা। তাহার কোনো শেষ নেই। দুর্লঙ্ঘ্য অনির্দিষ্টতা তার সঙ্গী। হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছে এটা কোনো পথ নয়। পথের বিশ্বাস, ধারণা। মনে হয়েছে ওই মোহন আত্মহনন মানে নিজেকে পতঙ্গ বানিয়ে তোলা। আগুন যার পথের গ্রন্থি এঁকে দেয়। মনে হয়েছে ওই পথ এই পতঙ্গ ওই আগুন —এসবের বহুবিধ রসায়ন বিবিধ সত্যের বেদীতে দাঁড়িয়ে। এই সত্যও যেন আবার ঠিক ঠিক সত্য নয়। তবে কি মিথ্যা? না, তাও নয়। সত্য-সত্য মিথ্যা-মিথ্যার এই ভূগোলে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছে আসলে পথ বলে কিছু নেই।
আলো
ভোমরার সাতটি আলো। যেন ছাপচিত্রে ফুঠে থাকা অপূর্ব সময়। যেন ঘাস থেকে উঠে আসা সেই এক কমরেডের মৃত্যু সাধনা। ধরো, মেঘ আর কই মাছ দেখে দেখে সুবিলের বিলাপ। কে শোনে সুরেলা শব্দের জলজ ইশতেহার! শোনে বালিশের নিচ থেকে বের করে আনা বোতামটি যখন হয়ে যায় নীল ফুল, তখনকার অপাঠ্য শরীরী-আঁধার।
পাপ ধুয়ে যায় পাপের ছায়ায়। তাহার জানাজায় আসে টুপটাপ শালুক, পায়ে পায়ে দিঘির জল। কী সব মাড়িয়ে যাই, আড়াই অক্ষরের জুয়ায়!
আহা পতন, তোমার শিকড় সংক্রান্ত জটিলতায় খসে পড়ে ধর্মানুভূতির উপকথা…
অর্থহীনতা
অর্থহীনতার অর্থ কী? এই প্রশ্নটি করতেই এক অচেনা পথিক বলল, অর্থহীনতার অর্থ হলো শূন্যের বাস্তবতা। শূন্যের বাস্তবতা কী—এই প্রশ্নটি তাকে করা যেত, অবধারিতভাবেই। কেননা প্রশ্নের পিঠে যিনি উঠে এসেছেন তিনি স্বয়ং পিগম্যালিয়ানের ছায়া।
ছায়া শব্দটি এলেই কেন জানি আমার ভাস্কর দা’র কথা মনে পড়ে! ভাস্কর দা মানে ভাস্কর চক্রবর্তী, কবি। যার চোখের ভেতরে আমি সুপর্নাকে দেখেছিলাম। আচ্ছা, ভাস্কর দা কি সত্যি সত্যি ব্যাং হয়ে গিয়েছিল!
সে-কথাও না হয় থাক। মিশে যাক সকল জংলি ফুল। কিন্তু জেগে ওঠা পাতাল থেকে কীভাবে দূর করা যাবে চাঁদের আবছা আলো!
আজ ভাবছি এসব, আর অর্থহীনতা থেকে মুছে যাচ্ছে সকল অর্থময় ছায়া…
পাপ
আমি কোনো পাপ করার চেষ্টা করিনি। তবু কারও শ্বাসকষ্ট যদি হঠাৎ বেড়ে যায় তখন কোন প্রজাপতি এর জন্য দায়ী হবে? বলো? অথচ পতনের সকল ব্যাখ্যা যেন আমারই কাছে। অনুভূতির উপকথা যারা ফেরি করে বেড়ালো—একই অভিযোগে—দেখ আমি দিন-বিদ্ধ ঘড়ি হয়ে গেছি।
কে নেভাবে বলো সাধের বীজতলা! কেউ নেভাবে না, ভাসাবে না কভু কচুরিপানার ফাঁকিবাজি। তবুও কুরচি, জুয়ার আঙুলের রেখা ধরে, নিঃশ্বাসের কুশল বেয়ে উঠে আসেন গাছ
বৃক্ষ তবু হেঁটে যায়, বাস্তবতায়, চেয়ারের পায়ে পায়ে
ঈশ্বর
আজ শুরুটাই হয়ে গেল সন্ধ্যাসবের মতো ঘোরগ্রস্থ। কতদিন একরম হয়নি! আজ হলো। বুঝতে পারলাম জীবন থেকে যেমন নিঃশ্বাস পালাতে পারে না তেমনি রোদ থেকে চুল থেকে কখনো নিভে যায় না মাইগ্রেনের আলো
আমি অসুস্থ হয়ে যাই, আর ধূলি থেকে খসে পড়ে ঝড়। আমি অসুস্থ হয়ে যাই আর বাষ্প থেকে উড়ে যায় দিঘির জল। ছুটির দিনে আমার মায়ের মাড়িয়ে যাওয়া তৃণে কোনো ছায়া নেই।
উড়ে যাচ্ছি উড্ডয়নে, উড়ে যাচ্ছি সমন্বয়ে, উড়ে যাচ্ছি মন্থনে, উড়ে যাচ্ছি মিথ্যায়
উড়ে যাচ্ছি সংশয়ীদের শয্যায়
হাতপাখা অথবা ঘড়ি
ছুটির দিনে মোমের উচ্ছ্বাস
আঁধার ঘরে তোমার আলো
মোমের মতো হাত দুলছে। হাতের মধ্যে হাতপাখা। দুলছে। ছন্দে। নাকের ডগায় হয়তোবা ঘামের চিকচিক চিহ্ন, সামান্য। অদূরে মোম। মোমের মাথায় আগুন। হাতপাখার বাতাসে সন্ত্রস্ত আলোয় ঘরময় নির্মিত হচ্ছে অন্যরকম ঘরের ভিন্নরকম ঘোর। সন্ত্রস্ত আলোর সঙ্গে উড়ছে কাহার চুল! কতদিন আউলা বাতাসেও এরকম চুল ওড়েনি আমার! আজ উড়ল। আর পুড়ল সকল রোমকূপ। এই সেই কূপ যেখানে কেউ হত্যা করতে পারে না নিজেকে
আমিও পারিনি
কারণ সঙ্গে ছিল বন্ধ হয়ে যাওয়া বিগত শতাব্দীর
এক মরণশীল ঘড়ি
মৃত্যু
সম্মুখে মুত্যৃ নিয়েও ঘুমিয়েছি আমি। অথচ আজেকে এক সন্ত্রন্ত নীল প্রেম বিযুক্ত করে ফেলল সেই নিঃশর্ত প্রেমের দেশ থেকে। আমি বসেছিলাম অন্ধকারে, মধ্যরাতে, বৃষ্টির ঝাপটায়
ঘুম চলে গেছে নির্ঘুম ওই জগতে। তবে কি—প্রশ্ন জাগছে মনে—আমারই মৃত্যু হয়েছে!!! ঘাসের ভেতরে ফুটে থাকা অবাধ্য ফুলের মতো আমিও কি পাঠ্য হয়ে গেছি! না-কি হঠাৎ পাঁজর হারানো অনন্ত নিঃশ্বাসের মতো হয়ে গেছি আন্তঃনগর ট্রেন!
কি জানি, নিজের মৃত্যুকে সামনে নিয়ে তো আর ঘুমানো যায় না…
কবি পরিচিতি:
এমরান কবির
কী সুন্দর মিথ্যাগুলো (কাব্য, ২০১১),
নিদ্রাগহণ মহাশূন্যে (গল্প, ২০১২),
পালকভরা সূর্যাস্ত (কাব্য ২০১৩),
আমি লিখেছি এইসব, আমি লিখি নাই (গদ্য, ২০১৪),
নীল বোতাম (উপন্যাস, ২০১৬)