কলকাতা
শ্যামাচরণ স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হলুদ শেমিজকে দেখলাম,
আহা ট্রামের পাশে যেন একখানা শর্ষে ক্ষেত।
আমি চোখ বন্ধ করতেই কানে এসে বাড়ি দিল সেই আলো-ফুলের মাদক গন্ধ;
একটা ইন্দ্রিয় অচল থাকলে অপর ইন্দ্রিয়গুলো না’কি বেশি কার্যকর হয়।
আমি সর্ষে ফুলের পিছু পিছু হাঁটা শুরু করলাম।
আমার মাথার ওপর তখন সূর্য স্থির,
প্রচণ্ড তাপেও সমস্ত শরীরে যেন মাঘের থাবা,
আমি কাঁপতে কাঁপতে ঘামে ভেজা শেমিজের
নিচে ঢুকে পড়লাম একখণ্ড উষ্ণতার জন্য।
আহা হলুদ শেমিজ পুরুষ-ছোঁয়ায় গলে গলে কেমন একথালা আইসক্রিম হয়ে গেলো।
হলুদের ভেতর চোখ ডোবানোর জন্য ছুটে এলে
একঝাঁক হুলো-মৌমাছি, আমি মনের দরজা বন্ধ করে হঠাৎ বাতাস হয়ে উঠলাম।
পৃথিবীর সকল বাতাসে ঘুড়ি ওড়ে, মেঘ-গুড়গুড় আওয়াজ বৃষ্টি নামায়।
শেমিজের দেহ নিয়ে আমার সামনে দিয়ে
উড়ে যাওয়া হলুদ দুপুর আমাকে শোনালো
মাছির অর্কেস্ট্রা আর আমি যেন বৃশ্চিক বাঁশি ;
কেবলই ডাকের পালা, বিষন্ন যোনীতে আঁকা কলকাতা-কলকাতা।
যা দেখি
যা দেখি, তার কতটুকু দেখা হয়?
বটের দীর্ঘ দেহ যতটুকু ছায়া ধরে ততটুকু আমার;
বাকিটা পৃথিবী তোমার থাক। তুমি সূর্যঘড়ি হয়ে
দুলতে থাকো সুমেরু থেকে কুমেরুর রেখা ধরে
যতবার পারো ততবার; যেন আলোর লাটিম
ঘুরছে তো ঘুরছেই যাযাবর বালিহাঁস।
যা দেখি, তা সবটুকু নয়।
এত দেখা তবু আটাশ বছরেও কেমন আড়াল ডানবুকের নিচে
তোমার সেই লালমুখো তিল দুটো।
যা দেখি, তা পূর্ণতার অপূর্ণ চিত্র শুধু
বাকিটুকু ঈশ্বরের চশমায়…
কাশফুল এবং হারানোর গল্প
আমার হারানোর গল্পটা দীর্ঘ অনেক। হলুদ পৃথিবী জানে কী এক আবেগ রোগে আক্রান্ত আমি এবং কিছুটা বোকাসোকাও বটে। আর তাই প্রত্যাশার ঢালে শুধু ভুল বীজ বুনি। ভুলের বাগানে বোনা সব বীজে কি বৃক্ষ গজায়, সব ফোটা ফুলের ঘ্রাণে উড়ে আসে চেনা মৌমাছি?
কতদিন ইথারে ভাসে না ‘শানু’ ডাক। আব্বার ডায়েরিটা ধুলোজমা। মায়ের কবরের ঘাস প্রিয়জনেরা বাড়তে দেয় না কিছুতেই, ছেঁটে ফেলে ক’দিন পরপর। তবু কিছু ঘাস লুকিয়ে লুকিয়ে ছায়া ফেলে আমার ঝুল বারান্দায়, যেখানে কবিতার বুক ছুঁয়ে একটি চড়ুই দুপুরের গায়ে মাখে রোদের মালিশ।
কতকাল বদ্ধ জানালা। ধুলোর সাথে মেশা লিপটন ঘ্রাণ তবু ফুটো করে কাঠের শরীর নাকে এসে বিঁধে।
আমার চতুর্দিকে ঘুরপাক খেতে খেতে অবশেষে মক্তবের সেই চুলখোলা আয়েশা আকতার এখন পূর্ণ যুবতী । আহা মাহমুদ, তোমার বেহেশত হাসিতে স্বর্গমুখী বখতিয়ারের ঘোড়া আর ফজলের সূর্যাস্তেরা কেমন বেসামাল আততায়ী ঢঙে, শুধুই মমতা ঢালে নীলচোখ রমণীর প্রসন্ন আঁচলে।
আমি আর গাঁথতে চাই না শোক জীর্ণ কাঁথায়। দীর্ঘ নদীতে আর চাই না ভাসাতে দুঃখ ইলিশ।
হে শরৎ, তুমি কাশফুল হয়ে ভাসো নীলুয়া-অতলে।