পুড়ে যায় পুষ্পাঞ্জলি
প্রমত্ত নদীও শুকায়—জীবনের গান থামে
একদিন কূল ভেঙে ভেঙে খেয়েছে যে
প্রেমের শরীর—আর্তনাদ ভালোবেসে।
অবাধ্য যৌবন সেও তো হারায়
লোভের আগুনে পুড়েছে নগর সহস্র বছর
এখনো পুড়ছে—পুড়ে যায় পুষ্পাঞ্জলি।
মোহও তো ডোবে—পেয়ে গেলে সব,
সবই তো পড়ে থাকে—থাকে না কিছুই;
কেন তবে স্বার্থের খেলায় তরুপের তাস!
বুকে হাত দিয়ে দেখো—নিজেকে চিনতে
পারো কিনা—জীবন বড়াই বড়ই ঠুনকো
ভালোবাসাটুকু থাকে—আর থাকে না কিছুই।
কবিতা কি যূথিকা যৌবনা নদী
কবিতা এতোটা নিদ্রাহীন—কে কবে বুঝেছে
শিশিরের মতো সারারাত কি অদ্ভুত নীরবে
উপমা রূপক কুচি দিয়ে শাড়ি পরা সুদর্শনা
রমণীর মতো কবিতা কি যূথিকা যৌবনা নদী!
প্রতিটি কবিতা ভূমিষ্ঠমাত্রই ব্যাকুল তৃষ্ণায়
পৃথিবীকে দেখে—তাকে তুলে নেয় বুকে
আঁতুড় ঘরে—হৃদয়ের বসতিতে গহীন সুন্দরে
কবিতা জন্মায় আবেগ ও চেতনার অগ্নিকাচুম্বনে।
আমার কবিতা হাওর-বাঁওড়ের লাল শাপলা
তুমি তাকে গেঁথে নিও ভোরের স্নানের পরে
ভেজা চুলে—কাঁচামাটি পথে ছড়িয়ে পড়ুক;
রৌদ্রের সুঘ্রাণ ঢেউবতী অন্তরলাবণ্যে নিদ্রাহীন।
করোনাকঙ্কাল
জীবন এখন অদ্ভুত বিবর্ণ দিগন্তের বিকেলের গানে
মরণ নিঃশ্বাসে কাতরায় পৃথিবীর অলিগলি রাজপথ;
তপস্যা তিমিরে গহন আকুতি ঈশ্বরপ্রার্থনা
নিরুপায় ভাঙা পুতুল—করোনা আক্রান্ত পৃথিবী।
রাতের শরীরে যৌবনা গন্ধ—হাসনাহেনা মৌতাত
মাতাতে পারে না—পূজো আর অগ্নিকাহৃদয়;
ভুল হিসেবে কতো নদী ও সমুদ্র
মরু হয়ে মরে গেছে—
মরুভূমির থেকেও বেশি প্রাণহীন লাবণ্যপূজারি পৃথিবী।
মৃত্তিকা শরীর সহস্র দিবসে পোড়ে—যদি আবার আষাঢ়
আসে অভিমান ভাঙা কৃষ্ণের ব্যাকুল বাঁশরি কানবায়;
হিসেবি জীবন ছিঁড়ে
অবাধ্য রৌদ্রের গাঢ় চুম্বনে জীবনপঙ্ক্তির মুগ্ধ কবিতা
বিশ্ব মানচিত্রে আবার উচ্চারিত হবে অপার্থিব সুন্দরে।
সতেজ পাপড়ি মনকাড়া মাতাল গন্ধে যমুনা যৌবন
মৃত্তিকা শরীরে পূর্ণিমার আলো—
অন্ধকার ভেঙে নতুন আলোয় উপচে পড়বে প্রমত্ত ঢেউয়ে
মানবতার একই সুর একই সংগীত হবে পৃথিবীর মঞ্চে।
সবুজ জমিনে জীবনের গানে মৃত্যু যতই আসুক
হারবে মৃত্যুই—সবুজ পাতার বুকে নতুন আলোয়
ফিরবে নতুন দিন—রঙধনু স্বপ্নরঙিন জীবন ফিরবে আবার;
সময়ের রশিতে থাকবে বাঁধা ইতিহাসে করোনাকঙ্কাল।
কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে না
কখনো কখনো কবিতা লিখতে একদমই ইচ্ছে করে না
মিথ্যাবেসাতির ভেতর প্রতিদিন যে জীবন রহস্যধোঁয়া
স্রোতের কুণ্ডলী চতুর্দিকে ছোটে প্রবলভাবে নষ্টরঙিন
অদ্ভুত বাসনা হাজার বছর বাঁচার—কালসাপ দংশন।
কবিতা লিখতে একদমই ইচ্ছে করে না যাদের জেনেছি
আলোকিত মানুষের পবিত্র সনদ—সবই তো তিমির
আপনস্বার্থে উন্মাদ—হার মানে হিংস্র শকুন হায়েনা
কল্যাণ লেবাসে বেচে নাম অদ্ভুত প্রণাম সালাম তাদের।
মনের চিতায় রাতজাগা শরীর পুড়িয়ে সনড়ব্যাসসাধন
এ সবের কী মূল্য আছে কবিতার শিরোনামে
কবিতার শব্দ যদি না হয় সুন্দরের প্রার্থিতবৃষ্টি;
একালে এ সত্য কবিতার বুকে বিষলক্ষ্মা তীর।
কখনো কখনো কবিতা লিখতে একদমই ইচ্ছে করে না
কবিতা এখন নষ্টের কাছে নতজানু
অন্যায়ের উদ্যত বুকে সেই সাহসী রোদ্দুর ভয়ার্ত ছোবল
কবিতার ফণা বিষহীন ঢোঁড়াসাপ এখন—সরীসৃপ জন্ম।
আমি তেমন কেউ নই
আমি তো বলেছি—আমি তেমন কেউ নই—
আমার জন্য তোমাদের অনেক দুঃখ থাকবে
ভালোবাসা থাকবে—অপেক্ষা থাকবে—বুনোফুলের ঘ্রাণ থাকবে
বুকের ভেতর বিদীর্ণ ব্যথা থাকবে—এসব থাকতে নেই।
আমি কারো মাথায় কখনো রাখিনি নির্ভরতার হাত
কাউকে কখনো বুকে করে হাঁটিনি স্বপ্নসৌধ ধরবো বলে;
রাত নিভে গেলেও পারিনি দিতে
ক্ষুধার আগুনপোড়া মুখে
শাকসবজিমাখা সাধাসিধে আউশ ধানের একমুঠো ভাত।
আমি তো প্রাডো গাড়িতে এ নগরে আসিনি—
চাকচিক্যময় পোশাক পরেও আসিনি—
অপেক্ষায় ছিল না কোন প্রাসাদ;
ছেঁড়া জুতো প্যান্ট পরে এসেছি শূন্য চোখে ফোসকা পায়ে
একটা মানুষও থাকেনি আমার জন্য চোখ পেতে।
কোন হিসাব করিনি কোনদিন—হিসাবের কড়ি নিয়ে
হিসাব শিখিনি—শুধু চেয়েছি অভাবের অঙ্ক মুছে যাক
জীবন থেকে—অনাহারের গন্ধ যেন না থাকে মুখে;
কিছুই পারিনি—পারার মতো আমি তেমন কেউ নই।
আমি তো বলেছি—আমি তেমন কেউ নই
আমার প্রাণহীন নিথর শরীরের জন্য
ক্ষণিক মুহূর্তের জন্য মঞ্চ বানানোর কোনো প্রয়োজন নেই;
অনর্থক শব্দ সাজানো ছাড়া আমি আর কিছুই পারিনি।
আমি কারো জন্য কিছুই করিনি
একমুঠো ভাতের জন্য আমি এ শহরে এসেছি—
অবজ্ঞাকে ভালোবাসা ভেবে আজো ধুলাবালি শরীরে পথ হাঁটি;
আমাকে কেন ভালোবাসতে হবে—আমি তো কিছুই করিনি।
আমি তো বলেছি—আমি তেমন কেউ নই
যদি চলে যাই মৃত্যুবন্যায়—
লোকদেখানো বেদনায় বুক ভেঙো না;
নিথর শরীর যদি বেশি ভারি হয়ে যায় কষ্ট নিয়ো না কখনো
আমার সন্তান নিয়ে যাবে জবাফুল পরীর বাড়িতে।
অদ্ভুত অভিযাত্রা
বিবর্ণ ঘাসের মতো কবিতা হারিয়ে ফেলছে সতেজ ঘ্রাণ
প্রতিদিন সুন্দরের প্রথম চুম্বন হয়ে নকশি শাড়ির মতো
অজস্র কবিতার পঙ্ক্তি হয়ে নতুন চরের মতো জেগে ওঠা
বালুকা বর্ণমালা দুঃখে নিজেকে লুকায় ধর্ষিতা
জননীর মতো—সবুজ ঘাসের ডগায় রক্তশিশিরে ভোর নামে
অদ্ভুত দুঃসংবাদে—বিষাক্ত ছোবল এখন স্বপ্নমৌতাত যৌবনে
বিকৃতসড়কে শেকড়ছেঁড়া এ এক অদ্ভুত অভিযাত্রা
হাছন লালন পীর মুর্শীদ ভাটিয়ালি একতারা কাঁদে
‘হায়রে আমার মন মাতানো দেশ’
পিতৃহীন অসহায় বালিকার মতো কাঁদে আমার স্বদেশ
অগ্নিকা বারুদে জ্বলে ওঠো কবিতাকুমারী
পদ্মা মেঘনা গড়াই জননীর বুকে
প্রাণঘাতি ছোবল নতুন শকুনের
অনেক মূল্যে কেনা জমিন এখন রক্তাক্ত ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল
অগ্নিশিখা হয়ে জ্বলে ওঠো স্পর্ধিত কবিতা—প্রতিটি নিঃশ্বাস
বুকের ভেতর পাথরের মতো ভারি ভয়াবহ দুঃসহ যন্ত্রণা—
তীরবিদ্ধ জননী—বুকের ভেতর কষ্টে কাতরায় স্বদেশ আমার
আমার শ্মশানদাহ আমারই থাকুক
আমার অন্তরবেদনা আমারই থাকুক
আমার শ্মশানদাহ আমারই থাকুক
আমার কলিজা কেটে কেটে যারা
সালাদ বানিয়ে তৃপ্তি করে খেয়ে গেলো
তারাও ভালো থাকুক—ভালো থাকুক সবাই
আমার ভরাট বুকে বর্ষা নদীর মতো
থৈ থৈ স্বপ্ন ছিল
প্রবল মাতাল স্রোতে ভেসে গেলো সব
পুকুরভর্তি মাছের মতো অচেনা হাওরে
তবুও ভালো থাকুক অধিকার হরণের গল্প
অন্ধকার মুখোশে নিজেকে ঢেকে
যারা চেতনার কথা বলে
যারা নতুন যৌবন দেবে বলে স্বপ্নবুননের
প্রতিশ্রুতির গোলাপ পাপড়ি ছড়ায়
দুমুখো গোখরা হয়ে মসৃণ সড়কে
জীবন চালায়—ভালো থাকুক তারা
ভালো থাকুক সবাই
ভগ্নস্তূপে বাসা বাঁধে কতো সাধের যৌবন
নিঃস্বজনের অন্তরে কত অন্তর্জ্বালা
অন্তরবেদনা কে কার চেনে বলো
সুখনদী খুঁজতে খুঁজতে সব পাখিই তো
দুঃখনদীর গহীনে হারায়
আমার অন্তরবেদনা আমারই থাকুক
আমার শ্মশানদাহ আমারই থাকুক