কবিতার লেখার গল্প
চোখের সামনেই এই পৃথিবীটা বদলে গেলো! এমন কি ভেবেছিলাম আমি! এমন ভেবেছিল এই বিশ্বালোক! এমন নিরস্ত্র অথচ কঠিন পারমাণবিক সময় পার করতে লাগলাম আমরা! কোভিড-উনিশ বদলে দিলো মানবের যাত্রাপথ। ২০১৯ সালে যে অণুজীব আমাদের ধাওয়া করতে শুরু করলো, তা থামবে কবে! কিভাবে থামবে! কেউ জানে না। এই মহামারি বদলাচ্ছে ভ্যারিয়েন্ট! বদলাচ্ছে গতিপথ! ভ্যাকসিন এসেছে। কিন্তু কেউ জানে না এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কতদিন! কতটুকু!
কোভিড-উনিশ আমাদের জীবনে দাগ রেখে যাচ্ছে। এই দাগগুলো চিরকালীন। আমি এই সময়কে ধারণ করে বেশ কিছু কবিতা লিখেছি, নতুন ভাবনায়। নতুন আঙ্গিক ও চিত্রকল্পে। আমাদের ‘সেমিনার’ এখন পরিণত হয়েছে ‘ওয়েবিনার’-এ। এখানে যুক্ত আমার প্রথম কবিতাটির নামকরণই করেছি সেই শব্দ দিয়ে। জুম, স্ট্রিমইয়ার্ড, গুগলমিট, ওয়েবেক্স; এমন অনেক প্রযুক্তি বড় ধরনের প্রচার পেয়েছে ২০১৯ সালের শেষ দিকে। এখন বিচারক রায়ও দিচ্ছেন জুমে। মিটিং, আলোচনা হচ্ছে জুমে। কথা ছিল মানুষ গণতন্ত্র নিয়ে জয়ী হবে। ভাসবে প্রেমতন্ত্রে! কিন্তু এই যে জুমতন্ত্র, তা নিয়ে কি আজ থেকে তিন বছর আগে ভেবেছিল কেউ! আমাদের এই যে নতুন পরিধান, তা নিয়েই আমার কবিতা ‘জুমতন্ত্র’।
ধরুন, ফেসবুকে আপনার বন্ধুসংখ্যা ৫০০০। তা থেকে প্রতিমাসে দুই-তিন জন বন্ধু চলে যাচ্ছেন পরলোকে। এরা বড় প্রিয় মানুষ ছিলেন আপনার। এভাবে কমছে, কমবে আপনার বন্ধু সংখ্যা। একদিন আপনি নিজেও চলে যাবেন পরপারে। আর এরই ধারাবাহিকতায়, আপনার এই ৫০০০ বন্ধুর সবাই লোকান্তরিত হবেন! তারপর! তারপর!
আপনার এই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট’টি পরিণত হবে ভার্চুয়াল গ্রেভইয়ার্ডে! আমি সে কথাটিই, সেই চিত্রকল্পটিই তুলে আনতে চেয়েছি এই কবিতায়। এখানে যুক্ত চতুর্থ কবিতা ‘ঝড়ের ঝাড়বংশ’। মানুষ আজীবন বাঁচে বুকের ভেতর একটি ঝড় নিয়ে। এই ঝড়, ঝাড়বৃদ্ধি করে। কখনো সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উপচে পড়ে। আবার থির হয়। চলতে চলতে আমার কাছে মনে হয়েছে, আমি একটি বড় ঝড়ঝাড় (বাঁশঝাড় নয়!)বহন করেই চলেছি! ছুটছি দিগ্বিদিক! এসব কথা কি কাউকে বলা প্রয়োজন! না প্রয়োজন নেই। কারণ একজন মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অনেকগুলো ইতিহাসের পাতা সমাধিস্থ হয়! মানুষের কুড়োনো দিব্যদৃশ্যগুলোর কোনো আর্টিস্ট থাকে না। আমার পঞ্চম কবিতাটি একটি দেশপ্রেমের কবিতা। একটি রাষ্ট্র অনেক মানুষের কররেখার যোগফল। অনেক মানুষের ভাগ্য-নিয়ন্তা যে মাটি; এর প্রতি ঋণ শোধ করার নয়। যারা এই বাংলাদেশের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন, তারাও তো আমার মতো, আমাদের মতো ভোগবাদী হতে পারতেন। পারতেন না? তাহলে তারা যে ত্যাগের মশাল জ্বালিয়ে আমাদের একটি স্বদেশ দিয়ে গেলেন, এর প্রতিদান কি? প্রতিদান হচ্ছে, আগামী প্রজন্মের জন্য একটি মানবিক, বৈষম্যহীন, সৎ ও শান্তিময় রাষ্ট্র রেখে যাওয়া। এটাই সামগ্রিকভাবে, সমষ্টিক শক্তির যোগফল।
কবি শহীদ কাদরী বলতেন, কবিতার ব্যাখ্যা নেই। কেন, কোন প্রেক্ষাপটে, কোথায়, কবিতাটি লেখা হয়েছে, তা বলতে বাধ্য নন কবি! আমি তার কথাগুলোকে সম্মান করি। মানিও। আমার থিওরি একই। আমি আমার মতো করে লিখব। আপনি আপনার মতো করে পড়বেন। ভালো লাগলে ভালোবাসবেন। না লাগলে নয়। একটি কবিতা, একটি পোস্টার। অনেক কথা বলে। বিভিন্ন সময়ে নিজের লেখা বিভিন্ন কবিতা আমার প্রিয় হয়েছে। তারপরও একটি কবিতা লেখার পর মনে হয়, মনে হয়েছে, ইশ! যদি একটি ভালো কবিতা আমি লিখতে পারতাম!
ওয়েবিনার
একদিন শহীদ মিনারকে সামনে রেখে আমরা
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম।একদিন সকল মানুষকে
সাম্যের পথে আহ্বান জানাতে আমরা হেঁটেছিলাম
দীর্ঘপথ।একদিন গভীর নদীগুলোর দিকে তাকিয়ে
হেঁকেছিলাম, ‘কিনার! কিনার!’
একদিন মাটিতে আমাদের পদছাপ ছিল। ছিল
প্রেমও। উষ্ণ আলিঙ্গনের দুপুর জ্যোতি ছড়াতো
কিনব্রিজে; আর আমরা সেতু পেরোতে পেরোতে
. অনুভব করতাম পারস্পরিক উষ্ণতা।
একদিন সেমিনার মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমরা পাঠ
করতাম; লেনিন, এঙ্গেলস, কার্ল মার্ক্সস
পাঠ করতাম, রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়ার, রুমি, হাফিজ,
শামসুর রাহমান’-এর স্বাধীনতার ভাঁজে নিমগ্ন
. পাখির গায়ে পরিয়ে দিতাম নতুন পালক।
সেই দিন, কল্পনার ভিন্নমেরু এখন!
সেমিনারের প্রথা ভুলে গিয়ে এখন আমরা
সাজাই একক ওয়েবিনার! অনেকটা আত্মভোলা
তাসপ্রেমীর মতো কয়েকজন মিলে একে অপরের
কথা শুনি। তারপর মিডিয়ায় প্রেসবিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে
বলি, আমাদের ভার্চুয়াল ওয়েবিনারে সকলেই
. ছিলেন প্রধান অতিথি!
জুমতন্ত্র
ছবিগুলো খুবই শীর্ণকায়। চেনা যায় না চেহারা!
গুচ্ছ গুচ্ছ মুখের প্রতিবিম্ব এই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা
করেছে নতুন এক শাসন, ‘জুমতন্ত্র’!
ছাত্রছাত্রীরা বিশ্বের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মিলিত
নাম রেখেছে, ‘জুম ইউনিভার্সিটি!’
নীরব বেডরুম হয়ে উঠেছে অধ্যয়নকক্ষ!
আর জানালার সূর্য জানান দিচ্ছে, এই মাটিতে এখন
পড়ে আছে মহামারী কোভিদ-১৯-এর আঁচড়!
কথা ছিল মানুষ আরও কাছে আসবে। জাতিসংঘের
যে অধিবেশনে দাঁড়িয়ে সামগ্রিক রক্তযজ্ঞের বিরুদ্ধে
কথা বলার রুটিন ছিল শাসকদের
তাদের চোখে এখন রাজ্যের ঘুম! স্ট্রিমইয়ার্ড,
কিংবা ওয়েবেক্স-এর সারিতে পাল্লা দিচ্ছে গুগলমিট!
মানুষ ভুলে যাচ্ছে স্পর্শের কলাকৌশল!
মনিটরে শব্দগুলো ভাসছে। ছবিগুলো ভাসছে!
বিশ্বের একপ্রান্তের মানুষ দেখছে অন্যপ্রান্তের মানুষের
ছবি! কেউ কাউকে ছুঁতে পারছে না। করমর্দনের
রীতি ভুলে গিয়ে, ভাসছে
. ভেসে যাচ্ছে ওয়েইভ-সভ্যতায়!
ভার্চুয়াল গ্রেভইয়ার্ড
একজন মানুষ চলে যাচ্ছে। ভার্চুয়াল আকাশে
তার জন্য শোকে উড়ছে একটি শালিক। জগতের
ফেসবুকে শোভা পাচ্ছে তার মেমোরি সংবলিত
কয়েকটি গোলাপ। রহিত হয়ে যাচ্ছে
. নিজের টাইমলাইনে তার লেখাজোখা!
যে পাঁচ হাজার বন্ধু নিয়ে এই মুখবইয়ে আমি
শব্দকল্প আঁকা শুরু করেছিলাম,
একে একে ওরা সবাই একদিন হারিয়ে যাবে!
কিংবা তারও আগে আমার টাইমলাইনে গজিয়ে
. উঠবে মেমোরির পুষ্পবৃক্ষ!
সবাই খুঁজবে একে অপরকে!
. কেউ কারও আর দেখা পাবে না।
সর্বশেষ বন্ধুটির মৃত্যুর পর মূলত একটি মুখবই
পরিণত হবে একটি গ্রেভইয়ার্ডে! আজ থেকে
দুইশত বছর পর কেউ জানবে না,জানতে চাইবেও না
এখানে অনেক মানুষের কোলাহল ছিল।
. এখানে মেঘ বুনতে বুনতে মানুষেরা অপেক্ষা করতো
. বৃষ্টির।প্রেমিক অপেক্ষা করতো তার প্রেমিকার একটি
. দ্রোহী ইনবক্স ম্যাসেজের!
ঝড়ের ঝাড়বংশ
মানুষের বুকের ভেতর একান্ত সংগোপনে
বেজে উঠে অনেকগুলো ঝড়। একসময় ওদেরও
বংশবৃদ্ধি হয়;
. ঝাড়ে ও উজাড়ে ঝড়েরা রেখে যায়
তাদের দাগ। কেউ দাগগুলো চিনতে পারে।
. কেউ পারে না।
জগতে সবাইকে সবকিছু পারতে হবে এমন
লিখিত কোনো বিধান নেই। যারা স্থপতি,
তারা নকশা আঁকে। ইটের পর ইট লাগিয়ে
স্থাপনাটি নির্মাণ করে
. অন্য কোনো কারিগর।
অথবা এই যে দিব্যদৃশ্যগুলো তুমি কুড়িয়ে
আনো প্রতিদিন জীবন থেকে, তাদেরও
নির্দিষ্ট কোনো নির্মাতা নেই।
. ঢেউ কিংবা বিজলী
. নিশ্বাস কিংবা হাওয়া
তারাও নির্মিতির ইতিহাস জানার জন্য
প্রতিদিন নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়।
মানুষ সেই অস্তিত্বে নিজের অস্তিত্ব মেশায় মাত্র।
কররেখার যোগফল
আমি যা লিখি; তা আমার কররেখার যোগফল।
আর তুমি যা পড়; তা কেবলই তোমার ভূমিবন্দনা!
যেখানে দাঁড়িয়ে তুমি হিজলফুল দিয়ে চুলের বেণী সাজাও
. যে মাটিতে তুমি গোল্লাছুট খেলো।
কিংবা যে বাউল আনমনে নদীতীর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে
মাঝির গানের সাথে বাজায় দোতারা—
তার দিকে তাকিয়েও তুমি খুঁজতে পারো
. মার্চের শরণার্থী-স্মৃতি,
. আর পড়তে পারো এমন গল্প…
সবুজ ফসফরাস পাঁজরে নিয়ে যে মাটি একদিন
. তার সন্তানদের কাছে ডেকেছিল—
তারাই এতে মিশিয়ে দিয়েছিল রক্ত। তারাই বলেছিল;
আমাদের জীবন উৎসর্গকৃত হোক তাদের জন্যে—
যারা একদিন স্বাধীন সূর্যের নিচে সমবেত হবে।