[নভেম্বরে ধারবাহিকভাবে রচিত কুড়িটি কবিতা। তাই কবিতাগুলো নির্বাচিত হয়। তবে পাঠক তারিখ মোতাবেক দেখবেন, সাম্প্রতিক ঘটনাবলির সঙ্গে অতীতকে সমন্বয় আন্তর্জাতিক বিষয়ের সঙ্গে স্বদেশি বিষয় মিশিয়ে লেখা কবিতাগুলো। প্রায় প্রতিটি কবিতা বিষয়-বৈচিত্র্যে যেমন নতুন প্রেক্ষাপটও একটি থেকে আরেকটি স্বতন্ত্র। একটি কবিতা থেকে আরেকটি কবিতা দূরত্ব পাঠক সহজেই উপলব্ধি বা অনুধাবন করতে পারবেন।]
খুঁজে বেড়াচ্ছি হাবিলকে
আলো-বাতাস-মাটি-জলের সমন্বয়ে পুতুলের মতো সৃষ্টি হয়েছিল
আমাদের মিশরীয় মা।
মিশরের প্রাচীন সভ্যতায় তখন চিকিৎসাশাস্ত্র ছিল,
আল্ট্রাসোনোগ্রাফি ছিল না।
প্রেগনেন্সি টেস্ট হতো রূপকথার মীথের মতো
দুই পাত্রে রাখা হতো গর্ভবতীর মূত্রত্যাগ
একটিতে বার্লির বীজে,
অন্যটিতে গমের দানায়।
সেই দানাবীজ অঙ্কুরোদ্গম হলে সে নারী অন্তঃসত্ত্বা; মা হতে যাচ্ছে।
বার্লির বীজ ফুটলে কন্যা; বার্লিবীজ থেকে তুমি মেয়ে হয়ে উঠলে
গমের দানা জাগলে পুত্র; গমদানা থেকে আমি ছেলে হয়ে উঠলাম
যেনো দুই মায়ের যমজ ভাইবোন।
নীল নদের তীরে খননে উদ্ধারকৃত প্যাপিরাসে লেখা আছে আমাদের জন্মকথা!
পুরাণ কাহিনীর লিলথের কথা।
এই কাহিনীর সাথে পূর্বপুরুষ ও পূর্বনারীর বিনিসুতায় যোগসূত্র আছে
আদমের পাঁজরের হাড় থেকে দ্বিতীয় স্ত্রী হাওয়ার জন্ম এবং
পৃথিবীকে মানব বাগান বানানোর গল্প।
বিবি হাওয়ার গর্ভে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি হতো যমজ ভাইবোন।
কিন্তু জোড়ার বন্ধন হতো অন্যভিন্ন জোড়ায়।
সুন্দরীবোন, নারীবোন নিয়ে হাবিল-কাবিলের কাইজ্যা!
অমিমাংসিত দ্বন্দ্বে ক্রোধান্বিত কাবিল
পৃথিবীর তৃতীয়তম মানুষ একদিন হয়ে উঠলো পৃথিবীর প্রথম হত্যাকারী!
হাবিলের রক্তে ভেসে গেলো আরাফাতের শস্যক্ষেত
[কথিত আছে; এসব কর্মে শয়তানের ইন্দন ছিলো।]
তার আগে দুম্বা উৎসর্গ করায় গল্প প্যাপিরাসে নেই,
সবজি ও শস্য উৎসর্গের কথাও নলখাগড়া গাছের বাকলে নেই।
আকাশ থেকে নেমে এসেছিলো আগুন,
বাতাস থেকে উড়ে এসেছিলো কাক।
দুম্বা, শস্য, আগুন, কাকের কথা প্যাপিরাসের পাতায় নেই,
আছে অন্য কোথাও।
গমের শস্যদানা থেকে আজ আমিও কাবিল হয়ে উঠছি,
খুঁজে বেড়াচ্ছি; হাবিলকে!
শীতঘুম
বাতাসে বাতাসে ম্যাপল লিপের বর্ণিল নৃত্য নেই
ঝরাপাতা, মরাপাতা
স্তূপাকারে মিশে যাচ্ছি মাটির মাদুরে।
ঝলমলে হালকা রোদের সাথে
ঝিরঝির তুষার নেমে আসছে শাদা পরীদের মতো
মাইনাস আটে বরফ জমবে সন্ধ্যায়।
সেই বরফ হাবুডুবু খাবে স্কচের গ্লাসে।
তোমার শহরে মৃত রোদ
তোমার গ্রামে কুড়িগ্রামে
প্লাস আট।
কুয়াশায় ভেজা পাখিরা পাতার চাঁদরে জড়সডড়ো।
শীতোৎসবে একটি মাফলারের গল্প পাঠিও,
তাল-খেঁজুরের তাড়ি ছবি পাঠিও।
দেখবো।
শীতকাল আসো, আমরা কুনোব্যাঙ হয়ে থাকি।
আমরা ইনবক্সের উষ্ণতায় যুক্তাক্ষর হয়ে জড়িয়ে থাকি
পৌষ আর মাঘের মাঝখানে, সন্ধিক্ষণে
ঘুমিয়ে থাকি অনন্ত শীতকালে।
আগুনের জিহ্বা
উত্তেজিত আগুনের জিহ্বার বিপরীত দিকে সাপের নীল ছোবল
মুখোমুখি।
মাঝখানে থানার মানুষ, মাঝখানে মসজিদ।
ওয়াকিটকির নেট ছেঁড়া ছেঁড়া দড়ি।
আগুন ফুসে উঠছে: গ্রামবাসী
সাপও ফণা তুলছে: সাহাবীরা
পুকুর পাড়ে পড়ে আছে শুক্রবার,
ওসি সাহেব গ্রামীণ ফোনে কথা বলছেন
শহরের স্যারের সাথে,
স্যার কথা বলছেন আরো আরো উপরের স্যারের সাথে।
দফায় দফায় কথা হচ্ছে; ওঁঝার প্রয়োজন,
দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে; দমকল বাহিনী দরকার।
দূরে কোথাও একটা অবৈধ গুলির শব্দ।
নিঁখোজ গেলমানকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না!
ধানমা
ধানফুল, ধানদুধ
ধানভাত, খাদ্য
ধানকন্যা, পুষ্প
ধানকুমারী,
ধানযুবতী,
ধান বয়ঃসন্ধি।
ধান নবান্ন
ধান হেমন্ত
ধান সুন্দর, সন্ধ্যা
ধান বিবাহ
ধান আনন্দ
ধান উৎসব, সঙ্গীত।
ধান ধন্য
ধন ধান্যে
ধান সোনালি শস্য
ধানরচনা
ধানসন্তান
ধানপ্রাণ, উৎস।
ধানচাষী ভাই
ধানবাঙালি
ধানচর্যা, কৃষ্টি
ধানকবিতা
ধানবীজ, মন্ত্র
ধান-মা জননী!
বর দেখা ভোর
‘কনে দেখার আলো’র দিন
এবং কনে দেখার অন্ধকার আজ থেকে ফুরিয়ে গেলো ঘটকালি।
এখন পাত্রীকে টুকটুকে ঘোমটা পরে
মাথা নত করে লাজুক-নম্র হয়ে
দিতে হবে না মৌনতার কঠিন পরীক্ষা।
দাঁড়িতে মেহদী মাখা পান খাওয়া মুরব্বী
টিপে টিপে দেখবে না কোমল হাত, হাতের ভাগ্যরেখা,
খোমটা খুলে দেখাতে হবে না চুলের দীঘলতা।
শাদীর ঐতিহ্যে আর কেউ প্রশ্ন করবে নাঃ
মা আর শাশুড়ির মধ্যে পার্থক্য কি?
মাগ্রিব এবং তাহাজ্জুত কখন পড়তে হয়?
পাঁচ জন নবীজির নাম বলো,
কোন জিনিস রাঁধতে কোনো মসলা লাগে না?
মা, খালি পায়ে একটু উঠোনে হেটে আসো।
বরপক্ষে হাতে গুজে দিবে না নজরানা; হাদিয়ার নোট।
আজ থেকে বাতিল করা হলো যৌতুক।
আজ থেকে শুরু হোক- বর দেখা ভোর!
পার্শ্ব চরিত্র
হেমন্তে চলছে ধুনকরদের হৈমন্তিক লেপচাষ!
শীতকালে কেউ কেউ সুগন্ধি শাদাফুল হয়ে যায়,
কেউবা কুনো ব্যাঙ
ব্যাঙের বেদনা তুমি বুঝবে না।
বায়োলজি ক্লাশে ব্যাঙ কেটে কেটে সভ্যতা শিখেছি,
কিন্তু শিখিনি ব্যাঙের ভাষা ও বেদনা।
তোমার চেয়ে, তোমার লাল লেপের চেয়েও
ব্যাঙকেই বেশি ভালোবাসি।
এখানে তুমি বা শীতকাল, শাদা শাদা ফুল,
কেউ-ই কেন্দ্রীয় চরিত্রে নেই,
টুকটুকে লেপও পার্শ্ব চরিত্র!
রুপি কৌর
তুমি কি ভুলে গেছো তোমার ছায়াকে
পঞ্জাবি ভাষা, অমৃতসর, স্বর্ণমন্দির!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে
সন্ধ্যা-সকাল পুতুলখেলা Milk and Honey নিয়ে,
খেলছো Home Body নিয়ে,
আর পৃথক করছো The Sun and Her Flowers.
ভক্তকূলের কৌতুহল
ফিনফিনে মসলিনের আড়ালে রুপির রূপের উৎস,
দুধ কি তোমার দেহদুধ, মধু কি মৌচাকের
নাকি কানাডিয়ান মেপলের রস!
ঋতুৎসবের আনন্দ, রজস্বলার রঙ ছড়িয়ে দিয়েছো
স্যানিটারি নেপকিনে
পাজামায়, বিছানায়, কোমডে, কবিতায়…
পাপড়ির সৌরভে ছড়ানো তোমার নান্দনিক নগ্নতা।
তুমি কি ভুলে গেছো আমাকে এবং…
‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ…’
রেপ্লিকা
তোমাকে হুবহু রেপ্লিকা করে রাখবো
ধর্মেও থাকবে, জিরাফেও।
আংশিক বা বাকি অংশ নয়, পুরোটাই আনন্দ!
উভয়চরী নয়; সূরায় এবং সুরায়
বৈশাখে, একই সাথে জানুয়রিতেও ফুটবে শুভেচ্ছা।
এক চাঁদের কূলপ্লাবি জোছনা।
ভূমি ভাগাভাগি, ভগ্নাংশ বিরোধী
থাকবে অখণ্ডিত
প্রকৃত আর অনুলিপির পার্থক্যে সৃষ্টিকারীও বিভ্রান্ত হবে।
মুদ্রা, মানব পাচার নয়।
কষ্টিমূর্তি, দুষ্প্রাপ্য প্রত্নতত্ব, দুর্লভ শিল্পকর্মের মতো
তুমি পাচার এবং পাইরেসি হয়ে যাবে-
-প্যারিসে অথবা কবিতায়।
একই সাথে
যমজ হয়ে থাকবে এক সংসারে এবং আরেক স্বপ্নে।
নারীবাদী সেমিনারে
-সাইকেল বা সিগারেটের কোনো লিঙ্গ নেই; ক্লিব।
উভয়ের জন্য প্রযোজ্য।
-জীবনযাপন সম্পূর্ণ নিজের জন্য, ক্যাঙ্গারুর মতো নয়,
সন্তানের জন্য নফল। থাকলে সওয়াব; না থাকলে গুনাহ নেই।
-নারীবাদী কোনো নদী বিষয়ক রচনা নয়,
মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় খুবই অপমানজনক।
-স্বামীদের চেয়ে পর পুরুষেরা ৯৯% ভালো,
ভালো বাসতে জানে, হাসতে জানে।
-জন্মসূত্র আমিই আমার মালিক
ক্রয়সূত্রের মতো বিবাহসূত্রে মালিক, মিথ্যে!
-‘মাতৃভূমি’ ফেমিনিজম শব্দটা আপত্তিকর;
ঋতুস্রাবের মতন এক তরফা!
-নারীবাদ বিজ্ঞান বা ব্যাকরণের বিপক্ষে নয়,
আবার সেক্সটয়ের পক্ষেও না।
– নারীবাদ কোনও নোংরা কিছু নয়, মুক্তাঙ্গনে ঘোড়াদৌড়
পুরুষ বিরোধী বা ব্রা বিরোধী নয়।
-মেয়েরাই নারীদের শত্রু,
যেমন সিমন লুসি এর্নেস্তিন মারি বেরত্রঁ দ্য বোভোয়ার।
স্বামী সম্মেলন
তিনশ’ পয়ষট্টি দিবসে আর নতুন দিবসের স্থান নেই।
ভাগ্যিস, পুরুষ জাতী হিসেব একটা দিবস কপালে জুটলো
১৯ নভেম্বর, মনে পড়লো-
পুরুষ রক্ষা সমিতির কথা, মনে পড়লো- গন্ধমকাহিনী।
আমিও শীত এবং নারীদের প্রতিবেশি ছিলাম।
স্বপ্ন দেখতে দেখতে
আরেক স্বপ্নের ভেতর এক রাত্রির জন্য
নারী হয়ে গেলাম।
নিয়ন্ত্রণহীন অগোছালো স্বপ্নের ভেতর
নির্মলেন্দু গুণ নেপালের নারী বিষয়ক মন্ত্রিত্ব পেলেন!
এতে আমার কোনো হাত ছিল না।
সকল স্ত্রী একদিনের জন্য স্বামীর মর্যাদায় পদোন্নতি পেলেন!
প্রতিবেশী নেপালে আয়োজিত হলো-
স্বামী সম্মেলন!
পাশাপাশি আনন্দ এবং বেদনায়
গাছে গাছে শুরু হলো ভিন্ন এক বানর সম্মেলন!
কারণ, তাদের মধ্যে কোন
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নেই।
সিলেবাসের বাইরে
ক)
নবম শ্রেণী ম্যাডামের খুব প্রিয়
ম্যাডাম মানে টরন্টো স্কুল বোর্ডের মিস মারিয়াম।
ক্লাস নিতে নিতে পড়াতে পড়াতে
৪১ থেকে ১৪ সমান্তরাল হয়ে ফুটে অগ্নিফুল।
খ)
শুধু পাঠ্যে সীমাবদ্ধ নয়;
সিলেবাস থেকে তোমাকে নিয়ে যাবো
পাঠ্যসূচির বাইরে তুমি শিখবে ড্রাইভিং, শেখাবো সাঁতার,
বানাবো সাপুড়ে
এবং জানবে জলাহার, ফলাহার।
সাঁতার শিখতে শিখতে একদিন হয়তো ব্রজেন বাবু হবে।
শিক্ষানবিশ সাপুড়ে। লুকাও গর্তে।
লুকাও…লুকাও…লুকাও…
বাইরে তুষার ঝরছে, জমছে বরফ, শীত শীত
শীতের তীব্র ঘ্রাণ
লুকাও গর্তে! উষ্ণতার বিষরস ঢালো, বিয়ার ঢালো।
সামারে আউটডোরে হরিণ শিকারে যাবো,
মৃগনাভীর সুবাসে নগ্ন জোছনা দেখতে দেখতে তুমি অন্ধ হবে।
মদ্য এবং মধ্যরাতে মাতাল কটেজ হয়ে উঠবে-
টরন্টো স্কুল বোর্ড।
তোমাকে শেখাবো যাবতীয় নন্দন।
ফলঋতুতে তুমি দেখবে চোখ ধাঁধানো রঙধনু
বেনিআসহকলা,
শরীরের শাখায় শাখায় পাতাদের রঙিন আনন্দ।
খামার বাড়িতে তখন তুমি খুবই তৃষ্ণার্ত এবং ক্ষুধার্তবোধ করবে
ফলাহারে আপেল খাবে, চেরি খাবে
খাবে মেপলের মধু।
গ)
বাড়িতে আবিদ আজাদের কবিতার মতো
ছোট আন্টি আমাকে এন্টি-আদর করে কোলে নেয়,
ভয় হয়। মা বকবে।
আর ক্লাশে মিস ম্যাডাম নিয়ে যায় সিলেবাসের বাইরে
আমার ভীষণ ভয় হয়!
আমি সাঁতারু-সাপুড়ে হতে চাই না,
ডুবে যাবো, বিষের ছোবলে বিষাক্ত হবো।
ভয় পাই, ভয় পাই, ভয় পাই…
হাসান আজিজুল হক
হাসান আজিজুল হক আর নেই।
খবরটি শোনে আমি বেশ কিছুক্ষণ হাসলাম।
আজ রাত ৯.১৫ মিনিটে তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন!
মনে হলো; হলুদ সাংবাদিকতা!
কেউ মৃত্যুবরণ করলে শোকার্ত মানুষের চোখ ভিজে যায়,
আর আমার হাসি পেলো।
কী অদ্ভূত এন্টি-রেসপেক্ট!
বস্তুনিষ্ঠ সত্য সংবাদকে আশ্চার্য ভাবে ভাবছি;
ইয়লো জার্নালিজম! হা হা হা
এই কবিতাটি পড়ে তিনি ফোনে বললেন:
‘দেখলে দুলাল, ওরা আমাকে মৃত বানিয়ে দিলো’!
মাওলানা কারী কামরুজ্জামানের কবিতা
বরিশ্যাইল্যা মিলুকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম কলকাতায়
আর চুরুলিয়ার দুখু মিয়াকে এনেছি ঢাকায়।
তারা মিলুকে মেরেছে ট্রামচাপা দিয়ে,
আর দুখুকে দুঃখ দিতে দিতে, কষ্ট দিতে দিতে
. পাগল বানিয়ে ছেড়েছে।
এক দেবীকে দিয়ে তাকে হিন্দু বানাতে চেয়েছিল!
আমি হিন্দু এবং হিন্দুস্থানবিরোধী,
আমি লিখবো আমাদের জাতীয় সঙ্গীত।
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
ভালোবাসা, ভাত ভাগাভাগি করা ঋণগুলো
কষ্টে থাকা, ধারকর্জ দিনগুলো
ফিরে পেতে চাই
নীড়ে যেতে চাই।
অর্থহীন অর্থ হীন আমাদের দোষগুণ
ছিল না তো হুঁশ, গুণ!
ভরে আছে দোকানের বাকি খাতা, বহু পাতা!
নকশী স্বপ্নে জীবনের ছেঁড়া কাঁথা।
সুদ থেকে শোধের দূরত্ব দূর দেশ বহুদূর,
সে সঙ্গীতে নেই কথা, নেই সুর!
তবু ছিল কবুতরপ্রেম,
তবু ছিল আমাদের রুমাল বাঁধানো ফ্রেম।
ছিলো নেবুফুল, গন্ধঘ্রাণ, শান্তি, স্নেহ।
ভাগাভাগি করা যৌথযুক্ত দু’টি মিশে থাকা দেহ।
কবিতা বিক্রির বিজ্ঞাপন
বাবা নিরুদ্দেশ হবার পর,
মা তৃতীয় বিবাহ করার পর
ভাইটি পাগল হবার পর, বোনটি আত্মহত্যার পর
বিক্রি করার মতো আমাদের আর কোন বুদ্ধি ছিলো না।
শীত, অগ্রহায়ণহীন ভাবে, অভাবে
আমরা বেড়াল-কুকুরদের মতো বড় হয়ে উঠলাম।
আমাদের সাথে লতিয়ে লতিয়ে বেড়ে উঠলো ক্ষুধা!
জন্ম সালের নিরন্নকাল, দূর্বিসহ
বৈশাখী ঝড়ের মতো তছনছ করে দিয়ে
চারিদিকে শ্রাবণের বৃষ্টির মতো ভয়াবহ মহা মন্বন্তরে
আকাশ থেকে নেমে এসেছিলো নাট্যশালার দীর্ঘ কালো পর্দা।
জায়নামাজের মতো জমি
মায়ের আঁচলের মতো খানিকটা উঠান
আংশিক ভিটা, ভিটাবাড়ির গাছ
হালের গরু
ঘরের টিন
বিয়ের শাড়ি বিক্রির পর আর কিছুই অবশিষ্ট ছিলো না!
দীর্ঘ উপবাস, টানা অনটনের পর একরাতে ভাতের কষ্টে
বিক্রি করে দিলাম রক্ত
বিক্রি করে দিলাম কিডনি!
পুত্র সন্তান হলে এতিমখানায় দিয়ে দিতাম। তাই
সন্তানহীন মহামান্য মোডলের কাছে
দত্তক নয়;
বিক্রি করে দিলাম আদরের আত্মজা
(আমার আত্মজা তার পালিত পিতার কাছে লালিত হবে
মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাবে, ফ্রক পাবে, ফুল কুড়াবে, স্কুলে যাবে…)
সেদিন নিরুদ্দেশ হতে ইচ্ছে করছিলো,
আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছিলো, উন্মাদ হতে ইচ্ছে করছিল।
কোনো এক নবান্নে, কোন এক কাল্পনিক সন্ধ্যায়
আভিজাত্যে মোড়া পরীর মতো
মেয়েটি সাথে দেখা হয়েছিলো ব্যর্থ বাবার।
ভেতরে রক্তক্ষরণ, বাকরুদ্ধ।
প্রাণপণ করেও কিছু বলতে পারিনি–
কঠিন কাঠগড়ায় অমার্জিনীয় আমি অব্যক্ত আসামি।
তখন আবারো নিরুদ্দেশ হতে ইচ্ছে করছিল,
আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছিল, উন্মাদ হতে ইচ্ছে করছিল।
ভাষাহীন বাবার দিকে অভিমানী মেয়েটির ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি। কাঁদলো
বাবা কাঁদলো।
আমরা কাঁদলাম।
ভাবলাম, আত্মজার পর আজ আবার আত্মা বিক্রি করবো।
হাহাকারে ছড়িয়ে দেবো
কবিতা বিক্রির বিজ্ঞাপন!
ক্ষমতার শ্রেণীবিন্যাস
ক্ষমতায় অনেক গুণ থাকে, ভিটামিন থাকে
শক্তি সালসা থাকে।
ক্ষমতার পাঁচ পা, কিলোওয়াট
ক্ষমতা দেখা যায় আবার যায়ও না বটে।
যেমন পাগলা ঝড়
নিরীহ বাতাসকে ক্ষেপিয়ে ছিঁড়ে-ফেরে তছনছ করে।
হাতির শুঁড়ে, জিরাফের গলায় ক্ষমতা থাকে,
ক্ষমতা থাকে সচিব এবং ঘোড়ার শিশ্নে।
উন্নত তব স্তনে ক্ষমতা
কলমের খোঁচায় অনেক অনেক ক্ষমতা।
গানে, গ্রন্থে ক্ষমতা আছে
ছুরির বুকে, বন্দুকের নলে, ভোটে-ব্যালটেও ক্ষমতা।
আয়না এবং ডাক টিকিটের ক্ষমতায় মুগ্ধতা আছে,
গার্লিভার মুদ্রার ক্ষমতা লিলিপুট ঈশ্বরের চেয়ে অসংখ্য গুণ।
গোগুলের ক্ষমতা ভূগোলের চেয়ে ঢের,
খুনি হবার ক্ষমতাও আলোচ্য বিষয়।
এই যে তুমি আমাকে ভালোবাসো না,
ওটাও ক্ষমতা।
অক্ষমতাগুলো আমি আমার কবিতায় লুকিয়ে রাখি,
এটাও ক্ষমতা।
গ্রেফতার
আমাদের প্রপিতামহ ধনী ছিলেন না, গরীব ছিলেন না,
এবং মধ্যবিত্তও না।
তারা ‘ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে স্বরবর্ণ যোগ’ করতে পারতেন না।
তাদের সাকিন ছিলো কিন্তু হোল্ডিং নাম্বার ছিলো না,
তারা কোনো দিন ভোটার ছিলেন না,
মন্ত্রণালয় ছিল না।
শুনেছি, শহর তাদের কাছে উড়োজাহাজ
আর বিদেশ মনে হতো!
প্রপিতামহের প্রপিতা ছিলেন অধর্মী এবং নিজস্বরবাদী
পূর্বপুরুষ-উত্তরসূরি ধারাবাহিক বংশবীজ
আমারও কোনো হোল্ডিং নাম্বার নেই।
শহর আমার কাছেও উড়োজাহাজ
দূরদেশ মনে হয়।
দুই পুরুষ আগে
আমাদেরও কোন অনটন ছিলো না, মধ্যবিত্ত ছিলাম
শুধু কিনতে হতো; নুন, চুন আর কেরোসিন।
পিঠের ঘামনুন দিয়ে
আর ক’দিন সংসার চলে!
কোন এক তীব্র খরার বছরে কুয়ার জলপানি শুকিয়ে গেলে
নদীর হাটে কলসি নিয়ে গিয়েছিলাম;
জল কিনতে।
সেখানে সবাই কাঁদছে!
কেউ কেউ বিক্রি করছে নিজদের অশ্রুজল।
প্রপিতামহ বাজারের দৃশ্য আর অশ্রুজল দেখতে এসে
সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার হলেন!
তিনি আগন্তক নন;
এই মাটিতে মিশে আছে তার অস্তিত্ব, কঙ্কাল-
মাঠে মাঠে রয়েছে পায়ের ছাপ!
বাহাত্তরের সংবিধান
মৌলিক চাহিদা ছাড়া যৎ-সামান্য চাই,
ছেলেটার জন্য চাকরি
মেয়েটার জন্য একটা ভালো শ্বশুরবাড়ি।
ডাল ভাত, ঝোল ভাত
সাথে কয়েক ফোঁটা কাগজিলেবুর রস,
সামান্য পান-সুপারী।
চাই, কুকুরের শান্তিপূর্ণ সঙ্গম,
চাই, আতাগাছে তোতাপাখি।
চাই, বুবু-বিবি-দিদিদের খোঁপায় টুকটুকে জবাফুল
নদীস্নান, নিমডালে দাঁত মাজন,
প্রতিদিন একটি সকাল।
কবিতা নয়; লিখতে চেয়েছি, একটি খাঁটি গরুর রচনা।
চাই, নাকডাকা গার্হস্থ্য ঘুম; ওঁম শান্তি,
চাই, সুদমুক্ত কৃষিঋণ।
এবং চাই, বাহাত্তরের সংবিধান।
মৃত্যুচিন্তা
অনিবার্য মৃত্যু আমাদের পরম প্রিয় এবং স্থায়ী বন্ধু
ওঁম শান্তির চিরস্থায়ী আশ্রয়মাতা
জন্মের বিপরীতে আমাদের আরেক মা-মৃত্যু।
মৃত্যুর ঘ্রাণ পারফিউম হয়ে বাজারজাত হোক,
মৃত্যুর গন্ধ এবং অমৃত আনন্দ আমাকে বিভোর করে
এন্টি উৎসবে পরম তৃপ্তি
তাই গ্রহণ নয়; আমরা ‘বরণ করি’… মৃত্যু।
বহুবিদ কষ্ট, নানাবিদ বেদনা, যাবতীয় যন্ত্রণা থেকে
পূর্ণদৈর্ঘ্য ঘুম দেয়,
আহ উপশম, আহ মুক্তি।
জীবনের সমাপ্তি, আহ অনন্ত সাঁতার, শান্তি…
বন্ধন, ব্যর্থতা থেকে; পাপ, পরাধীনতা থেকে,
শীত, শ্বাসকষ্ট থেকে
এই সব মানুষ থেকে
কর্পূর হয়ে যাওয়ার তৃপ্তি দিতে পারে একমাত্র মৃত্যু।
দুঃখ, দুর্বিষহ জীবন
মানসিক যন্ত্রণা, শারীরিক অসুস্থতা, সামাজিক অনাচারের
মহাঔষুধ চিরনিদ্রায় আনন্দের মৃত্যু
মৃত্যু পার্ট অব লাইফ।
ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপবাসী টুরাজন সম্প্রদায়
‘মানেনে’ শীর্ষক উৎসবে
কবর থেকে লাশ তুলে মেতে ওঠে!
কোনো কোনো আদিবাসী নেচেগেয়ে মৃতকে স্বর্গে পাঠায়!
মৃত্যু মানে আরেক এন্টি হ্যাপি বার্থ ডে….
জীবনের অবসান আনন্দের ভরে উঠুক
মৃত্যুতে ভয়ভীতি নেই, বিষণ্ণতা-বেদনা নেই।
জন্ম-মৃত্যর দূরত্ব একটি ড্যাশ।
স্বরচিত মৃত্যু ওরফে আত্মহত্যা ইতিবাচক
ইউথেনেশিয়া মৃত্যু কোনো পরাজয় নয়; স্বাভাবিক সন্ধ্যা
সন্ধ্যা মালতির গন্ধে ভরপুর
কিছুটা কবিতা; বাকীটা রহস্যময়।
মানুষের শত্রু মানুষ; মৃত্যু আমাদের শত্রু নয়,
মৌলিক চাহিদা।
‘মরিবার হল তার সাধ’;
সেই সাধ পুরণে স্বীকৃতদাতা দেশকে ধন্যবাদ
ধন্যবাদ-
‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব রাইট টু ডাই সোসাইটিজ’।
মৃত্যু আমার পরকীয়া,
মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান
প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে
মৃত্যু সর্বদা একটি গল্পের সমাপ্তি।
ধর্ম-বিজ্ঞান-জীবনবাস্তবতা-জাদুবাস্তবতা
কিছু ধরে রাখতে পারে না রুহাত্মা।
বাধ্যতামূলক মৃত্যূকে স্বাগত, অন্তিম অভিনন্দন!
অদৃশ্য ঈশ্বরের মতো
পাতা থেকে পোকা, পোকা থেকে পাথর, পাথর থেকে আগুন,
আগুন থেকে অক্টোবর, অক্টোবর থেকে নীল রঙ
এভাবে তোমাকে রূপান্তর করতে করতে
মন্ত্রপাঠ করতে করতে
শূন্য বানিয়ে শূন্যতায় ছড়িয়ে দেবো অন্তরীক্ষে
মিলিয়ে যাবে কর্পূরের চরিত্রে।
তোমাকে আমার আত্মজীবনীর ভেতর লুকিয়ে রাখবো,
অদৃশ্য হয়ে থাকবে ঈশ্বরের মতো,
অনাবিষ্কৃত বিজ্ঞানের মতো,
বাতাসের মতো।
চিন্তার মধ্যে রাখলে তুমি প্রকাশিত হয়ে যাবে
ডিমে কুসুমে গোপন করে রাখলে ফুটে যাবে
মেহেদী পাতার ভেতর থাকলে হয়তো রঙ হতে হবে
প্রসবিত হতে হবে-
মাতৃগর্ভে রাখলে।
মনের ভেতরেও নয়; মন একটা পাবলিক প্রোপার্টি
মন একটা গোদাম গ্যাঞ্জামঘর; আজেবাজে কত্ত কিছু থাকে
তুমি থাকবে সৌরভে, অন্ধকারে
জীবচক্ষুর আড়ালে,
দিগন্তের ওপাড়ে।
লৌহপ্রাচীরের দুর্ভেদ্য সিন্দুকে লখিন্দরের মতো নয়,
কোরান শরীফের ভেতর লুকিয়ে রাখা ইয়াবার মতো নয়,
ব্রা’র ভেতর স্তনে মেশানো হেরোইন নয়,
তোমাকে জাদুর ভেতর অথবা গভীর গোপন রাখবো-
অসূর্যস্পর্শীতে।
ছুঁমন্ত-ছুঁ ধাঁধার মধ্যে, যুক্তাক্ষরে
অজানা এক বিলুপ্ত ভাষার ভেতর।
পৃথিবীর কোনো টাওয়ার, সেন্সর, স্ক্যানার, সিসি ক্যামারা
ঘূর্ণাক্ষরেও টের পাবে না, জানবে না তোমার অবস্থান,
কোনো গোয়েন্দাসংস্থাও জানবে না,
হ্যাকারও পাবে না পাসওয়ার্ড
জ্যোতিষশাস্ত্র দিয়ে দৈবজ্ঞ গণনা করেও পাবে না
তোমার অপ্রকাশিত নাম।