করোনাক্রান্ত কালে
এক.
বিষণ্নতা তোমাকেও ছুঁয়ে যায় জানি, তুমিও কবি,
তরুণ সময় যদি পক্ষে থাকে তবু।
নব কিশলয়ের মতো নতুন সবুজে ডগমগ করবে
তোমার উতরোল মনের জমিন।
প্রতিদিন সূর্যোকরজ্জ্বল সকাল
তুমুল হাতছানিতে ডাকবে তোমায়।
মনে হবে করোনাক্রান্ত এই সময়ও যেন
পত পত করে উড়ছে
স্বাধীন সার্বভৌম দেশের পতাকার মতো।
দুই.
কোভিড—উনিশের ঝিঁম-মারা এক আত্মঘাতী
সময়ের কবলে অবরুদ্ধ হয়ে আছি আমি।
আমার মতো সঙ্গনিরোধ-বাসে একান্তই
আরও একাকী যারা, তারা সব্বাই
বিষণ্নতার কোলে কাঁখে বিষাদের ছানাপোনা
গুনে গুনে পার করছে সময়।
তাদের কথা আর কী বলবো।
তারা তো সব আমার মতোই বয়সের লেজটুকু ধরে
অজান্তেই হাবুডুবু খায় আত্ম-নির্বাসনে…
আজকের দিনটি পার হলে আগামীর জন্যে
উদ্বেকাকূল কণ্ঠে বলে,
হা ঈশ্বর, হা প্রকৃতি মাতা তুমি কোথায় গো?
মনে মনে ডাকলেই আগে কত সহজিয়া পথে
পাওয়া যেতো তোমাকে,
এখন কেন দাও না দেখা এই করোনাক্রান্তকালে।
তিন.
কালো-পাপে কি ডুবিয়ে দিয়েছি তোমার জগৎ-সংসার?
সভ্যতার নামে অরণ্যানী উজাড় করে নষ্ট করেছি কি প্রাণীকূলের অভয়ারণ্য?
ভেঙেছি অযুত পাখির বাসা?
পৃথিবীর তিন ভাগ জল ছুঁয়ে-ছেনে করেছি কি বিষাক্ত?
গরিবের পেটে লাথি মেরে নিজেকে করেছি কি ধনাঢ্য?
সুস্বাস্থ্য, সুরক্ষার কথা না ভেবে বানিয়েছি কেবল
নিউক্লিয়ার অস্ত্রশস্ত্র?
সাদা-কালো-বাদামির স্লোগান তুলে
তোমার মাটি ও মানবতাকে করেছি কি বহুধা বিভক্ত?
চার.
জানি, অগণন অপরাধে অপরাধী আমরা সকলে
আমাদের কি ক্ষমা নেই কোনোই?
কোনো ক্ষমা নেই?
তুমি তো জানো, করোনা ভাইরাসযুদ্ধে
বিপুল এই পৃথিবী কতটা আজ অসহায়,
বিপর্যস্ত, বিজন অন্ধকারে নিমজ্জিত।
সমগ্র মানবকুল মৃত্যু-আতঙ্ক বুকে নিয়ে ঘুমাতে যায় রোজ,
পরের দিনে সূর্যোদয় দেখবে কী, দেখবে না, জানে না সে।
জানে না সে, পৃথিবীর এই গভীরতর অসুখ
আর কতকাল তাকে রাখবে অবরুদ্ধ গৃহে?
বাবুই পাখির মতো মানুষও গৃহ গড়েছে ঘুমের জন্যে
সারাবেলা গৃহবন্দি হতে নয়,
দু’হাত বাড়িয়ে সে কি দৌঁড়ে আর ছুটে যেতে পারবে না প্রকৃতি পরমের কোলে?
সহমর্মী সকল প্রাণীর পাশে দাঁড়িয়ে নেবে না নিঃশ্বাস?
নিসর্গের আলো-ছায়া-সবুজে মাখামাখি হয়ে
শ্যামল শরীর-মন কবে আর লুটোপুটি খাবে
ধুলো-কাদা মেখে?
পাঁচ.
মানুষে মানুষে যদি রক্তপাতের যুদ্ধ হতো,
তবু তো আশা ছিল।
যেকোনো সময়ে মৈত্রীময় সন্ধি হলে
হঠাৎ শাদা পতাকা তুলে কোনো এক ভোরে
থেমে যেতো সে যুদ্ধ।
সকল অবরোধ তূচ্ছ করে মানুষ তার স্বভাষায়,
স্বভূমে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুনর্বার আনন্দে
গেয়ে উঠতো জীবনের জয়গান…
ছয়.
অভিমানে তুমি কি ফিরিয়েছ মুখ,
ওহে প্রকৃতি মাতা?
কষ্টের কুসুমসমূহ ছিঁড়ে ফেলতে চাও আজ
সাম্যবাদী তোমার দু’হাতে
অনন্ত বিশ্রামে তুমি যেয়ো না তবু
এতটা কঠিন, কঠোর তোমাকে মানাবে না জানি।
তোমার দুষ্টু সন্তানদের গৃহবন্দি করে
খুব শাস্তি দিতে চাও বুঝি?
দাও তবে, সকল অপরাধের বেসামাল শাস্তি?
সাত.
দেখো, তোমার সাজানো সবুজ উদ্যান শূন্য পড়ে আছে
মানুষই তো তোমার প্রিয় ফুটন্ত গোলাপ,
সবচেয়ে প্রিয় বুদ্ধিদীপ্ত মানবফুল তোমার;
শুষ্ক বাগান পতিত রেখে
কী তবে আর সৌন্দর্য ফোটাবে তুমি
বলো, বলো মাগো।
হে আকাশ,হে বাতাস, হে সূর্য-নদী,
ওহে মৃত্তিকা-মদির
ক্ষমা করে দাও তবে আমাদের,
আরও একটিবার…
তোমার ক্ষমা পেলে, কথা দিচ্ছি
সমস্বরে শপথ নেবো,
এবার আমরা মানুষ হবো—
হে প্রকৃতি পরম,
হে প্রকৃতি পরম
পিয়ার্সন এয়ারপোর্ট
পিয়ার্সন এয়ারপোর্ট কান্নায় ভেঙে পড়ছে এই সময়ে
কোভিড উনিশের অচেনা ঝড়ে,
এই কিছুদিন আগেও প্রতিটি দেশের
এয়ারপোর্টগুলো ছিলো ঐশ্বরিক আলোর মতো,
যেন বিয়ে বাড়ির ঝলমলে রঙিন উৎসব।
গতকাল শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরকে রেখে এলাম
করোনায় ভীত-সন্ত্রস্ত জবুথবু নিঃস্ব রোগীর মতো,
ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে আছে অধীর;
তাকে পেছনে ফেলে দুবাই ট্রানজিটে এসে দেখি
লাউঞ্জের ফ্লোরে, যত্রতত্র শুয়ে-বসে ঘুমিয়ে আছে
উন্নত দেশের যাত্রী সব;
যেন কমলাপুর স্টেশনে অসহায় উদ্বাস্তু মানুষের দঙ্গল।
এমন দুঃসময় কেউ দেখেছি কি আগে?
যখন ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন চুরি হয়ে যায় অজানা রোগে
আন্তর্জাতিক উড়োবাস সব বাতিল করোনা ঠেকাতে
আকাশের নীলে আজ শোকের পতাকা
শূন্যে উড়ছে যাত্রীদের পরস্পর অবিশ্বাস
কোথায় কার লুকানো রয়েছে করোনা, কেউ তা জানে না
সন্দেহের ধোঁয়া নড়ে ওঠে সকলের নিঃশ্বাসের বাতাসে
টরন্টোর পিয়ার্সন এয়ারপোর্টে নেমে মনে হলো
যেন কোনো পরিত্যক্ত ভিটা-বাড়িতে এসেছি প্রথম
প্রকৃতি এখানে নিঝুম বাক্যহীন মানুষের ইশারা;
সময় দাঁড়িয়ে আছে উলঙ্গ এক পথশিশুর মতো
রোবটের মতো বসে আছে ইমেগ্রেশন কাউণ্টার
নিষ্ক্রমনের পথ পার হয়ে বেরিয়ে এসে দেখি
সন্তানের মুখ, সাদা মাস্কে ঢাকা এক অচেনা বিভূতি,
আলিঙ্গনের জন্যে বাড়ানো নেই তার হাত
মাকে দেখে সেই চিরন্তন হাসির ফোয়ারা নেই,
চোখে তার দিগন্তপ্লাবী উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তা;
শাদা লিলির সৌরভ ভুলে গিয়ে
অভিন্ন আজ স্যানিটাইজার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে
মায়ের অপেক্ষায়,
৭৫০ স্কোয়ার ফিটের কন্ডোর দুটো কক্ষে
মাতা-পুত্র দু’জনের সঙ্গনিরোধ কালে
প্রতিদিন সঙ্গে থেকো অন্টারিওর জল,
সিএন টাওয়ারের আকাশগামী চূড়া…
হে সূর্য সারথী,
প্রতিদিন তোমাকে দেখবো বলে
এখনো স্বপ্ন দেখি,
স্বপ্নে বাঁচি।
ওল্ড এইজ/
(করোনাক্রান্ত ইতালির স্মরণে)
মহাশূন্য নেমে এসেছে এইখানে, ইতালির রোমে
পৃথিবী উড়ে গেছে অজানা গ্রহে
আমরা এখন অন্যরকম জীবন বেছে নিয়েছি,
হোম কোয়ারেন্টাইন, নয়তো আইসোলেশন।
এসবের কিছুই জানে না শিল্পী রাফায়েল
কিংবা মাইকেল এঞ্জেলো,
অথচ, সূর্যের শপথ নিয়ে প্রতিদিন
সেখানেই ফেরৎ যাবার কথা ভাবছি,
যেখানটায় ঘর-কন্নার সবকিছুতে লকডাউন;
অথচ শাদা-কালো-বাদামী মিলে
স্থান-কালের ব্যবধানে নাম লেখে সাম্যবাদী দলে।
দেখো তো, এমন পাগলও আছে দেশে দেশে
যারা নিজেদের কখনো উন্মাদ ভাবে না,আর
অতীত পাখির ফসিল নিয়ে খেলা করে সর্বক্ষণ।
ধরে নাও, পৃথিবী এখন উন্মাদের কারখানা
জনশূন্য কলোসিয়াম, সিসটিন চ্যাপেল…
মাটির গন্ধ ভুলে গিয়ে তারা সবে সবুজের শেকড়
কেটে কেটে দু’হাতে রক্তের নদী ছুঁয়ে আছে,
প্রতিদিন যারা মৃতের মিছিলে হারিয়ে যাচ্ছে,
তাদের দেহের ডালপালা জুড়ে করোনার কলাপ-কূজন,
হাতে নেই কোনো রক্তজবা কিংবা রক্তকরবীও
গোলাপ তো বাহুল্য স্বপ্ন…
অবহেলা, অযত্নে পড়ে আছে ভ্যাটিক্যান
আগুনে ঝলসে গেছে তার শ্বাসযন্ত্র
হৃদয়ের গভীরে পুড়ছে আত্মঘাতী দেশ-প্রেম
আর ওল্ড এইজের টানাপড়েন,
রাজন্যবর্গের অর্থনীতির হিসাবে বাড়ছে গরমিল
সোনার মোহর তাই জঞ্জাল ভেবে
মৃত্যের মূল্যে বেচে দেয় মাটির প্রতিমা,
শাকের আঁটিতে তারা বিপুল ভারে ভারানত
বাহুল্য ইতিহাস ছাড়া আজ কিছু নয়।