উন্মাদ বসন্তের গান
কোমল হৃদয় হতে উৎসারিত গোলাকার
আগুনের মুখ, ঘাসের জীবনজুড়ে প্রোজ্জ্বল
চেতনার পাতায়—একক চিহ্নরূপ রেখেছে
বিচ্ছেদশিখা; হলাম একাকিত্বের পবিত্র সুখ—
সংহার। নিবিড় জারিত দেহ সকল সন্তাপে
স্মরণ করিয়ে দেয় ক’খানি প্রলয় চিত্রপট—
বিকশিত জলের অন্বেষণ, স্থলেই অস্তমান
পদতলে সুখের উদ্যান কিছু; ফুলের গর্জনে
মৃদু সঙ্গীত মাখা আকাশ ফিরছিল শূন্য
লোকে। সমুদ্রের কিছুতো নেই সমুদ্র-তলে,
ক্রোধে তুলে ধরি নক্ষত্র-সকল; মুকুলিতা
বর্ণের আশ্রয়ে স্মরেছি সুনীল ছায়া, তা হতে
সৃজিত স্বরে পরম-রূপা কল্পনা। হয় জাগ্রত
নির্জন রঙ এরূপ রহস্যে নির্গত; আমোদিত
বেদনার ভাব বৃক্ষ-সঞ্চালনে মূর্ছিত পাখির
অলীক কণ্ঠে বিমূর্ত লিখে নাম; প্রণয়াসক্ত
ঠোটের গভীরে রাখা জ্বিব—গুপ্তে রঙা বহু
আরাধ্য পঙ্ক্তির প্রাণবন্ত আলিঙ্গন-তাপে
শ্রাব্য করেছে তাদের। অনন্ত পিপাসার ধ্বনি
রক্তিম দৃশ্যে জ্বলে ওঠে বারংবার; চকিতে
নীল হে শিখায় বেষ্টন করা প্রশান্ত অঙ্গুরী,
পুনরায় আক্ষেপ করা বৃথা;—এ নগর জুড়ে
উদিত অরণ্যময় নব বন্ধনে মুক্তি পেয়েছি
আনন্দের মত। স্তব্ধে উড়াই তার প্রতিফলন,
অতীত রক্তে মন্দ্রিত সুরের দুর্লভ ইঙ্গিতে
কম্পিত দেহ; ব্যক্তির স্ফুটন—গানের আঘাত
যেন বর্ণিল জ্ঞান, শত পলকের সহস্র গ্রন্থনা।
উষ্ণ খোলসে ঢাকা এ কোন মহৎ ছদ্মবেশ
অনুরণিত হয়!—দীপ্ত শিকলে বাঁধা ফণাহীন
সরীসৃপ, চতুর তরঙ্গে ভাসমান ব্যকুল শরীরে
লুকিয়ে পড়েছিল। স্থির চক্ষু জ্বেলে আঁধারে
ঝুলন্ত সর্বে আছি, উড়ন্ত শব্দে আসীন ধূলিলিপ্ত
মানুষের ঘুমের নিগড়ে বন্দি। আড়মোড়া
খুলে আসে যত কুন্তল, জীবনে রঞ্জিত সিংহ
জীবন দেখি ছাইয়ের পতনে অপূর্ব গুণরাশি—
মৃতদেহরূপে উত্তীর্ণে প্রকাশিত; বিপুল বজ্রে
স্খলিত অমরতায় উন্মাদ বসন্তে ছুটে আসে।
অর্পণ
আমি তোমাতে প্রেমে, স্থাপিত হয়েছি প্রাণ!
পূর্ব হতে পশ্চিম, ভূমিতে জল,
অপরূপা বৃক্ষের নিচে মায়ামুখে অর্পিত আমি।
একাকী তোমার বিবর্ণ দেহে
নিঃশ্বাস মিশিয়েছি রোজ;
সুশীতল অগ্নিতে প্রদীপ্ত করা হলো
নিরাকারে ব্যাহত আকাশ।
বহুমূল্য মোম গলে, প্রগাঢ় ছায়াতল কেঁপে কেঁপে
নিশ্চুপ হৃদয়ের তলে রক্তরঙ প্রসারিত হয়।
তবে কেন পালিয়েছো আমা হতে!
আছ কি তুমি? শোনো নাই ডাক!
সোনালি আত্মা হতে প্রসারিত সুর ওগো—
দিগন্ত বিস্তৃত কম্পিত সৌরভে
তুমিহীন ছায়া হতে জন্ম দিয়েছি পাখি,
পালকে প্রদীপ্ত শাদা নক্ষত্র জ্বলে তার।
ভ্রান্তি
জলে প্রদীপ্ত অঙ্গার দেখ,
দেখ লাল, বিচ্ছিন্ন, গাঢ় এক রক্তচুম্বন
সুমহান সে ভ্রান্তি
স্বতোৎসারিত আগুনের ভেতর
কত ভগ্ন-অংশ রেখে আসে;
মৃদু ঠোঁট হতে জলে তার সুগন্ধ চমকায়।
নীল সে বাচনভঙ্গি, শৈলচূড়া
হতে অতি ধীর
তোমার ললাটে মাখে
শাদা কঙ্কন পরা রমনীয় হাত;
তার বিভ্রমটুকু শোধিত কর।
স্মৃতির ঝালরে ক্ষত, তড়িৎ-আহত
নকশা কাটা
বারংবার পিছু ফিরে দেখে নেওয়া
ডুবে যাচ্ছে হৃদয়, হৃদয়ের ছাঁই
ঐ যে সমুদ্রফেনা, ভাসমান সমাধীতে
চিত্ত-বৃষ্টি
উড়তেই পারো, ঝর্ণাধারার পাশে উড়ে যাও;
স্ফীত মুকুটের মাঝে রোদ,
প্রসারিত হাত তুলে
ক্ষণিক আলোড়নে ছুঁড়ে দেয় সমূহ সবুজ,
যার মাঝে তুমিও রয়েছ হে!
বলি তাই, সর্বাপেক্ষা বেশি কিছু নাই,
অভিন্ন গতিতে যে পাতার মুকুট পরা
বিভক্ত শব্দ ডাকে—তার ঠোঁট, উচ্চতর বাঁশী তার,
উপেক্ষিত রয়েছে পাপী ও দেবীর কাছে।
হাঁটুগেড়ে বসে বৃক্ষের শেকড়ে পেয়েছি হাসি;
হাসিহীন এ জগৎ ভালো
যারা বলে, তাদের কাঁধে
গলিত ব্যধি, উড়ন্ত স্বভাব পেয়েছে।
এ প্রতীক অধিগম্য নয়; এ দৃশ্য,
ভবিষ্যৎ প্রবাহের ঘন দর্পণে
অগ্নিপাথর রাখা, শিখাবৎ জলের সন্তান।
চোখজুড়ে মহাসিদ্ধান্তরূপ সম প্রার্থনার
বিদ্যুত নেমে আসে জলে, একাকী ভ্রমণের গানে
ক্রমশ রাঙা হয়ে উঠছ তুমি।