আত্মপ্রতিকৃতি
আঁকতে বসে আত্মপ্রতিকৃতি
এঁকেছিলাম ক্ষিপ্র চিতার মুখ
মনের ছবি ফুটিয়ে তোলা যায়?
তার সাধনায় রাত্রি হলো পার।
মগজ-ভর্তি হাঙর-কুমির নাচে
ক্ষুধার্ত খুব, তাড়ায় অহর্নিশি
হাতের তুলি সিংহের থাবায় গেলো
চোখ এঁকেছি, দেখি অন্ধকার।
আঁকতে বসে নিজের প্রতিকৃতি
এঁকে ফেলি বন-কুকুরের মুখ
বুকের ভেতর ঝড়ের আওয়াজ ওঠে
হাসি শুনি হিংস্র হায়েনার।
সময় আঁকার নামে কেবল আঁকি
অদ্ভুতুড়ে যত প্রাণী আছে
কেবল মানুষ আঁকতে গেলে দেখি
বিরান ভূমি আগুনে ছারখার!
বাবা
বাবা তো ক্রন্দনরত পাহাড়ের নাম
আদিপাপ মোছনের দায় নিয়ে কাঁধে
চিরকাল পরে যান দাসত্ব শৃঙ্খল।
চোখে তার সন্ত্রস্ত আকাশ
বুকে তবু ধরা থাকে বিপুল সাহস।
বাবা তো ক্রন্দনরত আকাশের নাম
শরশয্যায় শায়িত, তবু দেখে আশা
মেঘের মেয়ের সঙ্গে মিতালি পাতায়
বজ্রের আঘাতে হাসে চোখের সীমানা।
বাবা তো ক্রন্দনরত সাগরের নাম
একবার ডাক দিলে দখিনা বাতাসে
কেঁপে ওঠে বঙ্গোপসাগর
পৃথিবীতে নেমে আসে নুহের প্লাবন।
চিরকাল ঠকে যাওয়া কোমল হৃদয়
অথচ সন্তান জানে, ‘বাবারা কঠিন
বাবারা করেন শুধু নিঠুর শাসন।’
বাবা যে মেঘের ছায়া রোদ্দুরে দুপুরে
জানেন পরমেশ্বর, জানে মহাকাল।
উত্তরাধিকার
বাবা ছিলেন একাকী—ভিষণ দুঃখী।
কখনো বোঝা যেতো না—ছিলেন কতটা
কষ্টে—কত নিঃসঙ্গ!
তীব্র অভিমান তাকে গ্রাস করেছিল—
একাকিত্ব বা কষ্টের কথা কাউকেই বলতেন না
যেদিন মারা গেলেন—আমরা ছিলাম দূরে দূরে
যে যার কাজে নিমগ্ন—বাবার মৃত্যুর
খবর পেলাম পরদিন।
জীবিত বাবার মুখে কোনোদিন আমরা কেউই
দিতে পারিনি দুমুঠো অন্ন তুলে
রোগশয্যায় দাঁড়াতে পারিনি কখনো
তার পাশে—
মৃত বাবার লাশের পাশে ভাইয়েরা
কান্নায় ভেঙে পড়েছি
যেন বাবাকে আমরা
অনেক ভালোবাসতাম
অথচ ঈশ্বর ভালো জানেন—আমরা
কতটা নির্দয় আর নিস্পৃহ ছিলাম
কতটা ছিলাম স্বার্থপর!
এখন নিজেও এসে দাঁড়িয়েছি ধর্মসংকটে
যে আমি রাখিনি কোনো স্মৃতিচিহ্ন—দাগ
সে আমার কেন হবে না নিঃসঙ্গ—একাকী জীবন?
কৃষ্ণের প্রতি ভীষ্ম
হে চক্রধারী, হে কৃষ্ণ—আর কত বোঝাবেন ভুল?
ভীষ্মের শপথ আজ করে দিলো নিঃস্ব!
সাধের হস্তিনাপুর ভস্ম—তবু আমি নির্বিকার
এ কেমন শপথের শাপে বন্দি আমি দেবব্রত
এই ‘কালবেড়ি’ ছিঁড়ে রাজ্যরক্ষা হলো না আমার!
দক্ষিণা ঝড় উড়িয়ে নিয়েছে বসত
রাত্রি গভীর হওয়ার আগে ঘুম নেমে এলো চোখে
সূর্যোদয়কালে কেন দেখা দিলো সন্ধ্যার আন্ধার
সবই কি সেই শপথের ফল?
হে কেশব, আপনিও নিঠুর স্বার্থের জালে বন্দি
ধর্ম প্রতিষ্ঠার নামে যে কেড়ে নিলেন—
কৌরব অথবা পাণ্ডবের প্রাণ—তারা কে বলুন
মানুষ বড়, না ধর্ম?
জানি—
এই প্রশ্ন অর্থহীন, উভয়ই তো আমার সন্তান
তবে কেন বুঝি নাই এতকাল?
হে মাধব, আপনার তো কিছুই ছিল না অজানা
তবে কেন অর্জুনেরে বেঁধেছেন ছলনার জালে
আমার সাধের দেশ ভেসে যায় রক্তের গঙ্গায়
আমি হায়—অসহায়—তবু শুয়ে কণ্টক শয্যায়!
মানুষ কেন মিথ্যা বলে
নিবিড় ঘন রাতের আকাশ কাঁপে
নড়ে ওঠে বাবার চওড়া কাঁধে
বাতাস তবু কিসের অনুরাগে
মেঘকে ডাকে করুণ আর্তনাদে?
অকারণেই ভুলতে কি হয় লাজও
মানুষ কেন মিথ্যা বলে আজও?
সময় বুঝি ঘুরছে পেছন পথে
কৃষ্ণ হাজির, রামের দেখা নেই
কে কার আগে এলেন-গেলেন তবে?
সভ্যতার তো ঘোর কাটে না এই:
জগৎপিতা ভুলেছে নিজ কাজও
মানুষ কেন মিথ্যা বলে আজও?
মানুষ ভাবে তারা সেরা জীব
অন্যপ্রাণী হীন তাদের চেয়ে
অথচ এই মানুষেরাই খুনি
খুন করে রোজ ন্যায়ের গীতি গেয়ে!
তাই লাজে মুখ লুকায় পশুরাজও
মানুষ কেন মিথ্যা বলে আজও?
তোমার ভীরু ঠোঁটে
চাঁদের পিঠে রঙ চড়িয়ে মেঘের নদী ছোটে
তোমার নামে জিকির করে আসমানে ফুল ফোটে
আমার দুচোখ গলছে যেন তোমার ভীরু ঠোঁটে।
রাত যদি কয় তারার মেয়ে ঘুমের দেশে কেন
হালকা হাওয়ায় পাখির গানে মাদক ছড়ায় যেন
কদম তলায় শুনতে বাঁশি রাধারা সব জোটে।
আমার দুচোখ গলছে যেন তোমার ভীরু ঠোঁটে।
গড়িয়ে দুপুর বিকেল নামে রেশম রেশম হাওয়ায়
মনের ভেতর কোকিল কাঁদে বসন্ত না পাওয়ায়
বাতাস বুঝি কেঁদে বেড়ায় দূরের করুণ গোঠে।
আমার দুচোখ গলছে যেন তোমার ভীরু ঠোঁটে।
প্রেমের পারদ ওঠানামা নিত্য করে জানি
হৃদয় কাঁদে হৃদয় লাগি, চলুক কানাকানি
দুপুর রাতে গানের সুরে হৃদয় নেচে ওঠে
আমার দুচোখ গলছে যেন তোমার ভীরু ঠোঁটে।